ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকের ‘একপেশে প্রতিবেদন’ এবং পুলিশ কর্মকর্তা ও রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের ‘দায়িত্বহীনতা’ নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করা হয়েছে এক তরুণীকে ধর্ষণ ও হত্যা মামলার রায়ে।
Published : 17 Nov 2015, 09:43 PM
মঙ্গলবার ঢাকার ৪ নম্বর দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক আবদুর রহমান সরদার এই রায় দেন। রায়ে ফরিদপুরের স্কুলছাত্রী জাকিয়া আক্তার চম্পাকে হত্যার দায়ে চারজনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
রায়ে বিচারক বলেছেন, মামলাটি যেন প্রমাণ করা না যায়, তার জন্য ‘অদৃশ্য একটি শক্তি’ তদন্তসহ অন্যান্য জায়গায় প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেছিল।
ময়নাতদন্তকারী ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক আবুল হোসেনকে ‘জ্ঞানপাপী’ আখ্যায়িত করে আদালত বলেছে, আসামি পক্ষের দ্বারা ‘ম্যানেজড’ হয়ে অনৈতিকভাবে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছিলেন তিনি।
২০১২ সালের ১৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ফরিদপুরের কোতোয়ালি থানার কাশিমাবাদ গ্রামে একটি গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান থেকে পিতৃ-মাতৃহীন চম্পাকে ডেকে নেওয়া হয়।
আধা মাইল দূরে একটি মেহগনি বাগানে পরদিন ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যায় কানাইপুর পুরদিয়া হাইস্কুলের নবম শ্রেণির এই ছাত্রীকে।
এরপর চম্পার ভাই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা প্রশাসন বিভাগের ছাত্র হাসিবুল ইসলাম হত্যার অভিযোগ এনে মামলা করেন।
তবে সুরতহাল প্রতিবেদনে পুলিশ এবং ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ধর্ষণ ও হত্যার আলামত দেখতে পাননি বলে মত দেন। এর বিরুদ্ধে আদালতে নারাজি আবেদন করেন বাদী।
কবর দেওয়ার ২২ দিন পর চম্পার দেহ তোলা হয়, হয় ভিসেরা পরীক্ষা। ঢাকায় গঠিত বোর্ড হত্যার সম্ভাবনার কথা বলে। সেইসঙ্গে জননাঙ্গে বীর্যের উপস্থিতি দেখে মৃত্যুর আগে যৌন সঙ্গমের সম্ভাবনার বিষয়টিও উল্লেখ করে।
এরপর তদন্ত শেষে কোতোয়ালি থানার উপ-পরিদর্শক আবুল খায়ের শেখ দণ্ডবিধির সঙ্গে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন যুক্ত করে ফরিদপুরের আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। বিচারের জন্য তা গত বছরের নভেম্বরে আসে ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে।
মঙ্গলবার রায় পড়ার মাঝামাঝি এসে বিচারক দুটি ছবি আসামি পক্ষ, রাষ্ট্র পক্ষের আইনজীবীদের হাতে দিয়ে তা দেখতে বলেন।
ছবিতে একটি গাছের উপরের দিকের কাণ্ডে গায়ে হলুদের হলুদ শাড়ি ও লাল সায়া পরা অবস্থায় ঝুলন্ত চম্পাকে দেখিয়ে বিচারক রহমান সরদার বলেন, “আমরা যারা সক্ষম পুরুষ, আমাদের পক্ষেও লুঙ্গি-প্যান্ট পরিহিত অবস্থায় এ ধরনের মসৃণ-গোলাকার চম্বল গাছে উঠা সম্ভবপর নয়।
“নিহতের আত্মহত্যার জন্য একা একা শাড়ি-পেটিকোট পরে গাছে উঠার প্রশ্নই ওঠে না। কস্মিনকালেও তা সম্ভব নয়। নিহতের পেছনের দিক থেকে তোলা ছবিটিতে শাড়িটি যেভাবে ছেড়া দেখা যায়, তা কেবল ধ্বস্তাধ্বস্তির ফলেই সম্ভব।”
“তাই জ্ঞানপাপী চিকিৎসকগণ ভিকটিমের মৃত্যুটিকে ‘সুইসাইডাল হ্যাংগিং’ বলে মত দিলেও এটা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত যে ওই নাবালিকাকে চার আসামি উপর্যুপরি ধর্ষণের পর শ্বাসরোধে হত্যা করে কাপড়ের অন্যপ্রান্ত দিয়ে গাছে গিঁট দিয়ে তাকে ঝুলিয়ে রাখে,” বলেন বিচারক।
