”দুর্ভাগ্যবশত মানবাধিকার কমিশন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার বিরুদ্ধে অন্তত তদন্ত করতে পারে না, শুধু সরকারকে সে বিষয়ে একটি প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা বলতে পারে,” বলেন মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান।
Published : 02 Sep 2024, 01:49 AM
নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও গণতন্ত্রের মাধ্যমে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, জনগণের দৃষ্টিভঙ্গির যথার্থ বাস্তবায়ন এবং নাগরিকের মৌলিক অধিকার রক্ষা করে দেশে মানবাধিকারের উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব বলে মনে করেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন আহমেদ।
এজন্য মানবাধিকার কমিশনের শক্তিমত্তা ও আইনি কাঠামো বাড়ানোর ওপরও গুরুত্ব দেন তিনি। সীমাবদ্ধতার উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, ”দুর্ভাগ্যবশত মানবাধিকার কমিশন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার বিরুদ্ধে অন্তত তদন্ত করতে পারে না, শুধু সরকারকে সে বিষয়ে একটি প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা বলতে পারে।”
কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে প্রায় পৌনে দুই বছরের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তিনি বলেন, “আমি বলতে পারি যে বাংলাদেশে অনেক রকমের আইন আছে, প্রয়োগ সত্যিই যথেষ্ট নয়। এই মুহূর্তে অনেক ক্ষেত্রেই ফ্রেমওয়ার্ক রয়েছে, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বাস্তবায়ন কম হচ্ছে, আমি বলব।”
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের আলোচনা অনুষ্ঠান ইনসাইড আউটে অংশ নিয়ে তিনি এসব কথা বলেন।
মানবাধিকার কমিশন যাতে আরও ভালো কাজ করতে পারে সেজন্য সত্যিকার অর্থে এটিকে শক্তিশালী করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব বলেও অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন তিনি।
২০২২ সালের ডিসেম্বরে কমিশনের দায়িত্ব নেওয়া কামাল উদ্দিন বলেন, “আমি মনে করি বর্তমান সরকার নিরপেক্ষ সরকার, অন্তর্বর্তী সরকার। মানবাধিকার কমিশন যাতে শক্তিশালী হয় সেদিকে তাদের নজর দেওয়া উচিত।”
আগের সরকারের আমলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, কারাগারে নির্যাতন ও বিরোধী মতের মানুষের ’গুমের’ শিকারের ঘটনা বারবার আলোচিত হলেও শেখ হাসিনা সরকার তা অস্বীকার করে গেছে; একইরকম অভিযোগ আসে অন্যান্য সরকারের বেলায়ও, এমতাবস্থায় দেশের মানবাধিকারের উন্নয়ন কীভাবে?
এমন প্রশ্নে কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, “গণতন্ত্রের মাধ্যমে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা যায়, জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়। এভাবেই সম্ভব।
“একই সাথে মৌলিক অধিকারগুলো যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা। এটি যদি করা যায়, আশা করি, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার করা সম্ভব।”
রোববার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ফেইসবুক পেইজ ও ইউটিউব চ্যানেলে সম্প্রচার করা হয় ইনসাইড আউটের এই পর্ব।
ছাত্র-জনতার প্রবল গণ আন্দোলনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ওই সরকারের ১৫ বছরের আমলে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে ‘গুম, খুন, নির্যাতনের’ মত অপরাধের বিষয় সামনে আসছে। অনেকেই সেসব অজ্ঞাত স্থান থেকে বেরিয়ে এসে সংবাদমাধ্যমের কাছে তাদের অভিজ্ঞতার কথা জানাচ্ছেন।
এ প্রসঙ্গে সাবেক সচিব কামাল উদ্দিন বলেন, “আগের সরকার আর যেকোনো সরকারই করুক, এটা সম্পূর্ণ ‘বেআইনি’। এটা বন্ধ করতে হবে এবং এটাকে জনগণের নজরে আনতে হবে।”
