“আবহাওয়া অফিস বলেছে ভারি বৃষ্টিপাত হবে। সাধারণ মানুষ জানে না ভারি, মধ্যম আর হালকা বৃষ্টিপাত কী।”
Published : 27 Aug 2024, 12:12 AM
দেশের পূর্বাঞ্চলে যে ভারি বৃষ্টিপাত হতে পারে, বন্যার কয়েক দিন আগেই সে পূর্বাভাস দিয়েছিল আবহাওয়া অধিদপ্তর। তাহলে সেই পূর্বাভাস সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে পারল না কেন?
পানি সম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলছেন, বাংলাদেশে ঔপনিবেশিক আমল থেকে আবহাওয়া ও বন্যার পূর্বাভাস যেভাবে যে ভাষায় দেওয়া হয়, তা সাধারণ মানুষের কাছে বোধগম্য নয়।
“যেমন- তারা যদি বলে নদীর পানির উচ্চতা বিপৎসীমার চেয়ে ১০ সেন্টিমিটার বেড়েছে, আগামী ২৪ ঘণ্টায় আরো ৫ সেন্টিমিটার বাড়বে- এতে আসলে কী বোঝায়? নদী বিপদসীমার দুই মিটার নিচে, এটা দিয়েই বা কী বোঝায়?”
সাগরে লঘুচাপ বা নিম্নচাপের তথ্যের ভিত্তিতে আবহাওয়া অফিস বৃষ্টির পূর্বাভাস দেয়। এবার বন্যার আগে এবং মধ্যে সিলেট থেকে খাগড়াছড়ি পুরো এলাকায় যে বৃষ্টিপাত হয়েছে, তার মাত্রাকে ‘অস্বাভাবিক’ বলছেন আইনুন নিশাত।
কিন্তু সেই পূর্বাভাসও তো দেওয়া হয়েছিল! তাহলে গলদ কোথায়?
আইনুন নিশাত বলছেন, “আবহাওয়া অফিস বলেছে ভারি বৃষ্টিপাত হবে। সাধারণ মানুষ জানে না ভারি, মধ্যম আর হালকা বৃষ্টিপাত কী।”
অবশ্য কেবল মানুষ পূর্বাভাস বোঝেনি বলেই যে পরিস্থিতি এতটা খারাপ হয়েছে– বিষয়টা তেমনও নয়।
বাংলাদেশের উজানে ভারতের ত্রিপুরাতেও প্রবল বৃষ্টি আর বন্যা হয়েছে। স্বাভাবিক নিয়মে সেই পানি নদী হয়ে বাংলাদেশের ওপর দিয়েই সাগরে যাবে। কিন্তু যে এলাকাজুড়ে এবার এই সময়ে এমন বৃষ্টি হয়েছে, আর অল্প সময়ের মধ্যে বৃষ্টির যা পরিমাণ, দুটোই ছিল আইনুন নিশাতের ভাষায় ‘অস্বাভাবিক।
দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার কারণে ঘূর্ণিঝড় আর বন্যার দুর্যোগ সামলাতে বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মীদের দক্ষতা আন্তর্জাতিক পর্যায়েও প্রশংসা পাচ্ছিল বেশ কিছুদিন ধরে। কিন্তু গণ আন্দোলনে সরকার পরিবর্তনের পর একটি অস্থির অবস্থার মধ্যে যখন ভয়ংকর রূপ ধরে বন্যা এল, তখন সমন্বয় আর ত্বরিত পদক্ষেপের অভাবে সেই দক্ষতা আর কাজে লাগানো যায়নি।
বাংলাদেশের দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এখন রাষ্ট্র ব্যবস্থার সংস্কারের জন্য রূপরেখা তৈরিতে ব্যস্ত। এই সময়ে আগামী দিনের দুর্যোগ মোকাবেলায় আবহাওয়া ও বন্যার পূর্বাভাস ব্যবস্থার সংস্কারেও পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন আইনুন নিশাত।
বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদীর কমিশনের সাবেক এই সদস্য যোগ দিয়েছিলেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের আলোচনা অনুষ্ঠান ইনসাইড আউটে। এবারের বন্যার ভয়াবহতার কারণ, ভারতের সঙ্গে তথ্য বিনিময়, ভারতের বাঁধ খুলে দেওয়ার বিতর্ক আর বাংলাদেশের পূর্বাভাস ব্যবস্থার সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে তিনি খোলামেলা কথা বলেছেন।
