অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের কমিশনার ছিলেন বিনয় সরকার বীনা। ২০০২ সালে তাকে খুন করা হয়েছিল।
Published : 13 Nov 2022, 10:57 AM
ঢাকার ওয়ার্ড কমিশনার বিনয় কৃষ্ণ সরকার বীনা হত্যার পর ২০ বছর পার হলেও বিচার আছে থমকে।
এর কারণ খুঁজতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সাক্ষ্য দিতে গিয়ে সাক্ষীদের বক্তব্য পরিবর্তন অভিযোগ প্রমাণ কঠিন করে তুলছে। কয়েকজন সাক্ষীরা উল্টো সাক্ষ্য দেওয়ায় তাদের ‘বৈরী’ ঘোষণা করেছে রাষ্ট্রপক্ষ।
মামলার বাদী বিনয়ের স্ত্রী সারিকা সরকারকেও খুঁজে না পাওয়ার কথা বলছে পুলিশ।
এ মামলায় গত ২৩ অক্টোবর ঢাকার আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ ছিল, কিন্তু সেদিন কোনো সাক্ষী হাজির হননি।
মামলার বর্তমান বিচারক চতুর্থ মহানগর দায়রা জজ আাদালতের বিচারক মো. মোরশেদ আলম আগামী ২৩ জানুয়ারি এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডি পুলিশের সাবেক কর্মকর্তা মুন্সী আতিকুর রহমানের সাক্ষ্য নেওয়ার জন্য সিআইডি প্রশাসনকে চিঠি দিয়েছেন।
অবিভক্ত ঢাকার ৭২ নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনার ছিলেন বিএনপি নেতা বীনা সরকার। ২০০২ সালের ২২ মে সন্ধ্যায় পুরান ঢাকার ঝুলন বাড়ি লেনে তাকে গুলি চালিয়ে হত্যা করে একদল দুর্বৃত্ত। এ ঘটনায় বীনার স্ত্রী সারিকা সরকার কোতোয়ালি থানায় ২৬ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেন।
মামলার ২৬ জন আসামির মধ্যে ‘ডাকাত’ সহিদ কয়েক বছর আগে পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজারের সুভাস বোস এভিনিউয়ে পুলিশের সঙ্গে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন। কিন্তু তার মৃত্যুর বিষয়ে এখন পর্যন্ত পুলিশের প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট আদালতে জমা দেওয়া হয়নি।
মামলার নথিপত্রে সহিদকে কারাবন্দি হিসেবে দেখানো হচ্ছে। অন্য ৯ আসামির মধ্যে জামিনে রয়েছেন মাসুদ রানা, আহম্মেদ আওরঙ্গজেব কবির ও আহম্মেদ পারভেজ কবির।
কারাগারে আছেন ছয়জন- রণজিৎ চন্দ্র নন্দী, রাশেদ আহমেদ ভুট্টো, গুড্ডু ওরফে শামীম, জাকির হোসেন, আসিফ আহমেদ সজীব ও মোশাররফ হোসেন।
এই ১০ আসামির বিরুদ্ধে ২০০৪ সালের ১৯ অগাস্ট আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। পরের বছর ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে মামলার অভিযোগ গঠন হয়। মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য ২০০৬ সালের ১ মার্চ ঢাকার ২ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়।
হাই কোর্টের স্থগিতাদেশে ১১ বছর পার
একজন আসামির রিট আবেদনের প্রেক্ষাপটে হাই কোর্টের আদেশে ২০০৬ সালের এপ্রিল মামলার বিচার কাজ আটকে যায়। এরপর ২০১৫ সালের ২৯ এপ্রিল উচ্চ আদালতের ওই স্থগিতাদেশ উঠলেও সেই নথি প্রায় দেড় বছর পড়ে থাকে হাই কোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায়।