“নিঃসন্দেহে বাধ্যতামূলকভাবে নিখোঁজ হওয়া বেআইনি, নির্যাতনমূলক এবং এটি চলাচলের স্বাধীনতাকে লঙ্ঘন করে এবং ‘বেশ দুর্ভাগ্যজনক’।”
এখনও অনেকের ‘নিখোঁজের’ বিষয়ে শোনার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “তাদের পরিবারের দুর্ভাগ্যজনক অবস্থা শুনে আমি সত্যিই হতবাক হয়েছি। মা বলছেন, যে তিনি রাতে ঘুমাতে পারেন না। কোথাও কোন শব্দ শুনলে মনে হয়, এই বুঝি তার ছেলে আসছে। বছরের পর বছর ধরে এই যন্ত্রণা সে সহ্য করে যাচ্ছে।”
এতকিছুর পরও কমিশন কোনো তদন্ত করেছে কি না বা আগের অভিযোগের সময় কমিশনের ভূমিকা বিষয়ক প্রশ্নে তিনি কমিশনের সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরেন। বলেন, “দুর্ভাগ্যবশত মানবাধিকার কমিশন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার বিরুদ্ধে অন্তত তদন্ত করতে পারে না, যেখানে অন্যান্য মানবাধিকার লঙ্ঘন মামলার ক্ষেত্রে জোরেশোরে তদন্ত করতে পারে।
“কিন্তু যদি এটি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার বিরুদ্ধে হয়, তবে মানবাধিকার কমিশন শুধু সরকারকে সে বিষয়ে একটি প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা বলতে পারে।”
এসময় জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন, ২০০৯ এর ধারা তুলে ধরে কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, “মানবাধিকার কমিশন আইন অন্য কোন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার বিরুদ্ধে কোনও তদন্ত করার অনুমতি দেয় না।
“সুতরাং এটি একটি বড় ত্রুটি। এবং আমি মনে করি যে এটি সংশোধন করা উচিত এবং আমরা এই সংশোধনের জন্য ও বিধানের জন্য প্রস্তাবও করেছি।”
মানবাধিকার কমিশনকে এসব বিষয় তদন্ত করার অধিকার বা সুযোগ দেওয়া যেতে পারে এবং অপরাধীকে খুঁজে বের করতে এবং সরকারকে ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া যেতে পারে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
আগের সরকারের আমলে তৈরি হওয়া ‘আয়নাঘর’ ঘুরেফিরে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আলোচনায় আসে। জোরপূর্বক আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে তুলে নিয়ে বন্দি ও নির্যাতনের অভিযোগ করেছেন স্বজনরা।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ৫ অগাস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে গেলে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চাওয়ার ভিত্তিতে নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস এ সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেন। এরপরই ‘গুম’, অজ্ঞাত বন্দিশালায় আটক, ‘আয়নাঘরের’ পেছনের কারিগরদের বিচার ও মুক্তির দাবি জোরালো হয়।
প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশে ভাষণে সেনা, পুলিশ, বিজিবি, র্যাবসহ সরকারি বাহিনীর যেসব সদস্য ‘গুম, খুন, নির্যাতনের’ মত অপরাধে যুক্ত ছিলেন, তাদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনার ঘোষণা দিয়েছেন।
এমন প্রেক্ষাপটে ‘আয়নাঘর’ ও এসব নির্যাতন সেল নিয়ে মানবাধিকার কমিশন তদন্ত করবে কি না জানতে চাইলে এক সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিবের দায়িত্ব সামলে আসা কামাল উদ্দিন বলেন, “আয়নাঘর ইস্যু-এসব গত কয়েক মাসেই সামনে এসেছে। এবং যে খুব নির্দিষ্ট তা না।
“সম্প্রতি আমরা স্পষ্টভাবে জানতে পেরেছি কিছু লোক ওই জায়গা থেকে বের হয়ে এসেছে। তবে সেটাও অনেক জায়গার কথা বলা হচ্ছে।