তার ভাষায়, পূর্বাভাস দিতে হবে এমন ভাষায়, যেটা সাধারণ মানুষ বুঝতে পারবে।
“এখন পূর্বাভাস যে ভাষায় দেওয়া হয়, সেটা কেবল পেশাজীবীরা বুঝতে পারে। আমি বুঝতে পারি যে বন্যা, বৃষ্টি বা ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাসে কোন কথায় কী বলা হচ্ছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ সেটা বোঝে না। এটা পরিবর্তন করতে হবে। এটা ঔপনিবেশিক আমলের উত্তরাধিকার। এখনও আমরা সেটা অনুসরণ করে যাচ্ছি।”
আইনুন নিশাত বলেন, “পূর্বাভাসের পাশাপাশি সতর্কতাও জারি করতে হবে সঠিকভাবে, যাতে সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে। জ্যামাইকা, বার্বাডোজের মত ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের দেশগুলোতে যেভাবে দেওয়া হয়।”
সোমবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ফেইসবুক পেইজ ও ইউটিউব চ্যানেলে সম্প্রচার করা হয় ইনসাইড আউটের এই সর্বশেষ পর্বটি।
পরিস্থিতি ছিল ‘অস্বাভাবিক’
বর্ষা মৌসুমের পর শরতে এসে চলমান যে বন্যায় দেশের অন্তত ১১টি জেলা ভয়াবহভাবে বিপর্যস্ত, আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভাষায় এটি ছিল ‘আকস্মিক বন্যা’।
অগাস্টে বাংলাদেশে বন্যা নতুন কিছু নয়। তবে উত্তর ও দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের যেসব এলাকা এবার বন্যা দুর্গত হয়েছে, এই মওসুমে সেসব এলাকায় এমন প্রবল বন্যার নজির নেই।
গত বুধবার ভারতের ত্রিপুরা থেকে ফেনী, কুমিল্লার দিকে ধেয়ে আসে প্রবল স্রোতধারা। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তলিয়ে যায় বিস্তীর্ণ জনপদ। ভয়াবহ এই বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৫২ লাখের বেশি মানুষ।
বন্যার শুরু থেকেই ফেইসবুকে আলোচনা তৈরি হয়, ভারত ত্রিপুরায় ডাম্বুরে জলবিদ্যুৎকেন্দ্রের জলকপাট খুলে দেওয়ায় বাংলাদেশ ভেসে যাচ্ছে। যদিও ভারত দাবি করে, বিষয়টি তথ্যগতভাবে ‘সঠিক নয়’।
দ্বিপক্ষীয় প্রটোকলের আওতায় নদীর উজানের পানির উচ্চতা ও বৃষ্টিপাতের তথ্য বাংলাদেশকে দেওয়ার কথা ভারতের। ভারত সেই তথ্য দিয়েছিল কি না, ওঠে সেই প্রশ্নও।
যৌথ নদীর কমিশনের সাবেক সদস্য আইনুন নিশাত বলেন, “তারা আমাদেরকে পানির উচ্চতা বৃষ্টিপাতের অবস্থা জানিয়েছে এবং বলেছে, এভাবে পরিস্থিতি পাল্টাচ্ছে। আবহাওয়া অফিস পূর্বাভাসও দিয়েছে, পত্রিকায় এসেছে, কিন্তু আমরা গুরুত্ব দিইনি। সরকার যন্ত্র এটার নোট নেয়নি।”
বন্যা ভয়াবহ হওয়ার পেছনে দেশের পূর্বাঞ্চলের বড় অংশজুড়ে দীর্ঘ সময় ধরে ‘অস্বাভাবিক’ ভারি বৃষ্টিপাত এবং মুহুরী ও ফেনী নদীর বেড়িবাঁধ না থাকার কথা বলেন তিনি।
দুদেশের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদানের প্রক্রিয়ার কথা তুলে ধরে আইনুন নিশাত বলেন, ১৯৭২ সালে যৌথ নদী কমিশন গঠনের ধারাবাহিকতায় আশির দশক থেকে এক ডজনের বেশি নদীর পানির উচ্চতা ও বৃষ্টিপাতের পরিমাণের তথ্য ভারত দিয়ে থাকে।
“ভারত আমাদেরকে সীমান্তের কাছাকাছি জায়গা থেকে পানির উচ্চতা এবং বৃষ্টিপাতের তথ্য দেয়। বৃষ্টিপাতের তথ্য দেওয়া হয় আমাদের আবহাওয়া অধিদপ্তরকে এবং সেটার উপর ভিত্তি করে তারা পূর্বাভাস দেয়।”
