বর্ষায় ‘তোড়জোড়ে’ পাহাড় ধস কি থামবে?

কেবল বর্ষা মৌসুমের ‘তোড়জোড়ে’ চট্টগ্রামে পাহাড় ধস আর  প্রাণহানি ঠেকানো যাচ্ছে না। পাহাড় রক্ষা ও ঝূঁকিপূর্ণ বসতি স্থাপনকারীদের পুনর্বাসনে সরকারি সংস্থাগুলার সমন্বয়হীনতায় এ সংকট আরও বেড়েছে।

মিঠুন চৌধুরীমিঠুন চৌধুরী চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 June 2022, 02:32 PM
Updated : 18 June 2022, 02:53 PM

জেলা প্রশাসনের হিসেবে বন্দর নগরী ও আশেপাশের এলাকায় ২৭টি পাহাড়ের পাদদেশে বসতি আছে। এর মধ্যে ৩৮৫টি স্থাপনাকে এবার অতি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত হয়েছে।

এর মধ্যেই শুক্রবার মধ্যরাতে আকবর শাহ থানার বরিশাল ঘোনা ১ নম্বর ঝিল পাড় এলাকায় পাহাড় ধসে দুই বোন নিহত হন। আহত হন তাদের মা-বাবা। এছাড়া বিজয় নগর এলাকায় পাহাড় ধসে নিহত হন আরও দুইজন।

শনিবার ১ নম্বর ঝিল পাড় এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, পাহাড় ধসে যে সেমিপাকা ঘরটি ভেঙে প্রাণহানি হয়েছে সেটি একেবারে পাহাড়ের খাড়া ঢাল ঘেঁষে। এর আশেপাশের এলাকায় পাহাড়ে আরও শতাধিক ঘর আছে।

আর বিজয় নগরের পাহাড়ের একেবারের উপরের অংশটি ধসে পড়েছে। ভেঙে পড়া ঘরটি ছিল চূড়ার কাছাকাছি।

সর্বশেষ এই ঘটনার পর সিটি করপোরেশন ও স্থানীয় প্রশাসন বলছে, বারবার বলার পরও পাহাড়ের পাদদেশে থাকা ঝুঁকিপূর্ণ বসতি স্থাপনকারীরা ভারি বৃষ্টিতেও ঘর থেকে সরে না।

স্থানীয় উত্তর পাহাড়তলি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জহিরুল হক জসিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গতকাল থেকে পাহাড়ের নিচে যারা, তাদের সরে যেতে বারবার বলা হয়েছে।

“ প্রশাসনের থেকে বলেছে। আমাদের লোকজন এসেছেও বলেছে। তারপরও তারা সরেনি।”

ফাইল ছবি

প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৩৮৫টি অতি ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনার কথা বলা হলেও নগরীর লালখান বাজার, মতিঝর্ণা, টাঙ্কির পাহাড়, পাহাড়তলি, কৈবল্যধাম, খুলশী, বায়েজিদ, আকবর শাহ, জঙ্গল ছলিমপুরসহ বিভিন্ন পাহাড়ে কয়েক হাজার পাকা, সেমি পাকা ও কাঁচা স্থাপনা আছে। প্রতি বছর এ সংখ্যা আরও বাড়ছে।

চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মো. মমিনুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মহানগর ও আশেপাশের ২৭টি পাহাড় চিহ্নিত করা হয়েছে যেগুলোতে বসতি আছে।

“চিহ্নিত অতি ঝুঁকির স্থাপনার মধ্যে ৬০টি অপসারণ করা হয়েছে। আগামীকাল আরও ১২০টি অপসারণ করা হবে।”

তিনি জানান, বেশিরভাগ পাহাড়ের মালিক বাংলাদেশ রেলওয়ে,  গণপূর্ত অধিদপ্তর-পিডব্লিউডি, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ- সিডিএ এবং সিটি করপোরেশন। এছাড়া কিছু ব্যক্তিমালিকানার পাহাড়ও আছে।

জেলা প্রশাসক বলেন, “প্রতি বছরই আমরা উচ্ছেদ করি। উচ্ছেদের পরও মালিকরা যদি নিজ নিজ পাহাড় রক্ষা করতে না পারে তাহলে পরিস্থিতি সামাল দেয়া খুবই কঠিন।”

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু বর্ষা এলে ‘লোক দেখানো’ উচ্ছেদ অভিযানে পাহাড় রক্ষা বা প্রাণহানী ঠেকানো সম্ভব নয়। সরকারি সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতা এবং একে অন্যের ঘাড়ে দায় চাপানো বন্ধ না হলে মৃত্যুর মিছিল থামবে না।

২০০৭ সালের ১১ জুন বন্দর নগরী ও আশেপাশের এলাকায় একযোগে পাহাড় ধসে ১২৭ জনের মৃত্যু হয়। এরপর প্রায় প্রতি বছরই বর্ষায় পাহাড় ধসে প্রাণহানী হয়।

পরিবেশবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইদ্রিস আলী বলেন, “২০০৭ এর পর ১৫ বছর পেরিয়ে গেছে। প্রথম ১-২ বছরে যদি করণীয় নির্ধারণ করে প্রশাসন সুপারিশ করত এবং পরে তা বাস্তবায়ন করত তাহলে এই প্রাণগুলো রক্ষা পেত।