“একটি নির্দিষ্ট গোয়েন্দা অফিসে সেটি অবস্থিত হলেও তারা অন্তত পাঁচটি ভিন্ন জায়গায় মাইকেল চাকমাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে সাক্ষাৎকারে তুলে ধরেছেন এই আদিবাসী। যেসব তথ্য তার কাছ থেকে পাওয়া গেছে এটা বিভিন্ন জায়গায় হতে পারে। সুতরাং আমরা যদি বিবেচনা করি যে সেগুলো গোয়েন্দা সংস্থা বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, সেখানে আমাদের কিছু করার নেই। তার মানে আমরা সেখানে তদন্ত করতে পারি না ।”
‘তুলে নেওয়ার’ পাঁচ বছর পর ফিরে এসেছেন ইউপিডিএফ নেতা মাইকেল চাকমা। ‘আয়নাঘরে’ বন্দি থেকে তার ফিরে আসার তথ্য তুলে ধরে বিবৃতিতে সংগঠনটি বলেছে, সরকার পতনের দুইদিন পর ৭ অগাস্ট ভোরের দিকে চট্টগ্রামের একটি স্থানে তাকে চোখ বাঁধা অবস্থায় ছেড়ে দেওয়া হয়।
২০১৯ সালের ৯ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর এলাকা থেকে সাংগঠনিক কাজ শেষে ঢাকায় ফেরার পথে মাইকেল চাকমাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় বলে তার পরিবার ও দল অভিযোগ করে আসছিল। এরপর থেকে তার কোনো হদিস মিলেনি। তখনকার সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য দেওয়া হয়নি।
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ওই আমলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ‘গুমের’ ঘটনা তদন্তে হাই কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।
এ প্রসঙ্গে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন বলেন, “তারা যদি এটি করতে পারে, আমি আশা করি সত্য বিষয়গুলো প্রকাশ পাবে। মানুষ জানতে পারবে কীভাবে মানুষ এখানে আবদ্ধ ছিল।
“আমরা এ বিষয়গুলোর সমস্ত বিবরণ আমাদের দেওয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি নির্দেশনা পাঠিয়েছি। কত লোক সেখানে বন্দি ছিল। কী অবস্থা ছিল তাদের। আর কোন আইনি কাঠামোর আওতায় তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, কেনই বা সেখানে আটকে রাখা হয়েছে।
“এবং অন্য কোনো নিখোঁজের তথ্য এখনও আছে কিনা, তাদের কেউ নিহত হয়েছেন কি না। কারণ এখনও অনেকে তাদের পরিবারের কাছে আসেনি। এ নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ হচ্ছে। এটা বেশ ‘দুর্ভাগ্যজনক’।”
তিনি বলেন, “এখনও পরিবারগুলো তাদের খুঁজে পাচ্ছে না অথচ বিগত সরকারের পতন হয়েছে এবং নতুন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে।”
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধন করতে হবে মত দিয়ে কামাল উদ্দিন বলেন, “আমরা আমাদের মন্তব্য পাঠিয়েছি এবং সিএসএ ও ডিএসএ এর বিষয়ে আমাদের স্পষ্ট মতামত প্রকাশ করেছি, মানে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধন করতে হবে। সত্যিই এমন হতে হবে যে বাক স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়।”
কিন্তু কমিশনের এই প্রস্তাব এখনও মূলতুবি আছে বলেও তুলে ধরেন তিনি।
বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধে বৃহত্তর আইনি কাঠামোর প্রয়োজনীতার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আপনি যদি মনে করেন যে কনভেনশনে স্বাক্ষর করার পরে এটি আরও কার্যকর করার জন্য, সেখানে দীর্ঘ হতে পারে। সন্দেহ নেই। কিন্তু আমি বলতে পারি যে বাংলাদেশে অনেক রকমের আইন আছে, প্রয়োগ সত্যিই যথেষ্ট নয়। আপনি যদি কনভেনশনের দৃষ্টিকোণ থেকে, আপনি যদি আরও ভাল বাস্তবায়ন করতে চান, আমি বরং বলব যে বৃহত্তর আইনি কাঠামো বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে।”
বাংলাদেশের পেনাল কোডে অপহরণ, অন্যায়ভাবে আটক, নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু প্রতিরোধ আইন, কারাগারে মৃত্যু এবং নির্যাতনের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তির জন্য সুনির্দিষ্ট বিধান রয়েছে। অবৈধ বন্দিত্ব, জোর করে গুম করার বিরুদ্ধেও বিধান থাকার কথা বলেন তিনি।
তাহলে কমিশন কী করে?
কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, “যখন আমরা এই ধরনের পরিবার থেকে, সমাজের লোকদের কাছ থেকে অভিযোগ পাই এবং আমরা সেই অভিযোগগুলো গ্রহণ করি এবং আমাদের বেঞ্চে সেগুলি নিয়ে আলোচনা করি, আমরা বিষয়টি তদন্তের জন্য তদন্ত কমিটি গঠন করি এবং তদন্ত করা হয়।
“তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল দুর্ভাগ্যবশত এটি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দ্বারা করা হলে কিছুই করার নেই।”
তিনি বলেন, “বছরের পর বছর ধরে এই গুম বা বিচারবহির্ভূত হত্যা ছাড়াও আরও অনেক কিছু রয়েছে। আমি যদি বলি, খুন, বিভিন্ন জায়গায় খুন, মানুষ খুন, ধর্ষণের মামলা, যৌতুকের জন্য নির্যাতন, তারপর নারীর প্রতি পারিবারিক সহিংসতা, দাম্পত্য জীবন সহিংসতা, বিবাহবিচ্ছেদ এবং এর সাথে সম্পর্কিত মামলার সংখ্যা ও বিষয়।
“শিশু হত্যা, শিশু ধর্ষণ, নির্যাতন, বাল্যবিবাহের মতো জিনিস যা আমাদের সমাজের অন্যতম পাপ।”
কারণ হিসেবে তিনি বলেন, “পরিবারের পক্ষ থেকে বিশেষ করে শিশু নারীদের বিয়ে দেওয়া হয় সে সময় সে না করতে পারে না। কিছু দিন পর তাকে শ্বশুর পরিবারে অসংখ্য নির্যাতনের সম্মুখীন হতে হয় এবং তার জীবন তৎক্ষণাৎ দুর্ভাগ্যজনক হয়ে পড়ে। সে স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করতে পারে না। কারণ সে অতটা শিক্ষিতও নয়।”
মানবাধিকার সমুন্নত রাখায় অবদান কী?
মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, “আমাদের কাছে বাল্যবিবাহ একটি বড় মামলা, যা আমরা মানবাধিকার কমিশন থেকে মানবাধিকারের বড় লঙ্ঘন হিসেবে গ্রহণ করেছি। আমরা বিভিন্ন জেলায় বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছি, জনগণকে বোঝানোর চেষ্টা করছি, অধিকার লঙ্ঘনের এই সুস্পষ্ট অবসান ঘটাতে কাজ করেছি।
”সেখানে অনেক পরিশ্রম করার পর আমরা কিছু গ্রাম ‘বাল্যবিবাহমুক্ত’ হিসেবে ঘোষণাও করেছি।
“এই মুহূর্তে আমাদের কমিশন, মানে মেয়াদ বেশি নয় আমরা প্রায় দেড় দশক ধরে কাজ করছি। এর মধ্যেই আমরা স্পষ্ট করেছি যে তদন্তের মাধ্যমে, প্রেরণার মাধ্যমে এবং বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে ২৭০টি গ্রাম আমরা ‘বাল্যবিবাহমুক্ত’ গ্রাম ঘোষণা করেছি।”
বাংলাদেশ বিশ্বের এমন একটি দেশ যেখানে বাল্যবিবাহের সংখ্যা এখনও অনেক বেশি জানিয়ে বলেন, “এটি ক্রমেই বাড়ছে, বাল্যবিবাহ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য সমাজে বড় অবদান রাখছে কমিশন।”
‘গার্হস্থ্য স্বাস্থ্যে’ নির্যাতন আরেকটা দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হিসেবে চিহ্নিত করে তিনি বলেন, “অনেক পরিবারে আমরা দেখতে পাই যেখানে গৃহকর্মীর ওপর নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। তারা কিছু করতে অসহায়। তাই আমরা তাদের পাশে আছি। আমি বলতে চাচ্ছি যে জমি বা বাসার মালিক নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য করছি। এটা অনেক ক্ষেত্রে ঘটেছেও।”
