কড়া নিরাপত্তার মধ্যে জাপানি নাগরিক কুনিও হোশি হত্যা মামলায় রায় ঘোষণার কার্যক্রম শুরু হয়েছে রংপুরের জজ আদালতে।
Published : 28 Feb 2017, 08:42 AM
চাঞ্চল্যকর এ মামলায় ছয় জেএমবি সদস্যের সাজা হবে কি না- এই রায়ে সেই সিদ্ধান্ত দেবেন রংপুরের বিশেষ জজ নরেশচন্দ্র সরকার।
ছয় আসামির মধ্যে কারাগারে থাকা পাঁচজনকে মঙ্গলবার সকালেই আদালতে নিয়ে আসা হয়। আদালত ও আশপাশের এলাকায় নেওয়া হয় কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, জেএমবি সদস্যদের রায়ের কারণে তারা সতর্ক রয়েছেন। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সব ধরনের ব্যবস্থাই নেওয়া হয়েছে।
সকালে আদালতের সবগুলো ফটকেই বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন থাকতে দেখা যায়। আইনজীবী ও সংবাদকর্মী ছাড়া অন্য কাউকে ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছেন না তারা।
২০১৫ সালের ৩ অক্টোবর কাউনিয়া উপজেলার সারাই ইউনিয়নের আলুটারি গ্রামে ৬৬ বছর বয়সি জাপানি নাগরিক কুনিও হোশিকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
পুলিশ আটজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়ার পর গতবছরের ১৫ নভেম্বর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে এ মামলার বিচার শুরু করেন বিচারক নরেশ চন্দ্র সরকার।
এ আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী রথীশচন্দ্র ভৌমিক বাবুসোনা যুক্তিতর্ক শুনানির পর সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পরিকল্পিতভাবে এই বিদোশি নাগরিককে হত্যা করা হয়েছিল। আমরা সাক্ষ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করেছি। আশা করছি, আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা হবে।
অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী আবুল হোসেন বলেছিলেন, “আমার মক্কেলরা নির্দোষ। তাদের পরিকল্পিতভাবে এই মামলায় জড়ানো হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষ সন্দেহাতীত কোনো প্রমাণ হাজির করতে পারেনি। আশা করছি তারা খালাস পাবেন।”
আসামিদের মধ্যে জেএমবির রংপুর অঞ্চলের কমান্ডার মাসুদ রানা ওরফে মামুন ওরফে মন্ত্রী (৩৩), ওই জঙ্গি সংগঠনের সদস্য ইছাহাক আলী (৩৪), লিটন মিয়া ওরফে রফিক (৩২), আবু সাঈদ (২৮) ও সাখাওয়াত হোসেন (৩০) গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন। তাদের উপস্থিতিতেই এ মামলার বিচার চলে।
আরেক আসামি কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার মকর রাজমাল্লী এলাকার আহসান উল্লাহ আনসারী ওরফে বিপ্লব (২৪) এখনও পলাতক।
বিপ্লব রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। গত বছরের জানুয়ারি থেকে তিনি অনুপস্থিত বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ইব্রাহীম কবীর জানিয়েছেন।
এ মামলার অভিযোগপত্রে আরও দুজনের নাম ছিল। তাদের মধ্যে পলাতক সাদ্দাম হোসেন ওরফে রাহুল চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি রাতে ঢাকার মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ এলাকায় কাউন্টার টেরোরিজম পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন। আর নজরুল ইসলাম ওরফে বাইক নজরুল ওরফে হাসান গত বছরের ২ অগাস্ট ভোরে রাজশাহীতে পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা যান।
কারাগারে থাকা পাঁচ আসামি রংপুরের কাউনিয়া উপজেলায় মাজারের খাদেম রহমত আলী হত্যা ও বাহাই নেতা রুহুল আমীন হত্যাচেষ্টা মামলারও অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি। আর পলাতক আহসান উল্লাহ আনসারী ওরফে বিপ্লব বাহাই নেতা হত্যা চেষ্টা মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি।
