শেষ শুক্রবারে বইমেলায় প্রাণের জোয়ার

জঙ্গি হামলার হুমকির উড়োচিঠিতে আতংকিত না হয়ে সকাল-বিকাল দুই সময়েই সবাই মিলেছিলেন প্রাণের এ মেলায়।

পাভেল রহমানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 Feb 2023, 05:00 PM
Updated : 24 Feb 2023, 05:00 PM

ছুটির দিন মানেই জনস্রোত; মাসব্যাপী বইমেলার শেষ শুক্রবারেও বাদ যায়নি তা, মেলাপ্রাঙ্গণ ছিল বইপ্রেমী আর আড্ডা দিতে আসা সব বয়সীদের আনাগোনায় জমজমাট।

জঙ্গি হামলার হুমকির উড়োচিঠিতে আতংকিত না হয়ে সকাল-বিকাল দুই সময়েই সবাই মিলেছিলেন প্রাণের এ মেলায়। বইয়ের খোঁজে স্টল থেকে স্টলে ঢু মেরে মেলাকে করে তুলেছিলেন প্রাণবন্ত; তাদের কেনাকাটায় ক্লান্তি ভুলিয়ে হাসির আভা ছড়িয়েছে বিক্রয় কর্মীদের মাঝে।

সকালে শিশু প্রহরের সময় থেকেই পুলিশের সতর্ক পাহারার মধ্যে অভিভাবকদের হাত ধরে মেলায় আসতে থাকে শিশুরা। সকাল ১১টায় মেলার দ্বার খুলতেই তাদের আনন্দ-উচ্ছ্বাসে মুখরিত হয়ে ওঠে শিশুচত্বর। তাদের সঙ্গে থাকা কিশোররাও মনের আনন্দে নতুন বই কেনার উচ্ছ্বাসে ঘুরে বেড়িয়েছেন স্টল থেকে স্টলে।

১টা পর্যন্ত শিশুপ্রহরের পর দুপুরে সমাগম কিছুটা কমলেও ভিড় কম থাকার সুযোগে অনেকেই ঘুরে বেড়িয়েছেন বইয়ের খোঁজে। এরপর বিকাল হতে না হতেই ভিড় বাড়তে থাকে, প্রবেশপথের বাইরে লাইন লম্বা হতে থাকে। সন্ধ্যা নামতে না নামতে নানা বয়সী মানুষের ঢল নামে মেলায়।

এদিন সবার স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহণই মেলাকে প্রাণবন্ত করে তুলেছে বলে মনে করেন লেখক আবু সাঈদ তুলু।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, "উড়োচিঠিতে হুমকি দিয়ে মানুষের এই প্রাণের মেলাকে থামানো যাবে না। মানুষের এই অংশগ্রহণই মেলাকে অনেক বেশি প্রাণবন্ত করেছে।"

চিত্রশিল্পী শাহনাজ জাহান বলেন, "হাজার হাজার মানুষ মেলায় ভিড় করেছে। এত লোকের সমাগমের কারণে হাঁটতেও কষ্ট হচ্ছে। ধুলার ভোগান্তিও আছে। তবুও মানুষ এসেছে প্রাণের এই মেলায়। মানুষের এই অংশগ্রহণের মধ্য দিয়েই এসব জঙ্গিবাদ মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না।"

মাসব্যাপী বইমেলার শেষ শুক্রবারে দর্শনার্থীদের মধ্যে ক্রেতার সংখ্যাও হাসি ফুটিয়েছে বিভিন্ন প্রকাশনীর কর্তাব্যক্তিদের মুখে।

দেশ পাবলিকেশন্সের প্রকাশক অচিন্ত্য চয়ন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "এবার মেলায় আমাদের প্রতিষ্ঠান থেকে ৫৫টি নতুন বই প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম দিন থেকেই আমাদের বই বিক্রিও ভালো হচ্ছে। শুক্রবার ছুটির দিনেও বিক্রি ভালো।"

প্রথমা, বাতিঘর, পাঞ্জেরী, কথা প্রকাশসহ সাতটি প্রকাশনার স্টলের বিক্রয়কর্মীরা জানিয়েছেন, বেচাবিক্রি জমেছে বেশ।

আগের দিন বৃহস্পতিবার রাতে উড়োচিঠির খবর পুলিশের বরাতে প্রকাশিত হয় সংবাদমাধ্যমে। এর জেরে শুক্রবার সতর্ক পাহারায় দেখা যায় মেলায় দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদেরও।

উড়োচিঠিতে হুমকির পর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মেলার প্রবেশ দ্বারের সামনে আগের কয়েক দিন হকার বসলেও এদিন বসতে দেওয়া হয়নি।