শারীরিক শাস্তির বিভিন্ন হাতিয়ার থাকার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আপনারা হয়তো দেখেছেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়েও যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন, শিক্ষকরা ছাত্রীদের হয়রানি করছেন, আমরা তাদের পাশে দাঁড়িয়েছি। আমরা আইন প্রণয়ন করেছি এবং সংসদে আইন পাসের জন্য জমা দিয়েছি।
“কখনও কখনও আমরা দেখেছি যে ছাত্ররা তাদের দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছে, আরও কিছু দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি তাদের শরীরে ঘটেছে।”
এছাড়াও পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়েও কমিশন কাজ করছে বলে তুলে ধরেন তিনি।
কামাল বলেন, “পুলিশের বিরুদ্ধে দায়ের করা অভিযোগের সংখ্যা অনেক। সময়মত পুলিশ জনগণের কথা শোনে না, ঘুষ নেয় বা জনগণকে গালি দেয় বা কিছু মানুষকে নির্যাতন করে। সেই বিষয়গুলোও আমরা বিবেচনায় নিয়েছি।
“সাংবাদিক নির্যাতনের বিপক্ষেও কাজ করছি। আপনাদের মনে আছে জামালপুরে সাংবাদিক নাদিমের কথা। বিরুদ্ধে লিখেছিলেন বলে কিছু লোক নাদিমকে হত্যা করেছিল। অপরাধী তখনকার ক্ষমতাসীন দলের সদস্য ছিলেন এবং পরে তাকে দল বহিষ্কার করে।
“জামালপুরে তার বাসায় গেলাম। এবং সঠিক বিচারের জন্য আমরা অপরাধীদের গ্রেপ্তার করি। বিভিন্ন স্থানে অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে বিচার চলছে। তাদের বিচার হবে।”
এরকম অনেক সফলতা থাকার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “যেখানে সাংবাদিকদের ওপর হামলা হয়েছে এবং আমরা তাদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের পক্ষে কথা বলেছি।
“এছাড়াও সংখ্যালঘু নির্যাতন। বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুদের মন্দিরে হামলা হয়েছে। তাদের মূর্তি ভাঙা হয়েছিল সেগুলোও বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। আমরা ঠাকুরগাঁও, কুমিল্লায় গিয়ে বিচার নিশ্চিত করি।”
নিজেদের কাজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, “তেলেগু পল্লিতে পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও ঝাড়ুদারদের স্কুল ভাঙা হয়েছে। তাদের চার্চ ভেঙে ফেলা হয়েছিল। তাদের উচ্ছেদ করা হয়। আমরা সরাসরি, আমি ব্যক্তিগতভাবে সেখানে গিয়ে সিটি কর্পোরেশনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করি। কিন্তু তারা কথা শোনে না।
”আমি মেয়রের সাথে কথা বলেছি এবং শেষ পর্যন্ত তা বন্ধ করে দিয়েছি। এখন বিল্ডিং নির্মাণ করা হচ্ছে এবং তারা উন্নত বাসস্থান পাচ্ছে।”
তিনি বলেন, ”বয়স্কদের অধিকার, জমির অধিকার, এ ধরনের বিষয় নিয়েও কমিশনের কাজ করে। আমরা কাজ করছি। দরিদ্র, প্রান্তিক মানুষদের সহায়তা করার জন্য আমাদের আইনজীবী রয়েছে। যেকোনো ধরনের অধিকার হোক সেটা। এছাড়াও অভিবাসী শ্রমিকদের অধিকার।
