দেখা গেছে, ১৯৬০ সালের তুলনায় ২০২২ সালে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঘটনা দ্বিগুণ বেড়েছে। এই সময়ে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত আর্থিক ক্ষতি বেড়েছে চারগুণ।
Published : 19 Feb 2025, 12:55 AM
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে উদ্বাস্তু সংকট যে দিন দিন বাড়ছে, সেই বাস্তবতা উঠে এসেছে এক আন্তর্জাতিক গবেষণায়।
ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউ ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট এর গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই উদ্বাস্তু পরিস্থিতির শেষ পরিণতি হচ্ছে আধুনিক দাসত্ব।
মঙ্গলবার এক ওয়েবিনারের মাধ্যমে গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। জলবায়ু পরিবর্তন, উদ্বাস্তু সমস্যা ও আধুনিক দাসত্ব সৃষ্টির আন্তসংযোগ উদঘাটনের দিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে সেখানে।
এতে দেখানো হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাংলাদেশের মত নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড় এবং লবণাক্ততার মত প্রকৃতিক দুর্যোগ কীভাবে বাড়ছে।
তাতে জনজীবনের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। দুর্বল আর্থিক সক্ষমতার পরিবারগুলোকে এসব দুর্যোগ এতটাই বিপদে ফেলছে যে তারা দেশের ভেতরে অন্য কোথাও বা দেশের বাইরে উদ্বাস্তু জীবনে যেতে বাধ্য হচ্ছে।
বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত জেলা হিসাবে সিলেট ও পিরোজপুরকে বেছে নেওয়া হয়েছে এ গবেষণার জন্য।
দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রকৃতিক দুর্যোগের কারণে প্রান্তিক পরিবারগুলো, বিশেষ করে নারী প্রধান পরিবার ও ছোট কৃষি নির্ভর পরিবারগুলো গ্রাম থেকে শহরে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে। কিংবা পরিবারের কোনো সদস্য পাড়ি জমাচ্ছেন আরবের কোনো দেশে।
এই ধরনের স্থানান্তর তাদের সমস্যার সমাধান করতে পারছে খুব কমই। উল্টো তারা নিবর্তনমূলক শ্রমজীবন ও দুর্দশাগ্রস্ত জীবনের মুখোমুখি হয়ে নতুন ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে।
দেখা গেছে, ১৯৬০ সালের তুলনায় ২০২২ সালে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঘটনা দ্বিগুণ বেড়েছে। আগে যেখানে বছরে সর্বোচ্চ চারটি ঝড় জলোচ্ছ্বাস দেখা দিত, এখন হচ্ছে সাতটি।
এই সময়ে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত আর্থিক ক্ষতিও চারগুণ বেড়েছে। ১৯৬০ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত যেখানে বছরে ১৪৫ মিলিয়ন ডলার ক্ষতি হিসাব করা হচ্ছে, সেখানে ১৯৯১ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বছরে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে গড়ে ৫৫৭ মিলিয়ন ডলার।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সিলেট ও পিরোজপুরের মানুষ যে নানা ধরনের ভোগান্তির শিকার হচ্ছে, সে বাস্তবতাও উঠে এসেছে এ গবেষণায়।
গবেষকদের হিসাবে পিরোজপুরে দুর্যোগের কারণে খানাপ্রতি বছরে ৮৭৩ ডলার বা এক লাখ ৩৮৫ টাকার ক্ষতি হয়। সিলেটে ক্ষতি হয় ৭৩৫ ডলার বা ৮৪ হাজার ৫০৬ টাকা।
কৃষি ও মৎস্য খাতে ক্ষতি হয় সবচেয়ে বেশি। ৫২ শতাংশ পরিবারে লবণাক্ততা, অতিবৃষ্টি ও বন্যার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ৬৬ শতাংশ পরিবার জানাচ্ছে, লবণাক্ততা, পানির উষ্ণতার কারণে খাদ্য নিরাপত্তা ও উপার্যন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ৪২ শতাংশ পরিবার ফসলের হানি, ৪৮ শতাংশ পরিবার গবাদিপশুর ক্ষতিসহ বিভিন্ন ক্ষতির তথ্য দিয়েছে।