২০১৭ সালের ২৫ জানুয়ারি মামলাটি ফের একই ট্রাইব্যুনালে সচল হয়। কিন্তু সাক্ষী যথাসময়ে না আসায় ২০১৭ সালের ২২ অক্টোবর ট্রাইবুনাল মামলার নথি ঢাকার চতুর্থ মহানগর দায়রা জজ আদালতে পাঠিয়ে দেয়।
দ্রুত বিচার ট্রাইবুনালে ১২ জনের সাক্ষ্য নেওয়ার পর চতুর্থ মহানগর দায়রা জজ আাদালতে রাষ্ট্রপক্ষে আর কেউ সাক্ষ্য দেননি বলে জানান ওই আদালতের বেঞ্চ সহকারী পেশকার সাইদুল ইসলাম।
অন্যদিকে পলাতক আসামিদের পক্ষে রাষ্ট্রের নিয়োগ করা আইনজীবী মো. সাহাবুদ্দীন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মামলার বিচার আবার চালু করার জন্য হাই কোর্টের আদেশ ডেসপ্যাচ সেকশনেই পড়ে ছিল। কিন্তু এখন এ মামলাটির কথা আমার মনে নেই। আমি এ মামলাটি তো আর দেখছি না।”
সাক্ষীদের সাক্ষ্যে অসঙ্গতি
মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে ১২ জন সাক্ষ্য দিলেও তাদের মধ্যে বেশিরভাগ কোনো আসামির নাম বলছেন না, ঘটনার সঙ্গে মামলার আসামিদের সম্পৃক্ত করে সাক্ষ্য দিচ্ছেন না। সে কারণে সে সব সাক্ষীদের বেশিরভাগই আসামিপক্ষের জেরার মুখোমুখি হচ্ছে না।
এদের মধ্যে দুই জনকে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে বৈরী ঘোষণা করে উল্টো তাদের জেরা করেন।
এ মামলায় ২০১৭ সালের ৬ মার্চ প্রথম সাক্ষ্য দেন বাবুবাজার, তাঁতীবাজার, শাখারিবাজার এলাকায় চানাচুর, সিঙ্গারা, কেক বিক্রেতা রামপ্রসাদ পাল। তিনি তার সাক্ষ্যে কোন আসামির নাম না বলায় তাকে জেরা করতে অস্বীকৃতি জানানো হয়।
অথচ এই সাক্ষী ঘটনার পরপর হাকিমের কাছে ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে বলেছিলেন, “আমি সেদিন এস আর বুলিয়ন স্টোরের কেঁচি গেট ৫ থেকে ৭ জন লোকের সঙ্গে বিনয়দাকে কথা বলতে দেখি। আমি কিছুক্ষণ পর গুলির শব্দ শুনি। বাইরে রাস্তায় এসে দেখি লোকজন ছুটাছুটি করছে, এস আর বুলিয়ন স্টোরের সামনে দেখি বিনয়দা মাটিতে পড়ে রক্তাক্ত অবস্থায় ছটফট করছে। আমি দাদাকে জিজ্ঞাসা করি আপনাকে কারা গুলি করেছে? সে বলে- সজিব, আওরঙ্গ, রিপন, ডাকাত সহিদ, ভুট্টো, মাসুদ, পারভেজ, জাকির, গুড্ডু তাকে গুলি করেছে।”
সাক্ষ্য দেন যুবলীগ নেতা রাজার দেউরি এলাকার কে এম মজিবুল্লাহ। তিনিও কোনো আসামির নাম বলেননি। সে কারণে তাকেও জেরা করেননি আসামিপক্ষের আইনজীবীরা।
রাষ্ট্রপক্ষে তৃতীয় সাক্ষী রাজার দেউরীর চায়ের দোকানি আনোয়ার হোসেনও কারও নাম বলেননি। অথচ ১৬৪ ধারায় সাক্ষী হিসাবে হাকিমের কাছে দেওয়া জবানবন্দিতে তিনি বলেছিলেন, “সেদিন বিনয় সরকার বীনা দাদাকে বলি আমার দোকানে চা খান। তখন সে বলে- ‘নারে আমার কাজ আছে’। বীনাদা তার দেহরক্ষীসহ দ্রুত হেঁটে চলে যান। পরে পটকার মতো শব্দ শুনি। সোনার দোকানের কারিগররা বললো, কাকে যেন গুলি করতেছে। আমি দোকান থেকে উঠে দেখি ৫ থেকে ৭ জন দৌড়ে চলে যাচ্ছে।”
