গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী যাত্রা শিল্পের বিলুপ্তি ঠেকাতে সরকার কোনো কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করছে না বলে অভিযোগ করেছে বাংলাদেশ যাত্রাশিল্প উন্নয়ন পরিষদ।
Published : 05 Sep 2016, 07:14 PM
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সোমবার দুপুরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে যাত্রা শিল্প উন্নয়ন পরিষদের নেতারা অভিযোগ করেন, ‘সংস্কৃতিবান্ধব’ সরকারের আমলে কার্যকর উদ্যোগের অভাবে ‘ধুঁকে ধুঁকে মরছে’ যাত্রা শিল্প।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সংগঠনের সভাপতি মিলন কান্তি দে।
শুরুতে যাত্রাশিল্পীদের আর্থিক দুরাবস্থার দিকটি তুলে ধরে তিনি বলেন, “২০১৫-১৬ মৌসুমে স্বাভাবিক নিয়মানুযায়ী ছয়/সাত মাস যাত্রা প্রদর্শনী হওয়ার কথা থাকলেও দুই মাসের বেশি কোনো দলই অনুষ্ঠান করতে না পারায় যাত্রাশিল্পে রীতিমতো দুর্ভিক্ষ চলছে।
“মাসিক বেতনে চুক্তিবদ্ধ শিল্পীদের অত্যন্ত করুণভাবে নিঃস্ব রিক্ত অবস্থায় বাড়ি ফিরতে হচ্ছে। অনিশ্চয়তা, হতাশা ও সীমাহীন দুর্ভোগের কবলে যাত্রাশিল্পীরা দিনাতিপাত করছেন।”
এই সমস্যা সমাধানে তিনি যাত্রা শিল্পীদের অনুদান প্রদানের দাবি জানান।
মিলন কান্তির অভিযোগ, ২০১২ সালে সরকারিভাবে যাত্রা নীতিমালা প্রণীত হলেও দেশের বিভিন্ন স্থানে এর যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে না। এমনকি নীতিমালা মোতাবেক যাত্রার আবেদন এক সপ্তাহের মধ্যে নিষ্পত্তি করার কথা থাকলেও যাত্রাশিল্পীরা তার সুবিধা পাচ্ছেন না।
জেলা প্রশাসন ও থানায় যাত্রার প্রদর্শনীর জন্য আবেদন করলেও অনুমতি পেতে গিয়ে তাদের নানা হ্যাঁপা পোহাতে হয় বলেও জানান তিনি।
যাত্রা শিল্প উন্নয়ন পরিষদের এই সভাপতি বলেন, “কখনও পরিস্থিতি-প্রেক্ষাপটের অজুহাত তোলে প্রশাসন আমাদের যাত্রা করতে দেয় না। অনুমতি যদিও মেলে তাও দেড়-দুই মাস লেগে যায়।
“আসলে ডিসি, এসপিরা ভানুমতির খেলা খেলছেন। সরকার নিষেধাজ্ঞা জারি না করলেও যাত্রা প্রদর্শনীর অনুমতি প্রদানে বিরাজমান প্রশাসনিক জটিলতা নিরসনে স্থায়ী কোনো ব্যবস্থাও গ্রহণ করেনি।”
যাত্রাপালায় অশ্লীলতার অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে মিলন কান্তি দে বলেন, “যাত্রাপালার আয়োজকরাই যাত্রা শুরুর আগে অশ্লীল নাচ-গানের আয়োজন করেন। স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা ও দুর্নীতিবাজ প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের কারণে এসব অশ্লীলতা চলছে।
“অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এ ধরনের অনৈতিক অশৈল্পিক কর্মকাণ্ডে ঘটনাচক্রে এক শ্রেণির বিকৃত রুচির দলমালিককেও যুক্ত হতে দেখা যায়।”
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির অন্তর্ভুক্ত ৮৮টি যাত্রাদলের কেউ যাত্রার নামে অশালীন কর্মকাণ্ডে যুক্ত হলে জাতীয় যাত্রাপালা নীতি অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানান তিনি।
সম্প্রতি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ‘জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক জাগরণ’ শিরোনামে দেশব্যাপী যে আয়োজনটি নিয়েছে, তাতে নাটক-গান-কবিতা-নৃত্যের ঠাঁই হলেও যাত্রা অন্তর্ভুক্তি না হওয়ায় সংবাদ সম্মেলনে উষ্মা প্রকাশ করেন যাত্রাশিল্পীরা।
মিলন কান্তি দে জানান, যাত্রা শিল্পীদের নানা অভিযোগ নিয়ে যাত্রা শিল্প উন্নয়ন পরিষদ সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিল। কিন্তু তিন বছর ধরে ‘নানা চেষ্টার’ পরেও সংস্কৃতিমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে পারেন নি কেউ।
মিলন কান্তির অভিযোগ, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় আদতে যাত্রা শিল্পীদের সঙ্গে ‘বিমাতাসুলভ’ আচরণ করছে।
চলতি বছর অক্টোবর বাংলাদেশের যাত্রাশিল্পী উন্নয়ন পরিষদ একটি জাতীয় কনভেনশন আয়োজন করবে জানিয়ে মিলন কান্তি জানান, জাতীয় কনভেনশনে যাত্রা উন্নয়ন পরিষদ আট দফা দাবি উত্থাপন করবে।
এসব দাবির মধ্যে চলতি বছরের মধ্যে ঢাকায় একটি জাতীয় যাত্রামঞ্চ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা, জেলা শিল্পকলা একাডেমির মতো জেলায় জেলায় সরকারি উদ্যোগে যাত্রামঞ্চ নির্মাণ, যাত্রাশিল্প একাডেমি প্রতিষ্ঠা, যাত্রা-নীতিমালা সংশোধন, যাত্রানুষ্ঠানের অনুমতি প্রদানের ক্ষমতা জেলা প্রশাসকের পরিবর্তে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করে তার উপর ন্যস্ত করা রয়েছে।
এছাড়া অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের জন্য আগামী নতুন মৌসুমে যাত্রানুষ্ঠানের সহজ অনুমতি প্রদানে প্রত্যেক জেলা প্রশাসনে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে বিশেষ সার্কুলার প্রেরণ, যাত্রানুষ্ঠানে অশ্লীলতার অভিযোগ প্রমাণিত হলে আয়োজক কমিটির সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসনিক কর্মকর্তারও জরিমানাসহ শাস্তির বিধান রাখা ও এমন অপরাধের জন্য দল মালিকের নিবন্ধন বাতিল করা, দুস্থ যাত্রাশিল্পীদের ভাতা প্রদানের জন্য পৃথক কোটার ব্যবস্থা করা, নাটকের মতো উন্নত মানসম্পন্ন যাত্রাপালা ও সুসংগঠিত যাত্রাদলকে অনুদান, প্রতি বছর শিল্পকলা একাডেমির উদ্যোগে দেশীয় পালা নিয়ে যাত্রা উৎসবের আয়োজন এবং যাত্রা শিল্পে প্রতি বছর একুশে পদক, শিল্পকলা একাডেমি পদক প্রদান করার দাবিও রয়েছে।