“দাম আগের মতই আছে, সাইজ একটু কমাইছি। না হলে তো চলতে পারব না; জিনিসপত্রের দাম যেমনে বাড়তেছে, চলা লাগব না?,” বলেন এক বিক্রেতা।
Published : 01 Jan 2025, 11:35 PM
ঢাকার মিরপুরের ঈদগাঁ মাঠে চিতই পিঠা কিনছিলেন বেসরকারি চাকরিজীবী মাহবুবুর রহমান, পাঁচ সদস্যের পরিবারের জন্য ১০টি পিঠা কিনতে আসলেও অর্ডার দিলেন ১৫টি।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বললেন, “দুইটা করে নেব ভাবছিলাম। এখন পিঠার সাইজ যা দেখতেছি; আরও বেশি নিতে হবে।”
তার ভাষ্য, “এমন দুইটা পিঠা খাওয়া যা, না খাওয়াও তাই। আগে একটা পিঠা খেলেই তৃপ্তি আসত, এখন সাইজ ছোট হওয়ায় একটাতে হয় না।”
শীত মৌসুমের শুরু থেকেই রাজধানীর আনাচে-কানাচে চলে পিঠা বিক্রির ধুম। চিতই আর ভাপা থেকে শুরু করে হরেক রকমের পিঠা বিক্রি হয় রাস্তার ফুটপাত কিংবা মোড়ের দোকানগুলোতে। সঙ্গে থাকে ধনিয়া পাতা আর শুটকি ভর্তা শুরু করে বাহারি ভর্তা।
বন্ধুবান্ধব কিংবা পরিচিতজনদের নিয়ে শীতের পিঠার স্বাদ নিতে সন্ধ্যা বেলায় ভিড় করেন অনেকেই। পিঠা খাওয়ার সঙ্গে চলে গল্প আর আড্ডা। যদিও এবার যারা পিঠা খেতে প্রথম এসেছেন তাদের অনেকেই ভ্রূ কুঁচকাচ্ছেন।
তারা বলছেন, আগের চেয়ে পিঠার আকার হয়ে গেছে ছোট, আগের স্বাদও নেই। আর বিক্রেতারা বলছেন, চালের দাম বাড়লেও পিঠার দাম বাড়ানোর সুযোগ নেই, ফলে আকার হচ্ছে ছোট। সেইসঙ্গে পিঠা বানানোর বিভিন্ন অনুষঙ্গের দামও বেশি হওয়া পিঠায় সেগুলোর পরিমাণ থাকছে কম। সেটির প্রভাব পড়ছে স্বাদেও।
প্রায় দুই যুগ ধরে মিরপুর-১২ নম্বরের ঈদগাঁ মাঠে পিঠা বানিয়ে আসছেন শেফালী বেগম। আয় ভালো হওয়ায় এবারও প্রত্যেক সন্ধ্যায় বসছেন দোকান নিয়ে।
তবে গতবারের চেয়ে এবার চাল, নারকেল আর গুড়ের দাম বেশি হওয়ায় পিঠার দাম না বাড়িয়ে আকার ছোট করার কথা বললেন তিনি।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে শেফালী বলেন, “দাম আগের মতই আছে, সাইজ একটু কমাইছি। না হলে তো চলতে পারব না। জিনিস পত্রের দাম যেমনে বাড়তেছে। চলা লাগব না? আর দাম বাড়াইলে তো মানুষ খাইব না। একটা পিঠা কেউ ১৫ টাকা দিয়ে নিতে চাইবে না।”
পল্লবীর পিঠা বিক্রেতা মোবারক হোসেন বলেন, বর্তমানে আতপ চালের দাম কেজিতে ২ থেকে ৫ টাকা বেড়েছে। ফলে ভাপা পিঠার দাম ১০ টাকা বাড়িয়ে ২০ টাকা করেছেন তিনি।
“লস লাভ হইলেও ব্যবসা করে খাইতে হবে। ভাপা পিঠা তো বেচাই যায় না। কয় দাম বেশি, নিতে চায় না। খরচ আছে, একটা নারিকেল ১৫০ টাকা, গুড়ের দাম আছে।
“লোকজন ১০ টাকার পিঠা চায়, কিন্তু নারিকেল-গুড় ছাড়া কেউ খাইতে চায়? ১০ টাকার পিঠাতে তো নারিকেল-গুড় দিয়ে কুলাইতে পারব না। জিনিসপত্রের দাম বাড়তেই আছে।”
মহাখালীতে চিতই পিঠা বিক্রি করেন মায়া। চালের গুড়া কিনে পিঠা বানান তিনি। গতবারের চেয়ে এবার চালের গুড়ার দাম বাড়ার কথা বলছেন তিনি।
তিনি বলেন, “আমি তো বাড়াতে কমাতে পারি না, যা করার তারাই (চাল বিক্রেতারা) করে। দাম বাড়াইলে তো আমার কাস্টমার কমে যাবে।”
বর্তমানে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় চিতই পিঠা ১০ টাকা, ডিম চিতই ৩০ টাকা, তেলের পিঠা ১০ টাকা আর ভাপা পিঠা ১০ টাকা থেকে ২০ টাকাতেও বিক্রি হচ্ছে।
চড়া আতপ চালের দাম
ঢাকার মহাখালী কাঁচাবাজারের মানিক ট্রেডার্সের মালিক মানিক গত বছর পিঠা বিক্রির মোটা আতপ চাল ৫০/৫৫ টাকায় বিক্রি করলেও এবার ৬০ টাকা করে বিক্রির কথা বলছেন তিনি।