পরের সাক্ষী ঝুলনবাড়ি লেনের দিলীপ কুমার পাল বাদী বা রাষ্ট্রপক্ষে সাক্ষ্য দিতে এসে আসামিদের পক্ষ নেওয়ায় তাকে রাষ্ট্রপক্ষ বৈরি ঘোষণা করে এবং পাল্টা জেরা করে।
অথচ তিনি হাকিমের কাছে ১৬৪ ধারার জবানবন্দীতে ঘটনার একজন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী হিসাবে বলেছিলেন, “আসামি ভুট্টো তাকে জানায়, ‘রণজিতকে (এ মামলার আসামি) দিয়ে বিনাকে ভুট্টো ডাকাইয়া আনে, ভুট্টাই প্রথমে গুলি করে, পরে সজীব গুলি করে। সিটি করপোরেশনের কমিশনার নির্বাচনের আগে বিনয় সরকার বীনা ও ভুট্টোদের মধ্যে মারামারি হয়। সে ঘটানার জের ধরে এই হত্যা।’”
পাঁচ নম্বর সাক্ষী হলেন কেরানীগঞ্জ শুভ্যাঢার মো. দেলোয়ার হোসেন। তাকেও আসামিপক্ষ থেকে জেরার মুখোমুখি হতে হয়নি। পরের সাক্ষীদের মধ্যে তাঁতীবাজারের জীবন চন্দ্র শীল, কোতোয়ালি এলাকার নারায়ণ চন্দ্র বসাক ও তাঁতিবাজারের সমীর কুমার রায়ের সাক্ষ্যেরও একই হাল।
২০১৭ সালের ১৮ এপ্রিল প্রসন্ন পোদ্দার লেনের পরেশ চন্দ্র দাসের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়। তিনি জব্দ তালিকার সাক্ষী। তিনি ওই দিনের ঘটনার বর্ণনা দেন। কিন্তু তার সামনে জব্দ করা জিনিস অর্থাৎ গুলির খোসা এজলাসে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে উপস্থাপন করা হয়নি বলে জেরার উত্তরে জানান।
এরপর সাক্ষ্য নেওয়া হয় নিহতের কাকা নির্মল সরকারের। এই সাক্ষীর সাক্ষ্য বেশ খানিকটা আসামিদের বিরুদ্ধে যায়। সেজন্য তাকে জেরা করা হয়।
পরের দুই সাক্ষী ছিলেন তাঁতিবাজারের মো. সোহরাব আলী এবং পান্নিটোলার সুমন দত্ত। সুমনকে রাষ্ট্রপক্ষ বৈরী ঘোষণা করে উল্টো জেরা করেন।
ফলে মামলা সচল হলেও সাক্ষীর অভাবে এখন তা কার্যত গতিহীন।
বাদীকে ‘খুঁজে পাচ্ছে না’ পুলিশ
২০০২ সালের ২২ মে সন্ধ্যায় ওয়ার্ড কমিশনার বীনাকে হত্যার পর তার উপ-নির্বাচনে তার স্ত্রী সারিকা সরকার নির্বাচিত হন। তিনি থাকতেন পুরান ঢাকার ৮/১ নম্বর প্রসন্ন পোদ্দার লেনে।
কোতোয়ালি থানার এসআই মো. সালাউদ্দিন ঢাকার ২ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইবুনালে প্রতিবেদন জমা দিয়ে বলেন, সারিকা ওই বাড়িতে আর থাকেন না বলে তাকে প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই আদালতের আরেক কর্মী বলেন, “হাই কোর্টের আদেশে মামলার বিচার দীর্ঘ দিন ঝুলে থাকায় হতাশ হয়ে দেশ ছাড়েন সারিকা। তিনি ভারতে চলে গেছেন।”
চতুর্থ মহানগর দায়রা জজ আদালতের বেঞ্চ সহকারী পেশকার সাইদুল ইসলাম বলেন, “মামলাটির নথি দেখলাম। যে মামলায় বাদীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না সে মামলার ভাগ্য আর কী হবে!”
২ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইবুনালের রাষ্ট্রপক্ষের বিশেষ কৌঁসুলি সৈয়দ শামসুল হক বাদলে ভাষ্য, বিভিন্ন রকমের জটিলতার কারণে মামলাটির বিচার কাজ থমকে যায়। এখন বাদী সারিকার সাক্ষ্যের অভাবে মামলা প্রমাণ করা কঠিন হয়ে পড়বে।