বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৃষ্টির পূর্বাভাসকে কাজে লাগিয়ে পাহাড় ধসের ঘটনা থেকে জানমালের ক্ষতি কমানো বা এড়ানো সম্ভব।
Published : 27 Oct 2022, 12:15 AM
বছর পাঁচেক আগে পার্বত্য অঞ্চলে একদিনেই যে বৃষ্টিপাত হয়েছিল তা অর্ধশতাব্দীর রেকর্ড ভেঙে দেয়; সেসময় টানা তিন দিনের বৃষ্টিতে ভূমি ধসে প্রাণ যায় ১৬০ জনের; তার আগে ২০০৭ সালে চট্টগ্রামে এ দুর্যোগে মারা যান ১২৭ জন।
বড় এ দুটি ঘটনা ছাড়াও প্রতি বছরই বর্ষা মওসুমে পাহাড়ে ভূমি ধসে প্রাণহানি ঘটছে। এ বছরও জুনের বৃষ্টিতে ভূমি ধসে চারজনের মৃত্যুর খবর আসে।
ঘূর্ণিঝড়, বন্যা আর ভারি বর্ষণের আগাম সতর্কবার্তা থাকলেও ভূমি ধসের কোনো পূর্বাভাস না পেয়ে প্রতিবছর প্রাণ যাচ্ছে অনেকের। কয়েকটি আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান বলছে, এক্ষেত্রে বৃষ্টির পূর্বাভাসকে কাজে লাগিয়ে পাহাড় ধসের ঘটনা থেকে জানমালের ক্ষতি কমানো বা এড়ানো সম্ভব।
এজন্য ১০ দিনের বৃষ্টিপাতের আগাম পূর্বাভাস ধরে পাহাড় ধসের সতর্ক বার্তা বা মডেল তৈরি করেছেন তারা। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার বাসিন্দা, কমিউনিটি স্বেচ্ছাসেবী, জনপ্রতিনিধিসহ সবাই সচেতন হলে এই দুর্যোগে ক্ষতি কমানো সম্ভব বলে সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিরা মনে করছেন।
কী আছে মডেলে
ইউনাইটেড স্টেটস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টের (ইউএসএআইডি) অর্থায়নে ক্যাথলিক রিলিফ সার্ভিসের (সিআরএস) কারিগরি সহায়তায় স্থানীয় উন্নয়ন সংস্থা তাজিংডং ও বিএনকেএস-এর মাধ্যমে কারিতাস বাংলাদেশ চলতি বছর বান্দরবান সদর ও লামা উপজেলায় দুটি ইউনিয়নের ঝুঁকিপূর্ণ ছয়টি জায়গায় ‘সক্ষমতা’ নামে প্রকল্প হাতে নিয়েছে।
ওই প্রকল্পের আওতায় ফোরওয়ার্ন বাংলাদেশের কারিগরি সহায়তা ও স্থানীয় প্রশাসনের সমন্বয়ে সংশ্লিষ্টদের পূর্বাভাস বিষয়ের জ্ঞান কাজে লাগিয়ে এই পরীক্ষামূলক মডেল তৈরি করা হয়েছে।
সেখানে বলা হয়েছে, একদিনে ১০০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টি হলে; তিন দিনে ২৫০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টি হলে; সাত দিন ধরে একটানা বৃষ্টির পরিমাণ ৩৫০ মিলিমিটারের বেশি হলে পাহাড় ধস হতে পারে।
বৃষ্টির পূর্বাভাসকে ভিত্তি ধরে পাহাড় ধসের বিষয়ে রঙভিত্তিক একটি সতর্ক সংকেতের প্রস্তাব করা হয়েছে এই মডেলে।
নীল, হলুদ ও লাল সংকেত
প্রথম সতর্ক বার্তা (নীল): বার্তা পাওয়ার প্রথম দিন। এই সংকেত অনুযায়ী পরপর তিন দিন পূর্বাভাস অনুযায়ী বৃষ্টি হলে পাহাড়ে ধসের শঙ্কা বাড়বে।
