দেয়ালচিত্রে বাঙময় সাম্প্রদায়িকাতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ডাক, দুর্নীতি অনিয়ম বন্ধ করা এবং বাকস্বাধীনতা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় অগ্নিঝরা স্লোগান।
Published : 14 Aug 2024, 09:28 AM
বছর সাতেক আগে আলোড়ন তুলেছিল ঢাকার বিভিন্ন দেয়ালে আঁকা গ্রাফিতি ‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা’। এবার সরকারবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সেই সুবোধকে কেবল ফিরিয়েই আনা হয়নি, তাকে আজীবন এই বাংলায় থেকে যাওয়ার আকুতি জানিয়েছে তরুণ প্রজন্ম।
রাজধানীর শেওড়াপাড়া মেট্রো স্টেশনের পাশেই একটি পিলারে সেদিন একদল শিক্ষার্থী লিখছিলেন– ‘সুবোদ তুই আর পালাস না’। পাশ থেকে আরেক শিক্ষার্থী বললেন, “বানানটা ঠিক করে দে।”
পরে বানান ঠিক করে লেখা হল– ‘সুবোধ তুই আর পালাস না/থেকে যা আজীবন’।
পাশেই আরেকটি দেয়ালে লেখা, ‘ধর্ম যার যার/দেশ সবার’।
একটু দূরে আরেকটি পিলারে ছবি আঁকছিল প্রিয়ন্তি, আলভিনা, তাবাসসুম, নুসাইবারা। তারা সবাই মিরপুরের মণিপুর স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। গ্রাফিতির সঙ্গে তারা আঁকছিল দেশের পতাকা।
এই ক্ষুদে আঁকিয়ে দলের সদস্য আলভিনা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বললো, “এই যে এত মানুষ মারা গেছে, তাদের স্মরণে আমরা ছবি আঁকছি।”
কী ছবি আঁকা হচ্ছে? আলভিনার উত্তর, “আমরা বাংলাদেশের মানচিত্রের ভেতরে লাল-সবুজের পতাকা আঁকছি। সেই পতাকার মধ্যে লাল গড়িয়ে পড়ছে। সেগুলো মানুষের রক্ত।”
পাশ থেকে প্রিয়ন্তি বললো, “মুক্তিযুদ্ধে তো অনেক মানুষ মারা গেছে। যারা দেশের জন্য মারা গেছে, আমরা সবার স্মরণে ছবি আঁকতেছি।”
শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয় আঁকা দেখছিলেন তরুণ কবি ও নাট্যকার অপু মেহেদী। ওই এলাকাতেই তিনি থাকেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে অপু বলেন, “কাজীপাড়া মেট্রো স্টেশন থেকে শেওড়াপাড়া স্টেশন পর্যন্ত পিলারগুলোর দিকে তাকালেই বোঝা যাবে, এই প্রজন্ম কতটা বিচিত্র চিন্তার, কতটা অসাম্প্রদায়িক চিন্তার। তারা কীভাবে সময়কে ধারণ করে।”
কেবল শেওরাপাড়া বা কাজীপাড়া নয়, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার টিএসসি, ফুলাররোডসহ শহরের বিভিন্ন এলাকার দেয়ালে এখন শোভা পাচ্ছে অসংখ্য গ্রাফিতি, দেয়ালচিত্র আর প্রতিবাদী স্লোগান।
তাতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে প্রতিবাদ, দেশপ্রেম আর সাম্যের বার্তা। বাঙময় হয়েছে সাম্প্রদায়িকাতার বিরুদ্ধের রুখে দাঁড়ানোর ডাক, সমাজ সংস্কারের বার্তা, দুর্নীতি ও অনিয়ম বন্ধ করে বাকস্বাধীনতা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার অগ্নিঝরা পংক্তি।
ছাত্র আন্দোলনে প্রাণ দেওয়া আবু সাঈদ, মুগ্ধদের প্রতিকৃতি আকা হয়েছে অনেক দেয়ালে, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে কালজয়ী সব কবিতা আর গানের বাণীতে।
দেশের বিভিন্ন জেলাতেও ছড়িয়ে পড়েছে ছবি আঁকার এই উন্মাদনা। তারুণ্যের এইসব প্রতিবাদী ভাবনা কেবল দেয়ালে আটকে থাকছে না, আলোকচিত্র হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে অন্তর্জালে।
আলভিনা, তাবাসসুমরা জানালো, তারা নিজেরাই টাকা জোগাড় করে রং আর আঁকার সরঞ্জাম কিনেছে। পুরনো অপরিচ্ছন্ন দেয়ালগুলো পরিষ্কার করছে নিজে হাতে।