অপরদিকে টিএসসি গেইটের পাশেই যে জায়গাটায় লেখক অভিজিৎ রায়কে কুপিয়েছিল দুর্বত্তরা, সেই জায়গাটার পাশের সড়ক মেলা শুরুর দিন থেকে অন্ধকার থাকলেও শুক্রবার সেখানে আলো জ্বলতে দেখা যায়।

আলোর ব্যবস্থা করা হয় শাহবাগ থেকে টিএসসি পর্যন্ত সড়কেও। এতদিন সড়কটি অন্ধকার থাকা নিয়ে অভিযোগ থাকলেও মেলা পরিচালনা কমিটির উদ্যোগ চোখে পড়েনি।

বইমেলার সদস্য সচিব কে মুজাহিদুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "সড়কটির দায়িত্বে সিটি করপোরেশন এবং মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ ছিল। আমরা তাদের জানিয়েছিলাম। কিন্তু আলোর ব্যবস্থা করা যায়নি। এখন আলোর ব্যবস্থা হয়েছে।"

জঙ্গি হামলার শঙ্কার বিষয়ে জানতে চাইলে বইমেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব কে এম মুজাহিদুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "জঙ্গী হামলার উড়োচিঠির বিষয়টি আমরা পুলুশকে অবহিত করেছি। পুলিশ এবং বিভিন্ন গোয়েন্দা দপ্তরের সদস্যরা আমাদের সাথে কথা বলেছেন এবং সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যাপারে আশ্বস্ত করেছেন।"

এদিকে নীতিমালা ভঙ্গ করে বই বিক্রির অভিযোগ উঠেছিল অদম্য প্রকাশ নামে একটি স্টলের বিরুদ্ধে। এ নিয়ে বৃহস্পতিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে খবর প্রকাশের পর শুক্রবার স্টলটিতে সেসব বই আর বিক্রি করা হচ্ছে না বলে জানানো হয়।

প্রকাশ বিশ্বাসের 'কয়েকটি অন্ধকার মুহূর্ত'

বইমেলায় প্রকাশ বিশ্বাসের গল্পগ্রন্থ ‘কয়েকটি অন্ধকার মুহূর্ত’ প্রকাশ করেছে র‌্যামন পাবলিশার্স। এটি মূলত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সাহিত্য পাতা আর্টসসহ কয়েকটি পত্রিকায় প্রকাশিত গল্পের সংগ্রহ নিয়ে। বইটির প্রচ্ছদ এঁকেছেন নাসিম আহমেদ।

এতে রয়েছে- বনভূমি, কারাগার, মাছ, পলাতক অর্জুনেরা, বট থানের উপকথা, রুপার দোয়াত রুপার কলম, জেগে উঠব কোন অন্ধকারে, আমাদের ইন্দ্রনাথ, কয়েকটি অন্ধকারের মুহূর্ত শিরোনামে কয়েকটি গল্প।

এ লেখকের ‘মোহরানা ইতিবৃত্ত’ নামে আরেকটি বই একই প্রকাশনী থেকে আগে প্রকাশ হয়েছে।

শুক্রবার মেলার ২৪তম দিনে নতুন বই এসেছে ২৩৯টি।

পুরস্কার

সকাল সাড়ে ১০টায় শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন, আবৃত্তি ও সংগীত প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। সভাপতিত্ব করেন নাট্যজন ফেরদৌসী মজুমদার। অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন, আবৃত্তি ও সংগীত প্রতিযোগিতাগুলোর আহ্বায়ক কাজী রুমানা আহমেদ সোমা, সায়েরা হাবীব, ফারহানা খানমসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় বিজয়ী: ক-শাখায় ওয়াকিয়া নূর (প্রথম), আফফান আল হাসনাইন (দ্বিতীয়), রুজাইনাহ মারিফা (তৃতীয়)। খ-শাখায় প্রতায় পাল রাজ (প্রথম), তাসনিয়াহ সিদ্দিক (দ্বিতীয়), শাফিন উদ্দিন আহম্মেদ (তৃতীয়)। গ-শাখায় অর্নিলা ভৌমিক (প্রথম), আল মুমিনুর (দ্বিতীয়), জায়ীফা তাসনীম (তৃতীয় স্থান লাভ করেন।

শিশু-কিশোর আবৃত্তি প্রতিযোগিতা: ক-শাখায় আরোহী বর্ণমালা (প্রথম), অংকিতা সাহা রুদ্র ((দ্বিতীয়) ও জুমানা হোসেন (তৃতীয়)। খ-শাখায় সমৃদ্ধি সূচনা স্বর্ণ (প্রথম), আনিশা আমিন (দ্বিতীয়) ও অদ্রিতা ভদ্র (তৃতীয়) এবং গ-শাখায় আদিবা সুলতানা (প্রথম), তাজকিয়া তাহরীম শাশা (দ্বিতীয়) ও সিমরিন শাহিন রূপকথা (তৃতীয়) স্থান লাভ করেন।

