২০১৭: বন্যা আর পাহাড় ধসে দুর্যোগের বছর

হাওরাঞ্চলে আগাম বন্যার পর ভারি বর্ষণে পাহাড় ধসের পাশাপাশি ফের মৌসুমি বন্যা, সঙ্গে নিয়মিত বিরতিতে সাগরে নিম্নচাপ ও ঘূর্ণিঝড় মিলিয়ে বিদায়ী বছর জুড়ে দেশের সবপ্রান্তে ছিল দুর্যোগের হানা।

মঈনুল হক চৌধুরী জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 Dec 2017, 11:53 AM
Updated : 29 Dec 2017, 05:23 PM

এছাড়া বছর জুড়ে ছোটোখাটো ভূমিকম্প, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, বজ্রবৃষ্টি, বজ্রপাতসহ নানা ধরনের বৈরী আবহাওয়ার উৎপাতের সঙ্গে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কক্সবাজারে রোহিঙ্কাদের আশ্রয় নেওয়ার ঘটনায় উজাড় হয়েছে বিপুল পরিমাণ বনজ সম্পদও।

এবার বছরের শুরুতে ত্রিপুরায় তৈরি ভূকম্পনে কেঁপে ওঠে সারা দেশ, এপ্রিলের শুরুতে আগাম বন্যার বিস্তার ছিল পদ্মা-যমুনা-বহ্মপুত্র-সুরমার পাড় ধরে মধ্যাঞ্চলসহ ৩২ জেলার হাওরাঞ্চলে; আর শেষার্ধে হয় অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত, যা এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ।

মে মাসে এসে বজ্রপাতে প্রাণহানি ছিল অর্ধশতাধিক। তাপদাহ শেষ করেই মে মাসের শেষে ঘূর্ণিঝড় ‘মোরার’ মহাবিপদ সংকেত। জুনে পাহাড়ে অতিবর্ষণের ধসে প্রাণহানি দেড় শতাধিক, অতিবৃষ্টিতে তলিয়ে যায় রাজধানী ও চট্টগ্রাম নগরীও; এ দুই নগরীর সড়কে পারাপার ছিল নৌকার।

জুলাই-অগাস্টে দেশের অর্ধেক এলাকার অধিকাংশই প্লাবিত হয় মৌসুমী বন্যায়। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের বসতি গড়তে সেপ্টেম্বরে বন উজাড় হয় পাহাড়ে।

আর উপকূলজুড়ে নিম্নচাপ ও ঘূর্ণিঝড়ের রুদ্রমূর্তি ছিল পুরো বছর জুড়েই। নিম্নচাপ ও ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে টানা বৃষ্টিপাত দেশের মধ্যাঞ্চলের মানুষকে পর্যন্ত ভুগিয়েছে।

বাংলাদেশ দুর্যোগপ্রবণ দেশ হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোয় অস্বাভাবিক আবহাওয়াও বারবার কড়া নাড়ায় আগামীর জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি রাখায় জোর দিচ্ছেন আবহাওয়া অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক সমরেন্দ্র কর্মকার।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “তুলনামুলকভাবে এ বছরের হাওরাঞ্চলের অকাল বন্যা ও পাহাড়ে অতিবর্ষণ ছিল বেশ অস্বাভাবিক। বিষয়গুলো মাথায় রেখে কৃষি ও গবাদিপশুর জন্য বেশ প্রস্তুত হতে হবে সবার।

“গত ৩০ বছরের তথ্য পর্যালোচনা করলে বলা যায়- আগামী বছর এপ্রিল-মে মাসে বেশ তাপদাহ যেতে পারে। হাওরাঞ্চলেও ফের বাগড়া দিতে পারে আগাম বন্যা। অন্যত্র বড় বন্যা না হলেও ছোটোখাটো ঘূর্ণিঝড়ের শঙ্কাও থাকছে। সব মিলিয়ে দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে এখন থেকেই প্রস্তুত থাকতে হবে আমাদের।”

ফিরে দেখা প্রকৃতির বৈরিতা

পাহাড় ধস, প্রাণহানি ১৬০

চলতি বছর ১১ থেকে ১৩ জুনের ভারি বর্ষণে অন্তত ১৬০ জনের মৃত্যু হয় চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, বান্দরবান, কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি ও মৌলভীবাজার জেলায়। এর মধ্যে রাঙামাটিতেই মৃত্যু হয় ১২০ জনের । পাহাড়ি ঢলে পরিস্থিতি নাজুক হয়ে পড়লে চট্টগ্রামের সঙ্গে রাঙামাটি ও বান্দরবানসহ কক্সবাজারের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়।

রাঙামাটি সদরের লোকনাথ মন্দির সংলগ্ন মুসলিম পাড়ায় সড়ক থেকে অন্তত ৫০ ফুট নিচে তিনটি পাহাড়ের মাঝখানে
; ভূমিধসে সেখানকার প্রায় সব বাড়ি গুঁড়িয়ে গেছে।

