ক্ষুদেদের চোখ আটকায় রঙচঙে বইয়ে

এসব বইয়ের মান নিয়ে অভিভাবকের মনে প্রশ্ন থাকলেও জনপ্রিয় লেখক জাফর ইকবালের মত, বিচারের ভার শিশু-কিশোরদের উপরই ছেড়ে দেওয়া উচিৎ।

পাভেল রহমানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 Feb 2023, 05:00 PM
Updated : 23 Feb 2023, 05:00 PM

একুশে বইমেলায় রঙচঙে প্রচ্ছদ দেখে একটি বইয়ের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে নালন্দা স্কুলের শিক্ষার্থী রাইসা। মায়ের কাছে তার আবদার, বইটি কিনে দিতেই হবে। মা তাকে বলল, “আরও কিছু বই দেখ, তারপর না হয় কিনব।” কিন্ত রাইসার জেদের কারণে বইটি তাকে কিনে দিতেই হল।

রাইসার মা নাফিয়া আনজুমের প্রশ্ন এসব বইয়ের মান নিয়ে। তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মেলায় শিশু চত্বরের কয়েকটি স্টলে কিছু বই আছে, শুধু রঙিন ছবিই আকর্ষণ করে, বইয়ে পড়ার মতো তেমন কিছুই নেই।”

তবে শিক্ষাবিদ ও লেখক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল অবশ্য বলছেন ভিন্ন কথা। বৃহস্পতিবার বিকালে বইমেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের শিশু চত্বরে কথা হয় তার সঙ্গে।

শিশু-কিশোরদের কাছে জনপ্রিয় এই লেখক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শিশু-কিশোরদের সব ধরনের বই পড়তে দেওয়া উচিত। ভালো নাকি মন্দ, সেটাও তারা বিচার করবে।”

মেলায় শিশু চত্বরে গিয়ে দেখা যায়, শিশু-কিশোরদের কলতানে মুখর প্রাঙ্গণ। রঙচঙে প্রচ্ছদই আকর্ষণ করছে তাদের। প্রকাশকরাও প্রচ্ছদ এবং ছবিতেই বেশি জোর দিয়েছেন। ফলে অনেক রঙিন বইয়ের সমাহার শিশুচত্বরের স্টলগুলোকে করেছে ঝলমলে।

কিন্ডার বুকস এবারই প্রথম মেলায় স্টল নিয়েছে। শিশুচত্বরের প্রবেশ পথেই স্টলটি নজর কাড়ছে বইপ্রেমীদের। নতুন এই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান প্রথমবারই মেলায় এনেছে ৩৩টি বই। স্টলের ব্যবস্থাপক নাঈম ইসলাম জানান, তাদের স্টলে রয়েছে গল্প, উপন্যাস, ছবি আঁকার বই।

স্টলে সাজানো দেখা যায়- মোস্তফা মামুনের কিশোর উপন্যাস ‘ভুতুড়ে পার্ক’, আহসান হাবীবের ‘ছোটদের ইলাস্ট্রেটেড জোকস’, লুৎফর রহমান রিটনের ‘ফেল্টুস? চড় খাবি’, চিরায়ত গল্প সিরিজ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘তোতাকাহিনি’, ‘সুয়োরাণীর সাধ’ প্রভৃতি।

সাহিত্যিক মোস্তফা মামুন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিগত কয়েক বছর ধরে শিশুসাহিত্যের ভালো ব্যবসায়িক বাজার তৈরি হয়েছে। শিশুসাহিত্যের বই এখন প্রচুর বিক্রি হয়। বাবা-মায়েরাও সন্তানদের প্রযুক্তির আগ্রাসন থেকে দূরে রাখতে সন্তানদের হাতে বই তুলে দিচ্ছেন। এটা ইতিবাচক।

“আবার এটাও সত্য, সাহিত্য চর্চার জায়গায় শিশুসাহিত্য এতদিন অবহেলিত হয়েছিল। ফলে হুট করে শিশুসাহিত্যের বইয়ের চাহিদা বেড়েছে, কিন্তু জোগান কম। এজন্য অনেক প্রকাশক বাজারের চাহিদা মেটাতে প্রযুক্তির দিকে ঝুঁকছেন। ভালো গ্রাফিক্স প্রচ্ছদে রঙচঙে বই বাড়ছে। কিন্তু সাহিত্যের জায়গায় ঘাটতি থেকে যাচ্ছে।”

এই অবস্থার উন্নতি হবে বলেও আশাবাদী মোস্তফা মামুন। তিনি বলেন, “এখন যেহেতু শিশুসাহিত্যের চাহিদা বেড়েছে। আমি মনে করি শিশুসাহিত্যের চর্চাও বাড়বে। আরও মানসম্পন্ন শিশুসাহিত্যও আমরা সামনের দিনে পাব।”

