উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফেরাতে আনা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার আলোচিত রায় প্রকাশিত হয়েছে।
Published : 11 Aug 2016, 07:02 PM
সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে আসা ১৬৫ পৃষ্ঠার রায়টি বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে তোলা হয়েছে।
যে দুই বিচারপতি ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করেন, তাদের রায় প্রকাশিত হলেও বেঞ্চের অন্য বিচারপতির রায় এখনও আসেনি।
চলতি বছরের ৫ মে হাই কোর্ট বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যস্ত করে আনা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয়।
সুপ্রিম কোর্টের ৯ আইনজীবীর করা এক রিট আবেদনে দেওয়া রুলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী, বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের বিশেষ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠের মতের ভিত্তিতে ওই রায় দেন।
১৬৫ পৃষ্ঠার রায়টি লিখেছেন বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী। ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর সঙ্গে একমত পোষণ করছেন বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক।
এই মামলায় হাই কোর্টে রাষ্ট্রপক্ষে নিয়োজিত ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে অর্থাৎ দুই বিচারপতি ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করেন, এই রায় প্রকাশিত হয়েছে। বেঞ্চের অন্য বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের দেওয়া রায় এখন প্রকাশের অপেক্ষায়।”
হাই কোর্টের রায়ের পর তা স্থগিত চেয়ে ৮ মে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় একটি আবেদন করেছিল।
এ বিষয়ে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার বলেন, “প্রকাশের অপেক্ষায় থাকা রায় অর্থাৎ পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়ার পর বিষয়টি শুনানির জন্য চেম্বার বিচারপতির আদালতে উপস্থাপন করা হবে।”
রায়ে বলা হয়েছে, “বলতে দ্বিধা নেই, ষোড়শ সংশোধনী একটি কালারেবল লেজিসলেশন (কোনো কাজ সংবিধানের মধ্যে থেকে করার সুযোগ না থাকলে আইনসভা যখন ছদ্ম আবরণে ভিন্ন প্রয়োজনের যুক্তি দেখিয়ে একটি আইন তৈরি করে), যা রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ, আইন সভা থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ নীতির লঙ্ঘন।
“এটা সংবিধানের দুটি মূল কাঠামো ৯৪(৪)ও ১৪৭(২) অনুচ্ছেদেরও লঙ্ঘন। একইসঙ্গে সংবিধানের ৭(বি) অনুচ্ছেদকেও আঘাত করে।”
সংবিধানের ৭ (২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোন আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসমঞ্জস্য হয়, তাহা হইলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইবে৷
৯৪ (৪) অনুচ্ছেদে রয়েছে- এই সংবিধানের বিধানাবলী-সাপেক্ষে প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারক বিচারকার্য পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকিবেন।
রায়ে বলা হয়, “রুল যথাযথ (অ্যবসলিউট) ঘোষণা করা হল। ষোড়শ সংশোধনী আইন-২০১৪ কালারেবল, এটি বাতিল এবং সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হল। সংবিধান-ব্যাখ্যার বিষয়ে আইনের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন জড়িত থাকায় সংবিধানের ১০৩(২)(ক) অনুসারে সনদ দেওয়া হচ্ছে।”
সংবিধানের ১০৩ অনুচ্ছেদে আপিল বিভাগের এখতিয়ার সম্পর্কে বলা আছে। ১০৩(২) বলছে, হাই কোর্ট বিভাগের রায়, ডিক্রি, আদেশ বা দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগের কাছে সেই ক্ষেত্রে অধিকারবলে আপিল করা যাবে, যে ক্ষেত্রে হাই কোর্ট বিভাগ
(ক) এ মর্মে সার্টিফিকেট দান করবেন যে, মামলাটির সঙ্গে এই সংবিধান-ব্যাখ্যার বিষয়ে আইনের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন জড়িত রয়েছে।
২০১৪ সালে আনা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী গত মে মাসে হাই কোর্ট অবৈধ ঘোষণার রায়ের পর তা রাজনৈতিক অঙ্গনেও উত্তাপ ছড়িয়েছিল, সংসদেও ওয়াকআউটও হয়েছিল।
এর প্রতিক্রিয়ায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছিলেন, হাই কোর্টের এই রায় ‘সংবিধান পরিপন্থি’। এটি আপিলে টিকবে না।
রিট থেকে রায়
উচ্চ আদালতের বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে নিতে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়। বিলটি পাসের পর একই বছরের ২২ সেপ্টেম্বর তা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়।
অসদাচরণের জন্য উচ্চ আদালতের কোনো বিচারককে কীভাবে অপসারণ করা যাবে, সে প্রক্রিয়া নির্ধারণে আরেকটি আইনের খসড়ায় সম্প্রতি সম্মতি দেয় মন্ত্রিসভা।
ওই সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ৫ নভেম্বর হাই কোর্টে এই রিট আবেদন হয়। প্রাথমিক শুনানির পর হাই কোর্ট ২০১৪ সালের ৯ নভেম্বর রুল দেয়। রুলে ওই সংশোধনী কেন অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চাওয়া হয়।
এই রুলের উপর গত বছর ২১ মে শুনানি শুরু হয়। ওই দিন আদালত মতামত দিতে অ্যামিচি কিউরি হিসেবে জ্যেষ্ঠ পাঁচ আইনজীবীর নাম ঘোষণা করেন। এর মধ্যে ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম, ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ ও আজমালুল হোসেন কিউসি নিজেদের মত তুলে ধরেন।
রুলের শুনানি শেষে গত ১০ মার্চ আদালত ৫ মে রায়ের দিন ঠিক করে দেয়। রায় ঘোষণার প্রায় তিন মাসের মাথায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মতে আসা রায় প্রকাশ পায়।
>> ১৯৭২ সালে মূল সংবিধানে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের উপর ন্যস্ত ছিল। ১৯৭৫ সালের ২৪ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে ওই ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত হয়।
>> পরে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে ন্যস্ত হয়।
>> ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে উচ্চ আদালতের বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
>> ষোড়শ সংশোধনীর ৯৬(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রমাণিত অসদাচরণ বা অসামর্থ্যের কারণে সংসদের মোট সদস্য সংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতার দ্বারা সমর্থিত সংসদের প্রস্তাবক্রমে প্রদত্ত রাষ্ট্রপতির আদেশ ছাড়া কোনো বিচারককে অপসারিত করা যাবে না।’
>> ৯৬(৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, দফা (২) এর অধীন প্রস্তাব সম্পর্কিত পদ্ধতি এবং কোনো বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্য সম্পর্কে তদন্ত ও প্রমাণের পদ্ধতি সংসদ আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।
>> সেই তদন্ত ও প্রমাণের পদ্ধতি এবং অপসারণের প্রক্রিয়া ঠিক করে তৈরি একটি আইনের খসড়ায় গত ২৫ এপ্রিল নীতিগত অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা।