দ্রব্যমূল্য ও জীবন যাপনের ব্যয় বিবেচনা করে জাতীয় মজুরি আইন ঘোষণার দাবি এসেছে মে দিবসের সমাবেশে।
Published : 01 May 2024, 02:28 PM
আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবসে রাজপথে জড়ো হয়ে ন্যায্য অধিকারের পুরনো দাবিগুলো আরো একবার তুলে ধরেছে শ্রমিক সংগঠনগুলো।
দ্রব্যমূল্য ও জীবন যাপনের ব্যয় বিবেচনা করে জাতীয় মজুরি আইন ঘোষণা ও বাস্তবায়নের পাশাপাশি শ্রমিকদের মতামত উপেক্ষা করে সংসদে তোলা শ্রম আইন ও অত্যাবশ্যক পরিষেবা বিল প্রত্যাহারসহ ৯ দফা দাবি জানানো হয়েছে দিবসের জমায়েত থেকে।
তাপদাহ উপেক্ষা করে বুধবার সকাল থেকে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের কর্মীরা মাথায় লাল পট্টি, হাতে বিভিন্ন দাবি সম্বলিত ব্যানার-ফেস্টুন আর পতাকা, গায়ে নিজ নিজ শ্রমিক সংগঠনের টি-শার্ট জড়িয়ে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে জড়ো হতে থাকেন।
সেখানে অবস্থান ও বক্তব্যের পর বেলা ১১টার দিকে মিছিল যায় পল্টন মোড়ে। মিছিলের স্রোত গিয়ে মেলে শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের (স্কপ) সমাবেশে প্রাঙ্গণে। সেখানে একে একে মিছিল নিয়ে যোগ দেন স্কপের ১২টি জাতীয় ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনের শীর্ষ নেতারা।
সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করে স্কপ নেতারা কর্মীদের নিয়ে মিছিল বের করেন।
জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ট্রেড ইউনিয়ন সংঘের সভাপতি চৌধুরী আশিকুল আলম চৌধুরী স্কপ সমাবেশে এবারের মে দিবসের ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। সেখানে বলা হয়, ১৩৮ বছর পর এবারের মে দিবস শ্রমজীবীদের সামনে আরও অনেক চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছে।
“বাংলাদেশে ৭ কোটি ৩৬ লাখ শ্রমশক্তির ৮৫ শতাংশ অপ্রতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করে। তাদের শ্রম ঘণ্টা, ন্যায্য মজুরি, কাজের নিশ্চিয়তা এবং নিরাপত্তা কোনটাই নাই। সেক্টর ও মালিকানা নির্বিশেষে সকল শ্রমিকদের দীর্ঘদিনের দাবি জাতীয় মজুরি আইন নিয়ে চলছে দীর্ঘসূত্রতা। শ্রমিকদের সংগঠন করার স্বাধীনতাকে নানাভাবে সঙ্কুচিত করে রাখা হয়েছে। সর্বশেষ শ্রমিকদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সর্বোচ্চ উপায় হিসেবে ধর্মঘট করার অধিকারও অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা আইনের খড়্গের নিচে।
“জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সামগ্রিক বাস্তবতায় বাংলাদেশর শ্রমিক-কর্মচারীদের সংগ্রামের সংস্থা শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের সামনে ঐতিহাসিক দায়িত্ব হল, প্রাতিষ্ঠানিক অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের সকল শ্রমিককে ঐক্যবদ্ধ করে ধারাবাহিক আন্দোলন গড়ে তোলা।”
মে দিবসে সকল শ্রেণির শ্রমিককে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান আশিকুল আলম চৌধুরী।
স্কপের ৯ দফা দাবিগুলো হল-
• ৮ ঘণ্টা কর্ম দিবস বাস্তবায়ন
• আউট সোর্সিং বন্ধ করা
• অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা বিল প্রত্যাহার
• ধর্মঘটের গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব না করা
• আইন করে জাতীয় ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা এবং সেক্টার ভিত্তিক মজুরি নির্ধারণ
• শ্রমিকদের রেশন, আবাসন, শ্রম আইনের অগণতান্ত্রিক ধারাসমূহ বাতিল করে গণতান্ত্রিক শ্রম আইন প্রবর্তন
• প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক এবং মালিকানা নির্বিশেষে ইপিজেড, ইডিজেডসহ সকল সেক্টরের শ্রমিকদের অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার প্রদান করা
• শ্রমিকদের পেশাগত স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা
• কর্মক্ষেত্রে নিহত-আহতদের ন্যায্য ক্ষতিপূরণ দেওয়া।
স্কপের সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন জোটের যুগ্ম সমন্বয়কারী মইনুল আহসান জুয়েল। তিনি বলেন, “এই মহান মে দিবস আমরা পালন করি, কিন্তু আমরা লক্ষ্য করি, সরকার আসে সরকার যায়, শ্রমিকের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয় না। আজকে দ্রব্যমূল্যের ঊধর্বগতি চরমে, শ্রমিকেরা দুই বেলা ভাত জোটাতে পারছে না।
“আর সরকার বার বার বলছে, উন্নয়নের জোয়ারে বাংলাদেশ ভাসছে। কিন্তু শ্রমিকদের সমাজিক নিরাপত্তার জায়গায় এখনো তারা তৈরি করতে পারছে না। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও আমরা শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি আদায় করতে পারিনি। সরকার বার বার টালবাহানা করছে।”