“চট্টগ্রামে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক নির্লিপ্ততায় পাহাড়খেকো ব্যবসায়ীরা পাহাড় নিয়ে মানুষের জীবনবাজি করে ব্যবসার সুযোগ পেয়েছে। প্রতিবছর যেসব অভিযান চালানো হয় তাতে আন্তরিকতা বা পেশাদারিত্ব কোনোটাই নেই।”

শুধু বর্ষায় অভিযান চালানোকে ‘আইওয়াশ’ উল্লেখ করে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইদ্রিস আলী বলেন, “এটা তো পাহাড় লুটেরাদের সাথে চোর-পুলিশ খেলা। এসব করে কাজের কাজ কিছু হয় না, শুধু মৃত্যু বাড়ে।”

চট্টগ্রামের বায়েজিদ চন্দ্রনগরের নাগ-নাগিনী পাহাড়ের নিচ থেকে গত বছরের অগাস্টে কেটে রাখা হয়, যাতে অতিবৃষ্টিতে সহজেই ধসে পড়ে। ছবি: উত্তম সেন গুপ্ত

পরিবেশবাদী সংগঠন পিপল’স ভয়েসের সভাপতি শরীফ চৌহান বলেন, “বর্ষা আসার আগে স্থানীয় প্রশাসনের কিছু দাপ্তরিক কর্মকাণ্ড দেখা যায়। যেমন- সভা করা ও কমিটি গঠন। এ বছরও মাস খানেক আগে কয়েকটি সভা হয়েছে।

“শুধু তালিকা প্রণয়ন, কিছু উচ্ছেদ আর সেবা সংস্থার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার তোড়জোড়ে বর্ষা পেরিয়ে যায়। সংশ্লিষ্টরাও সব ভুলে যায়। ২০০৭ সালে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির কয়টি সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়েছে?”

এই পরিবেশ কর্মী বলেন, “শুধু মুখে সমন্বয়ের কথা না বলে কার্যকর সমন্বয় করতে হবে। উচ্ছেদ ও পাহাড় কাটা বন্ধে টাস্কফোর্স গঠন এবং পাহাড় খেকোদের বিচারে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল করতে হবে অতি সত্ত্বর।”

দায়িত্ব কার?

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী মনে করেন, নগরীর পাহাড়গুলোর রক্ষা এবং পাহাড় ধসে মৃত্যু ঠেকাতে সব সরকারি সংস্থা মিলে ‘কঠোর’ হতে হবে।

তিনি বলেন, “আমি সবসময় বলছি, সবাইকে জোরেশোরে সোচ্চার হতে হবে। গত পরশু সমন্বয় সভা করে বলেছি, ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা থেকে বসবাসকারীদের বের করে তালা লাগিয়ে দিতে।

“পরিবেশ অধিদপ্তরকে বললে, তারা বলে রাতে পাহাড় কাটে। তাদের বলেছি, দিনে গিয়ে কাটা অংশ দেখে ব্যবস্থা নিন। আমি প্রতিদিন বলছি পাহাড় কাটা বন্ধ করেন। জেলা প্রশাসন, পুলিশ ও পরিবেশ অধিদপ্তর সবাইকে কঠোর হতে হবে।” 

অধ্যাপক মুহাম্মদ ইদ্রিস আলী বলেন, “অবশ্যই যে কোনো উদ্যোগে রাজনৈতিক নেতৃত্ব থাকতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান, চট্টগ্রামের যে সমন্বয়হীনতা চলছে তা আপনি দেখুন। ব্যবস্থা নিন।

“অন্য দেশের ৮ লাখ মানুষকে আশ্রয় দিতে পারলে পাহাড়ের পাদদেশের নিম্ন আয়ের এই মানুষদের খাসজমিতে পুনর্বাসন করা কোনো বিষয় হওয়ার কথা নয়।”

জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান বলেন, “সীতাকুণ্ড ও হাটহাজারীর পাহাড়ের পাদদেশে বসতি স্থাপনকারীদের ইতোমধ্যে আশ্রয়ণ প্রকল্পে পুনর্বাসন করা হচ্ছে। জুলাইয়ের মধ্যে সবাইকে সরিয়ে নেয়া সম্ভব হবে।

“তবে নগরীতে পুনর্বাসন করতে হলে সে উদ্যোগ সিটি করপোরেশনকে নিতে হবে। সেটা তাদের এখতিয়ার।”

মেয়র রেজাউল করিম বলেন, “আমাদের অগ্রাধিকার পাহাড় কাটা থামানো। নয়ত হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে জলাবদ্ধতা নিরসনে যে প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে তার সুফল মিলবে না।

“পাহাড় কাটা মাটি বৃষ্টিতে নেমে এসে খাল-নালা সব ভরাট করে ফেলছে। এই শহরকে সুন্দর নগরীতে পরিণত করতে চাইলে কঠোর হতে হবে। অবশ্যই সবাইকে নিয়ে সমন্বয় করে পাহাড় রক্ষায় আমি অ্যাকশনে যাব।”

আরও খবর