বাবা-মা বিষয়টা কেমনভাবে দেখছেন? আলভিনা বললো, “আমাদের কারোরই বাসা থেকে কোনো বাধা দেওয়া হয়নি। মা-বাবা বলেছেন, তোমরা যাও, কাজগুলো করো।”
ঢাকার কাজীপাড়া স্টেশন থেকে ফার্মগেইট পর্যন্ত ঘুরলে মনে হবে পুরো এলাকা হয়ে ওঠেছে ছবি আঁকার ক্যানভাস। সবচেয়ে বেশি ছবি আঁকা হয়েছে কাজীপাড়া থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত। ওই এলাকায় পাড়া মহল্লার ভেতরেও কোনো কোনো বাড়ির দেয়ালে দেখা যাচ্ছে চিত্রকর্ম আর স্লোগান।
কোথাও লেখা, ‘নতুন বাংলাদেশ’। আরেক জায়গায় লেখা ‘আমরা করবো জয়’।
‘পানি লাগবো পানি’, ‘স্টপ কিলিং’– এমন নানা কথায়, স্লোগানে অন্য রূপ পেয়েছে মেট্রোরেলের পিলারগুলো।
আশপাশের বিভিন্ন দেয়ালেও আঁকা হয়েছে ছবি। কোথাও পাখি উড়ে যাওয়ার দৃশ্যে মুক্তির আনন্দ; কোথাও বিশুদ্ধ রাজনৈতিক স্লোগানে অর্গল ভাঙার গান।
দ্রোহ, মুক্তির এসব চিত্রকর্ম দেখে এই প্রজন্মের রাজনৈতিক ভাবনা বোঝার তাগিদ এসেছে মানুষের কাছ থেকে।
দক্ষিণ মণিপুরে থাকেন তরুণ চিত্রশিল্পী শাহনাজ জাহান। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এ প্রজন্ম রাজনীতিবিমুখ, এ প্রজন্ম দেশ নিয়ে ভাবে না– এমন নানাকিছু আমরা বলি। কিন্তু তারা যে কতটা রাজনীতি সচেতন, তা তো এই ছাত্র আন্দোলন প্রমাণ করেছে। আর এ প্রজন্ম কী ভাবছে, কী চিন্তা করছে তা এখন দেয়ালে দেয়ালে লিখে যাচ্ছে।
“যারা সরকার পরিচালনায় যুক্ত, তাদের উচিত দেয়াল লিখনের ভাষা এবং বার্তাটা বোঝার চেষ্টা করা। এ প্রজন্ম সর্বপ্রাণের অধিকার নিয়েও ছবি আঁকছে। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার ছবি এঁকেছে। এ প্রজন্ম ভীষণ রাজনীতি সচেতন। দেশপ্রেম নিয়েই তারা বেড়ে উঠছে। তাদের কথা বলতে দিতে হবে, ছবি আঁকতে দিতে হবে। শিল্প-সংস্কৃতির চর্চা করতে দিতে হবে।”
ধানমন্ডি থেকে প্রজ্ঞা পারমিতা তার ফেইসবুকে একটি ছবি শেয়ার করেছেন, সেখানে লেখা - ‘এই শহর হোক সকল প্রাণের’।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষক রশীদ আমিন মনে করছেন, এবারের ছাত্র জনতার আন্দোলন দেশের চারুকলার জন্য একটি বড় জাগরণও বটে। তার মনে হয়েছে, স্কুল-কলেজে চারুকলা বিষয় অন্তর্ভুক্ত করার একটি প্রভাব এখানে দেখা যাচ্ছে।
রশীদ আমীন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এর আগে ‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা’ নামে একটি গ্রাফিতি ছড়িয়েছিল। সেই গ্রাফিতি কে এঁকেছিল, তা কিন্তু জানি না। কিন্তু সেই ছবিটি মানুষের ভেতরে নাড়া দিয়েছিল। এ প্রজন্ম কিন্তু আঁকছে ‘সুবোধ তুই ফিরে আয়’। প্রজন্মের এই ভাষাটা আমাদের বুঝতে হবে।”
এসব আঁকিবুকি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশেরই ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে মনে করেন রশীদ আমিন।
তিনি বলেন, “চারুকলার বিরুদ্ধে একটা গোষ্ঠী বিভিন্ন সময় নানা রকম প্রপাগান্ডা চালিয়েছে। ছবি আঁকা যাবে না। অথচ এই প্রজন্ম দেয়ালে দেয়ালে ছবি এঁকে তার বিরুদ্ধে কী বার্তা দিচ্ছে, তাও বুঝতে হবে।”
গ্রাফিতি আঁকার এই জোয়ার দেখে মুক্তমনা বাংলাদেশ গড়ে ওঠার আশাবাদ জানিয়ে রশীদ আমিন বলেন, “যারা এই দেশে সাম্প্রদায়িক বানাতে চায়, তা সম্ভব হবে না। কারণ এ প্রজন্মের ভাষাটা কিন্তু দেয়ালে দেয়ালে লিখে দিয়েছে। এই দেশ সর্বপ্রাণের, সকল মানুষের- তারা সেই বার্তা দিয়েছে।”