দ্বিতীয় সতর্ক বার্তা (হলুদ): বার্তা পাওয়ার চতুর্থ দিন। ঝুঁকিপূর্ণ জায়গা ছেড়ে নিরাপদে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে হবে। আরও দুদিন পূর্বাভাস অনুযায়ী বৃষ্টি হলে ধস শুরু হবে।
তৃতীয় সতর্ক বার্তা (লাল): বার্তা পাওয়ার ষষ্ঠ দিন। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ছেড়ে চলে যেতে হবে।
সোমবার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরে একটি কর্মশালায় ভূমি ধসের আগাম সতর্ক ব্যবস্থার এই মডেল জাতীয় পর্যায়ে উপস্থাপনের জন্য অংশীজনদের মতামত নেওয়া হয়।
ফোরওয়ার্ন বাংলাদেশের কো-অর্ডিনেটর আশরাফুল হক বলেন, “এখন আমরা দেখছি-আবহাওয়া পরিস্থিতির ১০ দিনের ফোরকাস্ট পাওয়া সম্ভব। আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে জেলা-উপজেলা পর্যায়ের এমন পূর্বাভাস দেওয়া হয়। ১০ দিনের ফোরকাস্ট করে কমিউনিটির সঙ্গে শেয়ার করছি ওই এলাকার জন্যে।
“টানা দুই তিন দিন ধরে বৃষ্টিপাত হলে তখন তারা মাইকিং শুনতে পেত… এখন যারা আগে থেকে জানে, কোন কোন জায়গা ঝুঁকিতে, কবে কবে বৃষ্টিপাত হবে এবং কী পরিমাণ হতে পারে, বৃষ্টি হলে কী ধরনের কাজ করতে হতে পারে- এ বিষয়গুলো আগে ছিল না।”
আশরাফুল বলেন, পূর্বাভাসের সঙ্গে সতর্ক সংকেতগুলো সবার মাঝে পরিচিত করার চেষ্টা করছেন তারা। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ বিভিন্ন ব্যক্তিদের নিয়ে কমিউনিটি স্বেচ্ছাসেবী গ্রুপ করেছেন। ফেইসবুক ব্যবহারকারীদের নিয়ে গ্রুপ করেও তথ্য শেয়ার করছেন।
“এটা খুব সহজ কাজ, মডেলটা কঠিন কিছু না। সহজ কাজটাই করতে পারলে জানমালের ক্ষতি কমানো সম্ভব।”
তাদের কাজের প্রক্রিয়া হল–
>> সক্ষমতা প্রকল্পে বৃষ্টির আগাম পূর্বাভাস দিয়ে ভূমি ধসের আগাম সতর্ক বার্তা প্রচার করা হবে।
>> কমিউনিটি স্বেচ্ছাসেবীদের ৬০ জনকে ঝুকিপূর্ণ ছয়টি জায়গায় সম্পৃক্ত করা হবে।
>> আগামী নয় দিনে কবে কী পরিমাণ বৃষ্টি হতে পারে, তা স্বেচ্ছাসেবীরা জানাবে।
কীভাবে কাজ করবে
ফোরওয়ার্ন বাংলাদেশের কো-অর্ডিনেটর আশরাফুল বলেন, ১০ দিন আগে পূর্বাভাস দেওয়া হলে বৃষ্টি শুরুর পর ঝুঁকি অনুধাবন করে প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য আট-নয়দিন সময় পাবেন।
“আমরা মডেলের বিষয়ে সিম্পল জায়গা থেকে কথা বলছি। এ ফোরকাস্টিংটা (পূর্বাভাস) রিজিওনাল লেভেলে এখন দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। সেটাকে এরিয়া ধরে ফোরকাস্টিংয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, সে অঞ্চলের অধিবাসীরা যদি দেখে, রেইনফল কতটুকু হচ্ছে, ফোরকাস্ট কেমন হচ্ছে ও অনকাস্ট কেমন হচ্ছে- তখন তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়বে পূর্বাভাসের বিষয়ে।”