শিশু-কিশোর সংগীত প্রতিযোগিতার বিজয়ী: ক-শাখায় নীলান্তী নীলাম্বরী তিতির (প্রথম), অন্বেষা মজুমদার (দ্বিতীয়) ও সার্থক সাহা (তৃতীয়)। খ-শাখায় রোদোসী নূর সিদ্দিকী (প্রথম), তানজিম বিন তাজ প্রতায় (দ্বিতীয়) ও মৈত্রেয়ী ঘোষ (তৃতীয় স্থান লাভ করেন।

আলোচনা

বিকাল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় আধুনিকতা, উত্তর-আধুনিকতা ও পরবর্তীকালের সাহিত্যতত্ত্ব শীর্ষক আলোচনা। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মাসুদুজ্জামান। আলোচনায় অংশ নেন নিরঞ্জন অধিকারী, এজাজ ইউসুফী, বিপ্লব মোস্তাফিজ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন রাশিদ আসকারী।

এদিন লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন আশরাফ জুয়েল, রণজিৎ সরকার, মেহেদী হাসান শোয়েব, কানিজ পারিজাত।

সন্ধ্যায় মূল মঞ্চে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেন রেজাউদ্দিন স্টালিন, নাজমুন নেসা পিয়ারি, রওশন ঝুনু, ফরিদা ইয়াসমিন সুমি, নাঈমা খানম, মাদুসুল হক, হাসান মাহমুদ, প্রতায় জসিম, মাহী ফ্লোরা, প্রসপারিনা সরকার ও মনিরুজ্জামান রোহান। আবৃত্তি পরিবেশন করেন শাহ কামাল সবুজ, আজহারুল হক আজাদ, শিরিন সুলতানা, ফারজানা মালিক নিম্মা, অনিকেত রাজেশ।

এছাড়া ছিল কাঙাল মজিবরের পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন কাঙ্গাল হরিনাথ সাংস্কৃতিক সংগঠন, এ. কে. আজাদের পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন আনন্দন, শাহাবুদ্দিন আহমেদ দোলনের পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন সুর সুধা সংগীতায়ন, সিদ্দিকুর রহমান পারভেজের পরিচালনায় আবৃত্তি সংগঠন মুক্তধারা সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র, সুবর্ণা আফরিনের পরিচালনায় আবৃত্তি সংগঠন কিংবদন্তী আবৃত্তি পরিষদ এর পরিবেশনা।

সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী আবিদা রহমান সেতু, আফরোজা খান মিতা, মারুফ হোসেন, আশরাফ উদাস ও অগ্নিতা সিকদার মুগ্ধ। যন্ত্রানুষঙ্গে ছিলেন জয় সিংহ রায় (তবলা), ডালিম কুমার বড়ুয়া (কি-বোর্ড), বিপিন চন্দ্র রায় (বাঁশি) ও রণজিৎ বৈরাগী (দোতারা)।

শনিবার যা থাকছে

শনিবার মেলার ২৫তম দিনে মেলা চলবে সকাল ১১টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত; ১টা পর্যন্ত থাকবে শিশুপ্রহর। বিকাল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘কোভিড-১৯: ভাষার বৈশ্বিকতা ও বাংলাদেশের সাহিত্য’ এবং ‘কোভিড-১৯: সংস্কৃতির সংকট ও রূপান্তর’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন হাকিম আরিফ ও মোহাম্মদ শেখ সাদী। আলোচনায় অংশ নেবেন পারভেজ হোসেন, হামীম কামরুল হক, কে এইচ মাসুদ সিদ্দিকী ও আবুল হাসান চৌধুরী। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন রফিকউল্লাহ খান।

আরও পড়ুন:

Also Read: একুশে বইমেলায় হামলার হুমকি দিয়ে উড়োচিঠি

Also Read: ক্ষুদেদের চোখ আটকায় রঙচঙে বইয়ে

Also Read: ববি হাজ্জাজের ‘প্রেসিডেন্টের লুঙ্গি নাই’ বইমেলায় নিষিদ্ধ

Also Read: স্মৃতি-ঐতিহ্য-গবেষণায় বইমেলার বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ

Also Read: একুশের দিনে জমজমাট বইমেলা

Also Read: বইমেলায় আদিবাসী ভাষার বই কম কেন?

Also Read: এবার মেলায় ভাষা আন্দোলনের বই এসেছে সাতটি

Also Read: বিজ্ঞানের বইয়ে আগ্রহ কিশোরদের, শিশুদের রূপকথায়