নদীর পানির উচ্চতার তথ্য পেয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড বন্যার পূর্বাভাস তৈরি করে জানিয়ে আইনুন নিশাত বলেন, “নদীর তথ্য দেওয়া হয় পানি উন্নয়ন বোর্ডকে। সেই তথ্যের ভিত্তিতে মডেলিং করে এবং আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে পূর্বাভাস দেয় পরবর্তী তিন দিনে কী ঘটতে পারে। পাঁচ বা সাতদিনের পূর্বাভাস দেয়।
“এটা স্ট্যান্ডার্ড প্র্যাকটিস, যেটা আমি বলতে পারি গত ১৫ বছর ধরে মেনে চলা হচ্ছে। এখানে একটা মেকানিজম আছে এবং আমরা তাদেরকে জানাই, আমরা এটা দিয়ে কী করছি।”
এবারও সেভাবে তথ্য আসার কথা তুলে দরে তিনি বলেন, “বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, কেননা প্রবাহ ও বন্যার বিষয়ে এটা ইঙ্গিত দেয়। এটা এসেছে এবং আবহাওয়া অধিদপ্তরকে দেওয়া হয়েছে। আমি আবহাওয়া অধিদপ্তরের পক্ষ নিয়ে দিতে বলতে চাই, তারা পূর্বাভাস জারি করেছে।
“বন্যার সাতদিন আগেও পত্রিকাগুলো লিখেছে যে পূর্বাঞ্চলে ভারি বৃষ্টিপাত হতে পারে। এটা বঙ্গোপসাগরের লঘুচাপে কারণে।“
আইনুন নিশাত বলেন, “বিষয়টা হচ্ছে, এটা মানবসৃষ্ট নয়, পরিস্থিতিটা ছিল অস্বাভাবিক। দুই দেশ যদি পরস্পরকে সহযোগিতা করে, তাহলে তথ্যের মানোন্নয়নের সুযোগ আছে। তবে, এখন পর্যন্ত চুক্তির অধীনে যে তথ্য তাদের দেওয়ার কথা, সেটা দেওয়া হয়েছে।”
পরিস্থিতি এতটা খারাপ হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, “প্রটোকল অনুযায়ী তারা নদীর পানির উচ্চতা এবং বৃষ্টিপাতের তথ্য দিয়েছে। কিন্তু বিলোনিয়াসহ ফেনীতে বন্যার পরিমাণ ছিল ব্যাপক। কেননা ফেনী নদী ও মুহুরী নদীতে কোনো নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা ছিল না।
“পানি নেমে এসেছে। ভারতীয় প্রান্তে বন্যা ছিল, আমাদের প্রান্তেও বন্যা ছিল। হ্যাঁ কেউ যদি ভালোমত পর্যবেক্ষণ করত, সরকারি ব্যবস্থাপনা যদি খুব সচেতন হত, তাহলে তারা মানুষকে সচেতন করতে পারত।”
তিনি বলেন, গোমতীর পাড়ে বেড়িবাঁধ বহু বছরের পুরোনো। পানির প্রবল চাপ ঠেকাতে সেটা ব্যর্থ হয়েছে বা ভেঙে গেছে।
মানুষের পুনর্বাসনসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, “মানুষকে পুনর্বাসনের সুযোগ করে দিতে হবে। দ্রুততার সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা ঠিক করতে হবে, কেননা সড়ক, কালভার্ট ভেঙে গেছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কও ক্ষতি হয়েছে। লোকালয়ের ছোট রাস্তাও ধ্বংস হয়েছে।
“কৃষি খাতে নজর দিতে হবে। কেননা, আমন রোপণের ক্ষেত্রে ক্ষতি হয়েছে। তাৎক্ষণিকভাবে চারা তৈরি সম্ভব হবে না, বন্যা হয় নাই এমন এলাকা থেকে সহায়তা দিতে হবে। সরকারকে এটা করতে হবে।”
এসব কাজের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের পেশাজীবী, নাগরিক সমাজ, স্থানীয় নেতাদেরকে যুক্ত করে দ্রুততার সঙ্গে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি করার পরামর্শ দিচ্ছেন এই বিশেষজ্ঞ।
‘অস্বাভাবিক’ বৃষ্টিপাত