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট এলাকায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ মাপতে ছয়টি ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে রেইন গজ বসানোর কথা জানান এই কর্মকর্তা।
“এ সব রেইনগজ থেকে স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীরা বৃষ্টিপাতের পরিমাণ মেপে নির্ধারিত ফেইসবুক গ্রুপে প্রকাশ করবেন। ডেটা নিয়ে পর্যবেক্ষণ করে বৃষ্টির পূর্বাভাস নিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় আগাম সতর্কবার্তা প্রচার ও মানুষকে নিরাপদস্থানে সরিয়ে নেওয়া হবে।”
আশরাফুল বলেন, প্রকল্পের এ মডেল ছোট কমিউনিটির জন্যে করা হচ্ছে। কী প্রস্তুতি নিতে হবে, কোন কোন কাজ করতে হবে, সরকারি-বেসরকারি সংস্থা, কারবারি যারা আছেন, কে কোন দায়িত্ব পালন করবেন… মানুষ যাতে ঝুঁকিপূর্ণ জায়গা থেকে নিরাপদে সরে যেতে পারে, এ বিষয়গুলো দেখার চেষ্টা করা হয়েছে।
‘বিশ্বাসের জায়গা তৈরি করতে হবে’
সিআরএস কান্ট্রি ম্যানেজার স্নিগ্ধা চক্রবর্তী বলেন, “বাংলাদেশে ল্যান্ডস্লাইড আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেমটা এখনও সেভাবে তৈরি হয়নি। অত্যন্ত কঠিন কাজ এটা। এর সাথে জিওমরফলজিক্যাল ডেটা, প্রচুর সায়েন্টিফিক রিচার্স দরকার; যা সময় সাপেক্ষ।
“অনেক স্টেকহোল্ডারকে এনগেজ করে কাজটা করা দরকার। ঝুকিপূর্ণ এসব এলাকা ভূমিধসের অনুকূল ও পরিবেশগত বিষয় তো রয়েছে। সে হিসেবে দেশের ভূমিধসের জন্য আগাম সতর্কীকরণ ব্যবস্থাটা গবেষণার পর্যায়ে রয়েছে।”
ভূমি ধসের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর ইতোমধ্যে সম্পৃক্ত হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “সরকারের পরিকল্পনা তো রয়েছে, সরকারকে সহায়তাও করা হবে। সরকারের সাধারণত আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম অত্যন্ত সাকসেসফুল একটা কাজ। ভূমিধস তো দেশের সব জায়গায় হয় না। তাই এ কার্যক্রমটা এখনও হয়নি।
“আমরা এ পদক্ষেপটা দুটো জায়গায় পাইলট করে দেখেছি। আশা করি, একটা কিছু দাঁড় করাতে পারব সরকারের সঙ্গে কাজ করে।”
প্রান্তির এলাকায় তথ্য পৌঁছানো ও সচেতনতার চ্যালেঞ্জ তুলে ধরে স্নিগ্ধা বলেন, “কীভাবে মেসেজ দেবে, সচেতনা তৈরি করে দিয়েছি। আমাদের মূল উদ্দেশ্য-রিচিং টু দ্য লাস্ট মাইল। সে হিসেবে কাজ করছি। লাস্ট মাইলে পৌছানোর জন্যে প্রথম ধাপে কমিউনিটি ভলান্টিয়ার রয়েছে; হাতে-কলমে শিখিয়ে দেওয়া, তাদের ভাষা ও বাংলাসহ তিন ভাষায় বোঝানো, বাড়িতে জানানো কী করবেন…।”
এই লক্ষ্য ধরে এগিয়ে যেতে কমিউনিটির স্বেচ্ছাসেবীদের ‘প্রথম পিলার’ হিসেবে বর্ণনা করে সিআরএসের প্রতিনিধি বলেন, “ট্র্যাডিশনাল পদ্ধতি ও তাদের ধর্মীয় নেতাদের মাধ্যমে সবাইকে এ বিষয়ে জানাতে হবে, যাতে দ্রুত বিশ্বাসের জায়গা তৈরি হয়। প্রশাসন সব সময় সাহায্য করবে। সবার সমন্বয়ে কাজটা করতে হবে।