একদিনেই ৩৪৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হয় সেখানে। বিগত ৫০ বছরে একটানা এত বৃষ্টি হয়নি। পাহাড়ে গাছ নিধনসহ বসতি স্থাপনের জন্য কেটে ন্যাড়া করায় বৃষ্টিতে ধসের ঘটনা ঘটছে বলে পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের অভিযোগ।

হাওরে অকাল বন্যা

এপ্রিলের শুরুতে পাহাড়ি ঢল ও টানা বৃষ্টিতে আকস্মিক বন্যায় সিলেট ও সুনামগঞ্জ, নেত্রকোণা ও কিশোরগঞ্জের বিস্তীর্ণ হাওর এলাকা তলিয়ে যায়

বন্যার কারণে হাওর অঞ্চলের জেলাগুলোতে ছয় লাখ টনের মতো ধান নষ্ট হয়েছে বলে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব। তবে বেসরকারি সংস্থাগুলোর হিসাবে ফসলহানির পরিমাণ ২২ লাখ টন।

মানুষের
হাওর বোর্ডের শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর নিয়েও সমালোচনা হয়। বাঁধ নিয়ে দুর্নীতির জেরে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৩ প্রকৌশলী বরখাস্ত, পানি সম্পদের যুগ্মসচিবসহ ৪ জনকে দুদকে তলবও করে। এ দুর্নীতির তদন্ত খতিয়ে দেখতে দুদককে নির্দেশ দেন

অতিবৃষ্টি নগরে-বন্দরে

এবারের এপ্রিল মাস ছিল ৩৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিবহুল। গ্রাম-গঞ্জ, শহর-বন্দরে ছিল দুর্ভোগ।

সাধারণত এ মাসের স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৪ হাজার ৫৩ মিলিমিটার; কিন্তু এবার রেকর্ড  ছাড়িয়ে ৯ হাজার মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টিপাত হয়। ঢাকার আকাশে ২৩ এপ্রিল মেঘ নেমে আসার ঘটনাও ঘটে

চৈত্রের বৃষ্টিতে পানিতে ডুবে যাওয়া মাঠে ফুটবল নিয়ে কিশোরদের এই দুরন্তপনার ছবি রাজধানীর তিতুমীর কলেজের মাঠ থেকে তোলা। ছবি: আব্দুল মান্নান

বর্ষার শুরুতে ১২-১৩ জুন ২৪ ঘণ্টায় ১৩৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয় ঢাকায়। ১৩ জুলাই ১০৩ মিলিমিটারের রেকর্ড বৃষ্টি হয়। ২৬ জুলাই রাতে মাত্র ৬৭ মিলিমিটারের বৃষ্টিতে নগরবাসীকে দিনভর জলজট ও যানজটে ভুগতে হয়।

রাজধানীর বাইরে ২০ জুলাই সীতাকুণ্ডে ২৪ ঘণ্টায় ৩৭৪ মিলিমিটার; রাঙামাটিতে ১২ জুন ৩৪৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়।

৩ অগাস্ট তিন ঘণ্টার বৃষ্টিতেই ডুবে ঢাকার অনেক সড়ক, অল্প সময়ে এত বৃষ্টিপাত ১০ বছর পর দেখে রাজধানীবাসী। ওইদিন স্বল্প সময়ে ১২৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়।

জুলাই-অগাস্টে ঢাকাচট্টগ্রামের সড়কে নৌকা পারাপারের দৃশ্যও ছিল কয়েকদিন নিয়মিত। অধিকাংশ এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দেয়; গাড়ি না পাওয়া, আবার পেলেও যানজটের ধকল পোহাতে হয় মানুষকে।

মার্চ-এপ্রিল-মে মাসের এ মৌসুমে কালবোশেখি ঝড় আর বৃষ্টির দাপটের সঙ্গে গরম দিনও পার করে রাজধানীবাসী।

নিম্নচাপ-ঘূর্ণিঝড় ও ‘মোরা’

গ্রীষ্ম মৌসুমে চার দফা তাপপ্রবাহের মধ্যে ছিল ঘূর্ণিঝড় মোরার আঘাত। এ বছর এপ্রিল ও মে মাসে মারুথা ও মোরা নামে দুটি ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয় বঙ্গোপসাগরে।

এছাড়া বছরের দ্বিতীয়ার্ধের অগাস্ট ছাড়া প্রায় প্রতি মাসেই সাগরে নিম্নচাপ তৈরি হয়। এজন্য দেশের নদী ও সমুদ্র বন্দরগুলোতে সতর্ক সংকেত জারির পাশাপাশি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিম্নচাপের প্রভাবে প্রায় সারা দেশে টানা বৃষ্টিপাতের ভোগান্তি পোহাতে হয় মানুষজনকে।