বিশাল এলাকা জুড়ে বৃষ্টিপাত এবং অল্প সময়ে বেশি বৃষ্টিপাতের কারণে এবারের বন্যাকে ‘অস্বাভাবিক’ বলছেন আইনুন নিশাত।
তিনি বলেন, “এটা প্রাকৃতিক হলেও দুই কারণে অস্বাভাবিক। প্রথম কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশের পুরো পূর্বাঞ্চলীয় এলাকায় হয়েছে। সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, ফেনী, নোয়াখালী থেকে খাগড়াছড়ি পর্যন্ত।
একই রকম ভারি বৃষ্টিপাত ভারতেও যে হয়েছে, সে কথা তুলে ধরে আইনুন নিশাত বলেন, “বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলের এলাকা সমভূমি, পূর্বাঞ্চল হচ্ছে পাহাড়ি এলাকা। আমাদের একমাত্র পাহাড়ি এলাকা পার্বত্য চট্টগ্রাম। পাহাড়ি এলাকায় বৃষ্টি যখন পড়ে, তখন পানি খুব দ্রুত নেমে আসে।
“দ্বিতীয় অস্বাভাবিক দিক হচ্ছে, খুব অল্প সময়ে বেশি ভারি বর্ষণ হয়েছে। এরকম ৫০-১০০ বছরে একবার ঘটে। গোমতীতে মাসে ৪০০-৫০০ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টিপাত হয়। এবার ওই পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়েছে মাত্র দু-তিনদিনে। শনিবারও সেখানে প্রায় ২০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে।”
বৃষ্টির এই মাত্রা বোঝানোর জন্য উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, “ঢাকায় যদি ৫০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়, আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, আপনাকে আপনার অফিসে নৌকা নিয়ে আসতে হবে। সুতরাং আপনি বুঝে নিন, কী পরিমাণ বারিবর্ষণ হয়েছে ভারতের প্রান্তে, তারাও ব্যাপক বন্যা দেখেছে।”
পানি বাড়লে ‘ড্যাম ছাড়তে হয়’
ত্রিপুরার বিদ্যুৎমন্ত্রী রতন লাল নাথ বলেছেন, ডাম্বুর গেট খুলে দেওয়ায় বন্যার যে কথা বলা হচ্ছে, সেটা ‘অপপ্রচার’ ছাড়া কিছু না। গোমতী জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কোনো গেট ‘খুলে দেওয়া হয়নি’।
“এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জলাধারটির সর্বোচ্চ ধারণ ক্ষমতা ৯৪ মিটার। জলস্তর এর বেশি উঠলে নিজের থেকেই জল গেট দিয়ে বেরিয়ে যাবে। জলস্তর আবার নিচে নেমে গেলে নিজের থেকেই গেট বন্ধ হয়ে যাবে।
“জলস্তর সর্বোচ্চ ধারণ ক্ষমতার বেশি হয়ে যেতেই জলাধারের দুটি গেট দিয়ে জল বেরোচ্ছে। এর মধ্যে একটি গেট দিয়ে ৫০% হারে জল বেরোচ্ছে। সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষকে আগে থেকেই মাইকিং করে সতর্ক থাকার অনুরোধও জানানো হয়েছিল।”
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে আইনুন নিশাত বলেন, গোমতী নদীর ১২০ কিলোমিটার উজানে ডাম্বুর বাঁধ বর্ষার পানি ধরে রাখে এবং সারা বছর বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়।
“ভারতীয় পত্রিকার খবর অনুযায়ী, আমরা সেখান থেকে ৪০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ কিনি। এটা বড় আকারে বন্যার পানি আটকায়। এটা যদি পূর্ণ হয়ে যায়, তাহলে তাদেরকে বর্ষার পানি ছাড়তে হয়।”