শ্রমিক সংগঠনের নেতারা বলছেন, বাজার দরের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বাঁচার মত মজুরি নির্ধারণের কথা উঠলেই শিল্প সংকট, বাজার সংকট, করোনাভাইরাসের অভিঘাত আর যুদ্ধ পরিস্থিতিকে সামনে আনা হয়। শোষণ-লুটপাট, নির্যাতন, কর্মহীনতা, বেকারত্ব, বাজার মূল্যের ঊর্ধ্বগতি ‘সমাজের শোষক গোষ্ঠীর সৃষ্ট এবং পরিচালিতি’, সে কথা বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে না।
ধর্মঘট নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব রেখে সংসদে উত্থাপিত অত্যাবশ্যক পরিষেবা বিল প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে শ্রমিক সংগঠনগুলো বলছে, এই বিল আইনে পরিণত হলে তা মালিকদের সুরক্ষা এবং শ্রমিকদের ভীতি প্রদর্শন ও শাস্তি প্রদানের হাতিয়ারে পরিণত হবে।
শ্রমিক নেতারা অভিযোগ করেন, দেশের সরকার ‘বড়লোকদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত’ এবং তাদের প্রতিনিধিত্ব করে। প্রধানমন্ত্রী শ্রমিকদের পক্ষে আছেন বলে বক্তব্য দেন। কিন্তু আইন যখন করেন, তখন তা যায় শ্রমিকদের বিপক্ষে।
ঢাকার প্রেস ক্লাব থেকে পল্টন মোড়ে শ্রমজীবী এই মানুষদের সমাবেশ থেকে অধিকার আদায়ের আওয়াজ ওঠে প্রবলভাবে।
‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’, ‘শ্রম যার দুনিয়া তার’, ‘মালিক পাবে শ্রমিক পাবে না - তা হবে না তা হবে না’, ‘বিজিএমইএর কালো হাত ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও’, ‘মে দিবস শিখিয়ে গেছে - লড়াই করে বাঁচতে হবে’, ‘মে দিবসের অঙ্গীকার, রুখতে হবে স্বৈরাচার’- এমন সব স্লোগান প্রকম্পিত হয় রাজপথ।
মিছিলে বহন করা ব্যানার-ফেস্টুনে বেতন ভাতা বৃদ্ধি, ‘২৪ ঘণ্টা’ ডিউটি থেকে মুক্তি, আইএলও কনভেনশন ১৮৯ এবং ১৯০ অনুস্বাক্ষর, কর্মক্ষেত্রে মৃত্যু হলে আজীবন আয়ের সমান ক্ষতিপূরণের মানদণ্ড নির্ধারণ, শিল্প কলকারখানায় নারী নির্যাতন, নারী বৈষম্য দূর করাসহ নানা দাবি লিখে আনেন তারা।
পোশাক কর্মী শেফালি বেগম বলেন, “আমাদের দাবি বেতন বাড়ানো। বেতন পাই ১১ হাজার টাকা। কর্মঘণ্টার ঠিক নাই। আপনিই বলুন এই বেতনে আমি দুই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে কীভাবে সংসার চালাব? বেতন বাড়ানোর কথা বললে চাকুরিচ্যুত করা হয়। তাহলে কোথায় যাব আমরা?”
কাকরাইলের একটি রেস্তোরাঁয় বেয়ারার কাজ করা মোমিন মিয়া বলেন, “আমাদের হোটেলে আট ঘণ্টার হিসাব কখনও আট ঘণ্টা থাকে না। কাস্টমার থাকলে কাজ চলতেই থাকে। এই অত্যাচার থামাইতে হবে বললে পরদিন মালিক ধমক দিয়ে বলে কিনা বেশি সময় কাজ না করতে পারলে ছাঁটাই করবে।”
পুরানা পলটন থেকে জাতীয় প্রেসক্লাব পর্যন্ত সড়কে সমাবেশ ও মিছিল নিয়ে যোগ দেয় জাতীয় শ্রমিক জোট, সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশন, গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন, জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশন, নৌযান শ্রমিক ফেডারেশন, বহুমুখী হর্কার্স সমিতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল, সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্ট, বাংলাদেশ দর্জি শ্রমিক ফেডারেশন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক জোট, জাতীয় গণতান্ত্রিক শ্রমিক ফেডারেশন, ইমারত শ্রমিক ইউনিয়ন, বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব লেবার স্টাডিজ, বাংলাদেশ টেড ইউনিয়ন সংঘ, কর্মজীবী নারী, বাংলাদেশ হোটেল রেস্টুরেন্ট সুইটমিট শ্রমিক ফেডারেশন, গ্রীন বাংলা গার্মেন্টস ওয়ার্কার্স ফেডারেশন, ঢাকা মহানগরীর প্রাইভেট কার ও ট্যাক্সি ক্যাব ড্রাইভার্স ইউনিয়ন, জাতীয় গার্হস্থ্য নারী শ্রমিক ইউনিয়ন, বাংলাদেশ ট্রাস্ট গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশন, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন ফেডারেশন, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ, লেবার পার্টি, গৃহশ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা নেটওয়ার্কসহ বিভিন্ন সংগঠন।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) এদিন ঢাকার পল্টন মোড়ে সমাবেশ ও পরে লাল পতাকা মিছিল করে।
এছাড়া জাতীয় শ্রমিক লীগ ও জাতীয়বাদী শ্রমিক দল বিকালে যথাক্রমে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ ও নয়া পল্টনের সড়কে সমাবেশ করবে।