আলুটারি গ্রামে দুই একর জমি ইজারা নিয়ে কুনিও যে ঘাসের আবাদ করেছিলেন, মুন্নাফ নামের এক ব্যক্তির রিকশায় চড়ে প্রতিদিন সকালে সেই খামার দেখভাল করতে যেতেন তিনি। ২০১৫ সালের ৩ অক্টোবর সেখানে যাওয়ার পথেই তিনি খুন হন।
ওই দিনই কাউনিয়া থানার তৎকালীন ওসি রেজাউল করিম বাদী হয়ে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন। ঘটনার পরপর আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএস এর দায় স্বীকার করলেও সরকার তা নাকচ করে।
প্রথম দিকে পুলিশের তদন্ত স্থনীয় এক বিএনপি নেতাকে ঘিরে আবর্তিত হলেও পরে তাতে জঙ্গিদের যোগাযোগ পান তদন্তকারীরা।
প্রায় নয় মাস তদন্তের পর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কাউনিয়া থানার ওসি আব্দুল কাদের জিলানী গতবছর ৩ জুলাই রংপুরের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিমের আদালতে অভিযোগপত্র দেন। সেখানে জেএমবির আট জঙ্গিকে আসামি করে প্রাথমিক সন্দেহের ভিত্তিতে গ্রেপ্তার ছয়জনকে অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন করা হয়।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, কুনিও হোশিকে লক্ষ্য করে পর পর তিনটি গুলি করেন জেএমবির আঞ্চলিক কমান্ডার মাসুদ রানা। মোটর সাইকেলে তারা তিনজন ছিলেন। গুলি করার পর মোটর সাইকেলে করে তারা পালিয়ে যান। ঘটনাস্থলেই মারা যান ৬৬ বছর বয়সী কুনিও।
হাকিম আদালত থেকে মামলাটি বিশেষ জজ আদালতে স্থানান্তরের পর ২০১৬ সালের ১৫ নভেম্বর বিচারক অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে আসামিদের বিচার শুরু করে।
চলতি বছর ৪ জানুয়ারি সাক্ষ্যগ্রহণ শুরুর পর রাষ্ট্রপক্ষে ৫৭ জনের মধ্যে ৫৫ জনের সাক্ষ্য শোনে আদালত। আসামি মাসুদ রানা ও সাদ্দাম হোসেনের গুলিতে কুনিও মারা যান বলে তদন্ত কর্মকর্তা কাউনিয়া থানর ওসি আব্দুল কাদের জিলানী তার সাক্ষ্যে বলেন।
অন্যদিকে আসামি সাখাওয়াত হোসেন ওরফে রাহুলের পক্ষে তার গ্রামের বাড়ি গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার হলদিয়াবাড়ি ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য আব্দুল মজিদ মণ্ডল সাফাই সাক্ষ্য দেন।
১৪ ফেব্রুয়ারি সাক্ষ্য ও জেরা শেষে রোববার এক দিনেই আসামি ও রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তিতর্ক শোনে আদালত। এরপর বিচারক রায়ের দিন ঠিক করে দেন।
রংপুর শহরের মুন্সীপাড়ার জাকারিয়া বালা নামে এ ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগের সূত্র ধরে বাংলাদেশে এসে রংপুরের কাউনিয়া উপজেলায় একটি ঘাসের খামার করছিলেন কুনিও হোশি। ওই উপজেলার সারাই ইউনিয়নে আলুটারি কাচু গ্রামের মানুষ তাকে নিপাট ভদ্রলোক বলেই জানত।
২০১১ সাল থেকে রংপুরে যাতায়াত শুরু হলেও ২০১৫ সালের মে মাসের পর মুন্সীপাড়ায় বাড়ি ভাড়া নিয়ে বসবাস শুরু করেন তিনি । বেশ কিছুদিন থাকায় ভাঙা বাংলায় কথা বলেতেও শিখেছিলেন এই বিদেশি। কারও সাথে দেখা হলে সালাম দিতেন, কেউ সালাম দিলে জবাবও দিতেন।
কুনিও নিহত হওয়ার পর তার ইসলাম ধর্ম গ্রহণের খবর গণমাধ্যমে আসতে শুরু করে। স্থানীয়রা দাবি করেন ইসলাম গ্রহণ করে কুনিও ‘গোলাম মো. কিবরিয়া’ নাম নিয়েছিলেন। বাড়ির পাশের মসজিদে তাকে শুক্রবার জুমার নামাজ এবং মুন্সিপাড়া কবরস্থান মাঠে ঈদের নামাজ পড়তে দেখার কথাও তারা বলেন।
কুনিও খুন হওয়ার পর জাপান দূতাবাসের কর্মকর্তারা রংপুর ঘুরে গেলেও লাশ হস্তান্তর ও শেষকৃত্যের বিষয়টি ঝুলে থাকে ধর্ম বদলের কারণে। পরে রংপুরের মেয়র শরফউদ্দিন আহম্মেদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সেখানেই কুনিও হোশির শেষকৃত্যের ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করে জাপান কর্তৃপক্ষ।
হত্যাকাণ্ডের দশ দিনের মাথায় ব্যাপক গোপনীয়তার মধ্যে ২০১৫ সালের ১২ অক্টোবর গভীর রাতে মুন্সীপাড়া কবরস্থানে মুসলিম রীতি অনুযায়ী দাফন করা হয় জাপানি নাগরিক কুনিও হোশিকে।