রায়ে আরও বলা হয়, লাশ উদ্ধারের পর পুলিশ তার সুরতহাল ঠিকমতো করেনি। মৃতদেহ ময়নাতদন্তে শরীরের যে সব আঘাত বা আলামত ছিল, তাও উল্লেখ করা হয়নি।
ছবি দুটি আইনজীবীদের দেখিয়ে বিচারক বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ ও তদন্ত কর্মকর্তা এ গাছটিকে মেহগনি গাছ বলেছিলেন সাক্ষ্য দেওয়ার সময়। আসলে এটি চাম্বল গাছ।
“তদন্ত কর্মকর্তা এই দুই ছবি জব্দ করেননি এবং বিচারকালে সাক্ষ্য দেওয়ার সময় তার উল্লেখ করেননি। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরাও তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেননি,” বলেন বিচারক।
মামলাটি রাষ্ট্রপক্ষে পরিচালনা করেন এ ট্রাইব্যুনালের বিশেষ কৌঁসুলি মাহফুজুর রহমান লিখন।
বিচারের শুরুতে সাক্ষীদের ট্রাইব্যুনালে হাজির করার ক্ষেত্রেও গড়িমসির বিষয়টি উল্লেখ করেছে আদালত।
“এ মামলার রুজু হওয়ার পর থেকে আসামি পক্ষে যেন এক অদৃশ্য শক্তি কাজ করেছে। ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক আবুল হোসেন আসামিপক্ষ দিয়ে ম্যানেজড হয়ে অনৈতিকভাবে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছেন, যা প্রমাণিত।”
১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়া আসামি বাবুল হোসেন এবং আকাশ মণ্ডল শাস্তির বিষয়টি টের পেয়ে কারও কুপরামর্শে পলাতক রয়েছেন বলে বিচারক মন্তব্য করেন। তবে কুপরামর্শ কে দিয়েছে, তা উল্লেখ করেননি তিনি।
বাবুল (২২) ও আকাশের (২৪) সঙ্গে শামীম মণ্ডল (২১) ও জাহিদুল হাসান ওরফে জাহিদ সর্দারকে (২৪) মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে হত্যার রায়ে। শামীম ও জাহিদ রায়ের সময় এজলাসে ছিলেন।
মামলায় বলা হয়, আসামি শামীম প্রেমের প্রস্তাবে ব্যর্থ হয়ে চম্পাকে নানাভাবে উত্ত্যক্ত করে আসছিল। চম্পার চাচাত বোন পপির গায়ে হলুদ অনুষ্ঠান ছিল সেদিন। সেখান থেকে চম্পাকে ডেকে ঘরের বাইরে আনার পর জোর করে ধরে নেওয়া হয়।
এছাড়া নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়া প্রত্যেককে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং এক লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে।
শামীম ও বাবুলের আইনজীবীরা বলেছেন, এ রায়ের বিরুদ্ধে হাই কোর্টে যাবেন তারা।
জাহিদ হাসানের আইনজীবী শরীফুল ইসলাম এই দুটি ছবি প্রদর্শনের প্রতিক্রিয়ায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিচারক আবেগতাড়িত হয়ে এই ছবি দুটি আমাদেরকে দেখান। এ ছবি তো আলামত হিসাবে প্রদর্শন করা হয়নি, প্রদর্শনী নম্বর দিয়ে তা নথিকে যুক্ত করা হয়নি। তাই এ ছবির কোনো সাক্ষ্যগত মূল্য নেই।”
এই ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের মামলায় ৩০ জন সাক্ষ্য দিলেও কোনো চাক্ষুস সাক্ষী ছিল না উল্লেখ করেই বিচারক বলেছেন, ছিল পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য এবং বাবুল হোসেনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি।
১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বাবুল হোসেন স্বীকার করেন, ধর্ষণের পর চম্পা যখন ঘটনাটি বলে দেবে বলে জানায়, তখন তারা চারজন চম্পাকে কাপড়ের গিঁট দিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করে।
“আসামিরা চারজন একজোট হয়ে ঠাণ্ডা মাথায় ভিকটিম চম্পাকে ধর্ষণ এবং পরে হত্যা করে। ঘটনাটি খুবই নির্মম, নির্দয়, নৃশংস ও অগ্রহণযোগ্য। ফলে এ ধরনের মামলায় আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দিলে এ জাতীয় অভিশাপ থেকে সমাজ ও জাতিকে মুক্তি দেওয়া সম্ভব নয়। ... কোনোমতেই আসামিদের অনুকম্পা দেখানো সম্ভব নয়,” সর্বোচ্চ সাজা দেওয়ার মামলার রায়ে বলেন বিচারক।