“তথ্য থাকাটা কঠিন নয়। কিন্তু অত্যন্ত দুর্গম এলাকা বলেই কঠিন। ওই এলাকায় যেতে হলে হেঁটে যেতে হয়। ডেটা কালেকশন করবে যারা, তারা কতটা তৈরি আছে, মোবাইল নেটওয়ার্ক এখন হয়ে গেলেও সব মিলিয়ে এসব কাজ করাটা একটা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। কমিউনিটি ভলান্টিয়ার্স যারা তৈরি হয়েছে, এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটিতে যারা আছেন, প্রকল্পের অভিজ্ঞতা থেকে বলব, এখন এটা আর ইম্পসিবল নয়।”
‘সুফল পাবে পাহাড়িরা’
কারিতাস বাংলাদেশের হেড অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট আলেকজান্ডার ত্রিপুরা জানান, ২০০৭ থেকে ভূমি ধস ব্যাপকভাবে দেখা যাচ্ছে। সবশেষ ২০১৭ সালে বেশ প্রাণহানি হয়েছে। সবাই মানছে- এ নিয়ে পূর্বাভাস দিতে পারলে বেশ কাজ দেবে।
প্রকল্প শেষ হলে স্থানীয়রা এর সুফল পাবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “স্থানীয়রা জানে কোথায় বসবাস করতে হবে, কোথায় ধস হতে পারে, সে ধারণা রয়েছে। ভূমি ধসের আগে যেন জানতে পারে সে ব্যবস্থা রয়েছে। ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবীরা রয়েছে, অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান রয়েছে; ওইসব এলাকায় যন্ত্রপাতি, রেইনগেজ, ইউনিয়ন কেন্দ্রে প্রিন্টার রয়েছে।
“মডেলটা বলা হচ্ছে, রিস্ক নলেজ এনালাইসিস হয়েছে, নলেজ গ্যাদার করেছে, জনগণকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। তাদেরকে এখন সচেতন করা, মনিটরিং করা এবং শুধু জানলে হবে না, আত্মস্থ করাতে হবে।”
জাতীয় নীতিমালার সুপারিশ
পরীক্ষামূলকভাবে বানানো মডেলটি নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে অচিরেই নীতিমালা করার কথা উঠে এসেছে কর্মশালায়। সেখানে একটি প্রেজেন্টেশন ও ডকুমেন্টারির মাধ্যমে ‘ল্যান্ডস্লাইড আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম’ নামে চার স্তরের পদ্ধতির বিস্তারিত তুলে ধরা হয়।
প্রথম স্তরে বিপর্যয় ঝুঁকি নির্ণয়, দ্বিতীয় স্তরে পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ ও পুর্বাভাস এবং তৃতীয় স্তরে সাবধানবাণী প্রচার ও যোগাযোগ এবং চতুর্থ স্তরে প্রস্তুতির কথা বলা হয়েছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আতিকুল হক ও পরিচালক (এমআইএম) নিতাই চন্দ্র দে সরকার কর্মশালায় উপস্থিত ছিলেন। ভূমি ধসের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট দুটি ইউনিয়নকে মডেল ইউনিয়ন করার আশ্বাস দেন মহাপরিচালক।
আরও খবর
পাহাড় ধস: জাতীয় কমিটির পরিদর্শনই শেষ হয়নি
পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি ঠেকাতে ‘প্রভাবশালী’ নিয়ন্ত্রণের মত