ড্যামে বর্ষার পানি ধরে রাখার কারণে সাধারণভাবে বন্যার প্রবণতা কমার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “প্রায় ৩৫ বছর আগে এই ড্যাম বানানো হয়েছে। ৩৫ বছর আগে বাংলাদেশ ও ভারত যখন বন্যার পূর্বাভাস নিয়ে দেনদরবার করছিল, হয়ত রিজার্ভার বা ড্যাম কীভাবে আচরণ করে সেটা প্রটোকলের মধ্যে ছিল না।
“তবে, সেই ড্যাম বর্ষার অতিরিক্ত পানি ধরে রাখে। ফলাফল হচ্ছে, গত ৩৫ বছরে ত্রিপুরা বা আসামে, কিংবা কুমিল্লায় গোমতীর উপকূলে বন্যা হয়নি।”
এক্ষেত্রে কাপ্তাই বাঁধে বর্ষার পানি ধরে রাখার কারণে চট্টগ্রামে রাঙ্গুনিয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় গত ৫০ বছরে বড় রকমের বন্যা না হওয়ার কথা তুলে ধরেন আইনুন নিশাত। তিনি বলেন, “এটা যদি পূর্ণ হয়ে যায়, তাহলে সমস্যা। যেটা গতকাল ঘটেছে।
“পানির উচ্চতা যদি ১০৮ এমএসএল এর উপরে হয়, তাহলে তারা কপাট খুলে দিতে বাধ্য হয়। যদি তারা কপাট পুরোপুরি খুলে দেয়, তাহলে রাঙ্গুনিয়া ও তার নিচের এলাকায় ব্যাপক বন্যা হবে। তারা কপাট খুলেছে, তবে ছয় ইঞ্চি পরিমাণ।”
বাঁধ কেন ব্যর্থ হয়?
বেড়িবাঁধ তৈরি হয় পানি আটকানোর জন্য। তাহলে পানির চাপে প্রায়ই কেন বাঁধ ভেঙে যায়?
আইনুন নিশাত বলেন, বাঁধ নির্মাণে নিখুঁত প্রকৌশল প্রয়োজন হয়। সঠিকভাবে নকশা ও নির্মাণ করতে হয়। নির্মাণ হয়ে গেলে রক্ষণাবেক্ষণের বিষয় থাকে।
“ডিজাইনের ব্যাপারে আমার সন্দেহ আছে। হয়ত ডিজাইন কোনোমতে ঠিকঠাক করা হয়, কিন্তু নির্মাণকাজ দুর্বল এবং ব্যবস্থাপনা সেখানে নেই বললে চলে। হ্যাঁ, আপনি পূর্বাভাস বা সতর্কতা পেতে পাচ্ছেন, কিন্তু আপনারা অবকাঠামো যদি ঠিক না থাকে, আপনি সমস্যার মুখোমুখি হবেন।”
“তবে এবারের বন্যা চরম পর্যায়ের, যা ৫০-১০০ বছরে একবার ঘটে। আমার মনে হয় ডিজাইন ঠিক আছে। কেননা, আপনি আরও উঁচু সুরক্ষা যদি চান, খরচ পড়বে বেশি।”
প্রশাসনিক ও স্থানীয় সরকার পর্যায় থেকে সাড়াদান আরও ভালো হত পারত কি-না, এমন প্রশ্নে আইনুন নিশাত বলেন, “বৈশ্বিকভাবে বলা হয়ে থাকে, স্থানীয় মানুষদের সম্পৃক্ত করতে হবে, যাকে বলে স্থানীয় পর্যায়ের অভিযোজন (এলএলএ)।
“এ বিষয়ে ২০১২ ও ২০১৩ সালে সংসদে পাস হওয়া দুটি আইন রয়েছে। একটাতে বলা আছে, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে পানি ব্যবস্থাপনা কমিটি থাকতে হবে। আরেকটাতে বলা আছে, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন, এমনকি ওয়ার্ড পর্যায়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি থাকতে হবে।”
তিনি বলেন, “সুতরাং স্থানীয় মানুষদের যুক্ত করে একটা ব্যবস্থাপনা থাকবে হবে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এই স্থানীয় পর্যায়ের লোকগুলো দিতে করতে হবে। আমি যতদূর জানি, এই কমিটি করা হয়েছে, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাদেরকে কর্তৃত্ব দেওয়া হয়নি।
“সুতরাং আমার আবেদন থাকবে, স্থানীয়দের সম্পৃক্ত করুন। আমি ঢাকায় আছি, কিন্তু ফেনীর ছাগলনাইয়ায় বন্যা হল, সেখানকার লোক ভুগছে। আপনি আমাকে পূর্বাভাস দিচ্ছেন, আমি শুধু এটুকু করতে পারি, আমার আত্মীয়-স্বজন কেউ থাকলে, তাকে জানাতে পারি।”