”তাদের মানবাধিকারের ব্যাপারে আমরা তাদের সেবা দিচ্ছি। কমিশনে চারটি বেঞ্চ রয়েছে। প্রতি সপ্তাহে প্রায় ১০০টি মামলা হয়। বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি পদ্ধতিও আছে। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং আমরা এই বিষয়ে সেবা দিয়ে থাকি। অনেক মানুষ খুশি যে আমরা তাদের সমস্যা মোকাবেলা করছি, সেবা দিচ্ছি এবং এটা করছিও আমরা মানবিক আচরণের মাধ্যমে। তাদের এক পয়সাও দিতে হয়নি।”
‘পর্যাপ্ত’ জনবল নেই
চেয়ারম্যান বলেন, মানবাধিকার কমিশন জাতিসংঘের একটি ম্যান্ডেট সংস্থা। আইনে বিধান রয়েছে যে, রাজধানীতে কেন্দ্রীয় সদর দপ্তর, বিভাগীয় কার্যালয়, ৬৪টি জেলায় কার্যালয় থাকবে। ৪৯২টি উপজেলা অফিসের কথাও বলা আছে। যদি প্রধান অফিসের মত সৎ, সিনসিয়ার অফিসার এবং একেবারে ভাল অফিসে সততা নিশ্চিত করা এবং কোন কিছুর অভাব না থাকত তাহলে দেশে কোনো অভিযোগই থাকত না।
“আমরা যদি দেশে এরকম অফিস করতে পারতাম, এটা সত্যিই কাজ করতে পারত।
“কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এমনকি আমাদের কেন্দ্রীয় সদর দফতর, যা একটি ভাড়া ফ্লোরে। শতাধিক মামলা, শতাধিক বিভিন্ন জিনিস দেখাশোনার জন্য মাত্র একটি ফ্লোর এবং আমাদের মাত্র তিনটি আলাদা অফিস আছে। অন্য কোনো বিভাগীয় অফিস, অন্য কোনো জেলা অফিস, অন্য কোনো উপজেলা অফিস নেই। আমরা এভাবেই পারফর্ম করছি।”
মানবাধিকার কমিশনকে সত্যিকার অর্থে শক্তিশালী করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব মন্তব্য করে তিনি বলেন, ”যাতে এটি সত্যিই আরও ভালো কাজ করতে পারে। আমরা মন্ত্রণালয়ে আরও ভালো সেটআপ দিয়ে নতুন অর্গানোগ্রাম জমা দিয়েছি। আমরা বলছি না যে আগামীকাল উপজেলা অফিস লাগবে। ধীরে ধীরে অফিসের সংখ্যা বাড়ানো হোক। বিশেষ করে বিভাগীয় অফিসে যাতে আমরা আরও ভালোভাবে কাজ করতে পারি।
“আমি মনে করি বর্তমান সরকার নিরপেক্ষ সরকার, অন্তর্বর্তী সরকার। মানবাধিকার কমিশন যাতে শক্তিশালী হয় সেদিকে তাদের নজর দেওয়া উচিত।”
মুক্তি মিলবে কীভাবে?
মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, গণতন্ত্রের মাধ্যমে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা যায়। এতে জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবায়ন হয়। এভাবেই সম্ভব।
সরকারের গুম সনদে সই করার কথা তুলে ধরেন তিনি বলেন, “যখন এটি পুনর্বিবেচনা করা হবে, এটি আমাদের অভ্যন্তরীণ আইনের একটি অংশ হয়ে যাবে। এই কারণেই আমরা মনে করি যে, এই কনভেনশনের মাধ্যমে জাতিসংঘ কর্তৃক নির্দিষ্ট রাষ্ট্রের উপর যে শর্ত আরোপিত হবে, তাতে আইনি কাঠামো তৈরি হবে।
“তাই আমরা দেখব যে দেশের জনগণ এমন সুবিধা ভোগ করবে যাতে তাদের আন্দোলনের অধিকার লঙ্ঘন না হয়। অপ্রয়োজনীয় সীমাবদ্ধতার শিকার না হয়, বা আইনগত ভিত্তি ছাড়াই বন্দি না হয় এবং যদি কাউকে বিনা কারণে বা বেআইনিভাবে বন্দি অবস্থায় পাওয়া যায়, তাহলে অবশ্যই বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। একই সাথে সঠিক তদন্ত করতে হবে এবং সেই ব্যক্তিকেও ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
“এগুলোই মূল বিষয় এবং রাষ্ট্র দেখবে, রাষ্ট্র নজরদারিতে থাকবে। কোনো দেশ কাউকে বেআইনিভাবে আটকে রাখতে বা কোনো ধরনের নির্যাতন বা মৃত্যুদণ্ড দিতে পারে না।”