তিনি বলেন, “ডিসেম্বরের শুরুতে দাম বাড়ছে। এ কারণে বিক্রি কমে গেছে। (পিঠা বিক্রেতারা) এক বস্তা নিত আগে, এখন পাঁচ কেজি নেয়। সব জিনিসের দামই বেশি, মানুষের অবস্থা ভালো না। যে যেটা করে সেটাই মন্দা।”
সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) এর হিসেবে, মানভেদে সপ্তাহের ব্যবধানে চালের দাম কেজিতে বেড়েছে দুই থেকে চার টাকা। বছরের হিসেবে মোটা চালের দাম বেড়েছে ৭ দশমিক ১৪ শতাংশ।
আতপ চাল কেজিতে গতবারের চেয়ে এবার ৫ টাকা বাড়ার তথ্য দিয়ে মিরপুর-১২ নম্বরের মুসলিম বাজারের চাল বিক্রেতা মোহাম্মদ রুবেল বলেন, এখন তিনি ৫৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছেন।
তার ভাষ্য, “আতপ চালের বস্তা আগে ২ হজার ৪০০ টাকা থেকে ২ হাজার ৪৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এখন ২ হাজার ৬০০ থেকে ২ হাজার ৬৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। আমরা এমন দামে বিক্রি করতেছি। বস্তায় ২০০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত দাম বাড়ছে।”
মহাখালী কাঁচাবাজারের মেসার্স আজাদ ট্রেডার্সের মালিক সোলাইমান সরকার বলেন, মোটা আতপ চাল তার দোকানে বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকা কেজিতে। গত বছর বিক্রি করেছেন ৫০/৫২ টাকা কেজিতে।
“এখন বাজার বাড়ছে। ডিসেম্বরের সপ্তাহখানেক পরেই বাড়তি। এ বছর দামটা একটু বেশিই। বাড়ার কারণে কাস্টমার হিমশিম খায় কিনতে, আসে না। আমরা কী করুম! আমরা তো আনি বেচি।”
কমেছে পিঠা বিক্রি
চালের দামসহ পিঠার অন্যান্য অনুষঙ্গের দাম বাড়ার পাশাপাশি বিক্রেতা বেড়ে যাওয়ায় বিক্রি কমার কথা বলছেন পিঠা ব্যবসায়ীরা। পিঠার আকার আর স্বাদ কমার কমে যাওয়াকেও এর কারণ বলছেন তাদের কেউ কেউ।
মিরপুর ঈদগাঁ মাঠের পিঠা দোকানি শেফালী বলেন, “অবস্থা এখন ভাল না, ভাল ছিল আগে। আগের মত বিক্রি হয় না। জিনিসের দামও বেশি, দিনে ৩ হাজার টাকা বিক্রি হত, এখন এক হাজার টাকা বিক্রি হয়।”
তিনি বলেন, “দোকান পাট বেড়ে গেছে না, পেট তো সবারই আছে। কী কাজ করে খাইব, পিঠার দোকান দিয়ে বসে থাকে। আগে তো এলাকায় এত দোকান ছিল না, এখন তো অনেক দোকান হইছে। আরও অনেক জাতের দোকানও হইছে।”
পিঠা বিক্রেতা মোবারক হোসেন বলেন, আগের চেয়ে অর্ধেক কমে গেছে বিক্রি। আগে মনে করেন মানুষের মধ্যে খাওয়ার আগ্রহ ছিল, আসত। এখন খাওয়ার মানুষ নাই। আগে এসময় অনেক মানুষ থাকত, এখন মানুষই নাই। রাত ৯টায় দোকান গুটাইয়া চলে যাইতে হয়।
মহাখালীর পিঠা বিক্রেতা মায়া বলেন, “গত বছরের তুলনায় কমই এবার কাস্টমার। বেশি কাস্টমার আসে না আগের মত। কোনো জায়গাতেই আসে না। পিঠা বানাতে যতটুকু রেডি করি, এর অর্ধেক প্রায়ই বাসায় নিয়ে যাইতে হয়।”
সেখানে পিঠা কিনতে আসা মানোয়ার মাহমুদ বলেন, “এখন পিঠা অনেক ছোট হয়ে গেছে। শীত কাটানোর যে ফ্লেভারটা পিঠা খেয়ে, সেটা আর নাই, হারিয়ে গেছে। ম্যাটারিয়ালসও কম দেয়। ১০ টাকা দিয়ে একটুকু পিঠা খেয়ে লাভ নাই তো।”
আরেক গৃহিণী শাহনাজ পারভীন বলেন, ফুটপাতের পিঠার দোকানগুলোতে ভালো জিনিস না পাওয়ার কারণেও পিঠা কিনতে কম আসা হয়।
“আগের পিঠা অনেক টেস্ট হত। এখন ভালো জিনিস দেয় না। এক দোকানের পিঠা ভালো লাগলে, তিন দোকানের পিঠাই ভাল লাগে না। একদিন খেয়ে দেখি টক লাগতেছে।”
তিনি বলেন, “আগে পিঠার দোকান দেখলেই থেমে খেতে ইচ্ছা করত, এখন সামনে দিয়ে চলে যাই; খুব কম খাওয়া হয়। শীত আসলেই পিঠা খাওয়ার একটা ইচ্ছা থাকত, সবাই মিলে খেতাম; পিকনিকের মত।”