মে মাসের শেষদিকে গভীর নিম্নচাপ থেকে ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হওয়ার পর কক্সবাজার-চট্টগ্রাম  উপকূল অতিক্রম করে ‘
’ । চট্টগ্রাম বন্দর, শাহ আমানত বিমান বন্দরের স্বাভাবিক কাজ বন্ধ রাখা হয়, কয়েক লাখ মানুষকে নেওয়া হয় আশ্রয় কেন্দ্রে।

১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত নিয়ে আঘাত হানা এই ঝড়ে উপকূলীয় বিভিন্ন জেলায় বিপুল সংখ্যক ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়, মৃত্যু হয় সাতজনের। বঙ্গোপসাগরে ডুবে যাওয়া অর্ধশতাধিক নিখোঁজ লোককে নৌবাহিনী ও স্থানীয় জেলেরা উদ্ধার করে এবং নৌকার ৩৩ মাঝি-মাল্লা ও জেলেকে উদ্ধার করে ভারতীয় নৌবাহিনী।

এ ঝড়ে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চাঁদপুর, বরিশাল, পিরোজপুর, পটুয়াখালী, ভোলা, ঝালকাঠি, বরগুনা, খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট ও রাঙামাটি- ১৬ জেলার ২ লাখ ৮৬ হাজার মানুষ ক্ষতির শিকার হয়।

বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ৩২ জেলা

হাওরে আগাম বন্যার পর জুলাইয়ের দ্বিতীয়ার্ধে মৌসুমের প্রথম বন্যায় অন্তত ১৩ জেলার অনেক উপজেলা প্লাবিত হয়। অগাস্টের বন্যায় ৩২ জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়ে পৌনে এক কোটিরও বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

এ বন্যার বিস্তার কম হলেও প্রাণহানির দিক থেকে তা ১৯৮৮ ও ১৯৯৮ সালের বন্যাকে ছাড়িয়ে যায়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৩২ জেলায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রায় ৮২ লাখ মানুষ। পানিতে ভেসে ও বন্যাজনিত অন্যান্য কারণে মৃত্যু হয়েছে ১৪০ জনের।

পানি নেমে গেলেও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের তিন মাস পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহায়তার আশ্বাস দেওয়া হয়।

ভূকম্পন

বছর শুরু হতে না হতেই ৩ জানুয়ারি বাংলাদেশের সীমান্ত লাগোয়া ভারতের ত্রিপুরায় রিখটার স্কেলে ৫ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্পে দেশের পূর্ব ও দক্ষিণের সিলেট, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের সঙ্গ রাজধানী ঢাকাসহ মধ‌্য ও উত্তরের অধিকাংশ জেলা কেঁপে উঠে। এসময় সুনামগঞ্জে ভূমিকম্পে ‘আতঙ্কে’ ২ জনের মৃত্যু হয়।

এপ্রিলে সিলেটসহ দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ৪ দশমিক ১ মাত্রার ভূকম্পন, নভেম্বরে ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ৪ দশমিক ৭ মাত্রার মৃদু ভূ-কম্পন হয়।

বনউজাড়

প্রাকৃতিক কারণে না হলেও মিয়ানমারে সেনা নির্যাতনের মুখে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয়ে বসতি নির্মাণে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে বিপুল পরিমাণ বনজ সম্পদ উজাড় হয়েছে।

শরণার্থীদের কারণে কক্সবাজারের পাহাড়, জলাশয়, সমুদ্র সৈকতসহ পরিবেশের অন্যান্য খাতেরও ক্ষতি হচ্ছে। মিয়ানমারের রাখাইনে সহিংসতার মুখে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য এরই মধ্যে ১৫০ কোটি ৮৭ লাখ টাকার বনজ সম্পদ ধ্বংস হয় এবার।

কক্সবাজারের উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের ছবুল্লাকাটা এলাকার পাহাড়ে ঘর তৈরির জন্য গাছ কেটে পরিষ্কার করছে রোহিঙ্গারা। ছবি: মোস্তাফিজুর রহমান

পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি বলছে,
হয়ে যাচ্ছে। বন অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী এ পর্যন্ত শুধু বনের ক্ষতি দেড়শ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। পরিবেশের ক্ষতির হিসাব অনেক বেশি। ইতোমধ্যে পর্যটন ব্যবসায় ধস নেমেছে। কক্সবাজার অঞ্চলে পর্যটকদের যাওয়ার পরিবেশ নেই। পাহাড়-জলাশয় নষ্ট হচ্ছে, যা উদ্বেগজনক জায়গায় পৌঁছেছে।

অন্যান্য দুর্যোগের মধ্যে বজ্রপাতেও অর্ধশতাধিক লোকের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে মে মাসে একদিনেই মৃত্যু হয় ১৬ জনের