জলবায়ু উদ্বাস্তু কতটা বাড়ছে
২০১১ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে এসব এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত ৮৪ শতাংশ পরিবার অভ্যন্তরীণ স্থানান্তর বা ইন্টারনাল মাইগ্রেশনের শিকার হয়েছে। তারা ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনার দিকে স্থানান্তরিত হয়ে নির্মাণ শ্রমিক বা পোশাক শ্রমিকের পেশা নিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করেছে।
এই সময়ের মধ্যে আন্তর্জাতিক মাইগ্রেশন বা দেশান্তরিত হওয়ার ঘটনাও বেড়েছে। ২০১১ সাল থেকে ৮৮ শতাংশ খানায় বিদেশ গমনের ঘটনা ঘটেছে। তারা বিশেষত উপসাগরীয় দেশগুলোতে গেছেন। সেখানে যারা গেছে, তাদের অধিকাংশ নির্মাণ শ্রমিকের কাজ নিয়েছেন।
পিরোজপুর থেকে বিদেশ যেতে গড়ে চার লাখ ৬১ হাজার টাকা লেগেছে। জমি বেচে কিংবা সুদে টাকা ধার নিয়ে তারা ওই অর্থ জোগাড় করেছেন।
‘আধুনিক দাস’
জলবায়ু উদ্বাস্তুদের মধ্যে যারা জীবিকার জন্য দেশ-বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের জুটেছে আধুনিক দাসত্বের জীবন। বেতন বিলম্বিত হওয়া, মজুরি না পাওয়া, চলাফেরায় নিয়ন্ত্রণ কিংবা হুমকি-নির্যাতনের মত পরিস্থিতিতে তাদের পড়তে হয়েছে।
গবেষকরা বলছেন, অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের মধ্যে ৯২ শতাংশ মানুষ ওই দুর্দশাগুলোর মধ্যে অন্তত একটির শিকার হয়েছেন, ৫২ শতাংশ মানুষের ক্ষেত্রে দুই থেকে তিনটি ঘটনাও ঘটছে।
আন্তর্জাতিক উদ্বাস্তুদের ক্ষেত্রে আধুনিক দাসত্বের বিষয়টি আরও মারাত্মকভাবে ঘটছে। ৯৯ শতাংশ মানুষ অন্তত একটি ঘটনার শিকার হয়েছেন, ৮১ শতাংশ মানুষ পাঁচ ধরনের নিপীড়নের শিকার হওয়ার কথা বলেছেন।
সমাধান কী?
এই বাস্তবতার প্রধান কারণগুলো চিহ্নিত করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে গবেষণা প্রতিবেদনে। জলবায়ু সহনশীল অবকাঠামো নির্মাণের কথাও বলা হয়েছে। সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ, লবণাক্ততা সহিষ্ণু ফসল উদ্ভাবন এবং সেচ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষতি থেকে বাঁচতে আগাম সতর্কবার্তা প্রচার জোরদার করতে হবে। এলাকাভিত্তিক দুর্যোগ মোকাবেলা কর্মসূচিও হাতে নিতে হবে। এই ধরনের পদক্ষেপ জনপদগুলোতে দুর্যোগ মোকাবেলা সক্ষমতা বাড়াবে।
এছাড়া প্রান্তিক অঞ্চলে আয় উপার্জনের বহুমুখী ব্যবস্থা চালু করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। সেজন্য শহরাঞ্চলে দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচি হাতে নেওয়া যেতে পারে।
শ্রম আইন শক্তিশালী করার মাধ্যমে নিপীড়নের সুযোগ কমিয়ে আনা এবং সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতা বৃদ্ধি করার পরামর্শও দেওয়া হয়েছে গবেষণা প্রতিবেদনে।
ওয়েবিনারে গবেষণা প্রতিবেদনের ওপর বক্তব্য দেন অ্যান্টি স্লেভারি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিনিধি ক্লোয়ে ক্র্যানস্টন ও আইআইইডির পরিচালক ঋতু ভারদাজ।
এছাড়া আলোচক হিসাবে ছিলেন অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রামের চেয়ার শাকিরুল ইসলাম, লিস্ট ডেভেলপমেন্ট কান্ট্রিজ গ্রুপের হাফিজ খান, ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেইঞ্জ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক সাকিব হক, ফ্রেন্ডশিপ এনজিও’র জ্যেষ্ঠ পরিচালক কাজী আহমেদুল হক।