শিশুচত্বরে রয়েছে- প্রকৃতি পরিচয়, জনতা প্রকাশ, তাকধুম, আদিগন্ত প্রকাশন, আরো প্রকাশন, শিশুর পড়া, ইকরি মিকরি, ঢাকা কমিক্স, ঝিঙেফুল, কালান্তর, কিন্ডার, শিশুকানন, পঙখিরাজ, প্রগতি পাবলিশার্স, পদক্ষেপ, ডাক, বইবাড়ি, শিশু গ্রন্থ কুটির, সিসিমপুরসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।

সিসিমপুর স্টলের ব্যবস্থাপক শাহরিয়ার সজিব বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মূলত ৩ থেকে ১৩ বছরের পাঠকদের কথা বিবেচনা করে আমাদের প্রকাশিত বইগুলো করা হয়েছে।”

প্রতিষ্ঠানটির সিনিয়র এক্সিকিউটিভ সূচনা খান বলেন, “এবারের মেলায় আমাদের স্টলে ১৯টি নতুন বই প্রকাশের পরিকল্পনা রয়েছে। ইতিমধ্যে ১০টির মতো বই এসেছে, বাকিগুলো প্রকাশ হবে।”

সিসিমপুরের স্টলে সব মিলিয়ে ১০০টির বেশি বই রয়েছে। যার মধ্যে আছে- ‘ওয়ানগালা উৎসবে ইকরি’, ‘দম দম কল কল’, ‘প্রজাপতি উৎসব’।

পঙখিরাজ এর প্রকাশক দেওয়ান আজিজ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “২০১৪ সাল থেকে আমরা প্রতিবছরই মেলায় আছি। এবার আমরা ১৪টি বই প্রকাশ করেছি। আরও কয়েকটা বই আসার অপেক্ষায় আছে। আমাদের প্রকাশিত বই হিসেব করলে সব মিলিয়ে ২৫০টির বেশি হবে।”

স্টলটিতে রয়েছে দেওয়ান ফারজানার ‘প্রজাপতির ছোট্ট মেয়ে মুনিয়া’, ফারহানা তানিয়ার ‘হরেক রকম গল্প’, দীপু মাহমুদের ‘পুতলি ও ছেলেধরা’, ‘পাতার নৌকা’সহ অনেক বই।

বৃহস্পতিবার ছিল বইমেলার ২৩তম দিন। মেলা শুরু হয় বিকাল ৩টায়, চলে রাত ৯টা পর্যন্ত। এদিন নতুন বই এসেছে ৭৮টি।

নীতিমালা মানছে না অদম্য প্রকাশ

মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে অদম্য প্রকাশ নামে একটি স্টলে ইংরেজি শেখার কিছু বই বিক্রি করছে মুদ্রিত মূল্যে। অথচ মেলার নীতিমালা অনুযায়ী ২৫ শতাংশ কমিশনে বই বিক্রির কথা তাদের। এছাড়া বইয়ের প্রকাশক বা পরিবেশকও তারা নয়। নীতিমালা অনুযায়ী মেলায় বিক্রি করতে হলে অবশ্যই নিজস্ব প্রকাশিত বই অথবা বইয়ের পরিবেশক হতে হবে। বইগুলোর পরিবেশকের জায়গায় আলাদা স্টিকার দিয়ে পৃষ্ঠার উপর পরিবেশক লিখে দেওয়া হয়েছে।

বিষয়টি বইমেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব কে এম মুজাহিদুল ইসলামকে জানানো হলে তিনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান।

টাস্কফোর্স কমিটির সভাপতি অসীম কুমার দে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মেলায় ২৫ শতাংশ কমিশনে বই বিক্রি করতে বাধ্য তারা।”

অনুষ্ঠান

বিকাল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় জন্মশতবর্ষে বঙ্গবন্ধুবিষয়ক কথাসাহিত্য, নাটক ও চলচ্চিত্র এবং জন্মশতবর্ষে বঙ্গবন্ধুবিষয়ক গবেষণা ও মুক্তগদ্য চর্চা শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মিল্টন বিশ্বাস এবং ফরিদ কবির। আলোচনায় অংশগ্রাহণ করেন রফিকুর রশীদ, সুভাষ সিংহ রায়, সরিফা সালোয়া ডিনা, মাসুদ পথিক। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন গোলাম কুদ্দুছ।

এদিন লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন কামাল চৌধুরী, জহরত আরা, মোস্তফা আল মেহমুদ রাসেল ও আনজীর লিটন।

সন্ধ্যায় মূল মঞ্চে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেন ভাস্কর রাশা, দুলাল সরকার, কামরুজ্জামান, রাজীব কুমার সাহা, মাহবুবা ফারুক, আতিক আজিজ। আবৃত্তি পরিবেশন করেন শফিকুল ইসলাম বাহার, চৌধুরী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর, জিনিয়া ফেরদৌস রুনা ও অনন্যা সাহা। এছাড়া ছিল হাসান আবদুল্লাহ বিপ্লবের পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ঘাসফুল’, শাহিনুর আল- আমিনের পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘সম্প্রীতি সংস্কৃতি সংসদ’র পরিবেশনা। সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী ঝুমা খন্দকার, চঞ্চল খান, ফাহিম হোসেন চৌধুরী, অণিমা রায়, মঞ্জু সাহা, মিরা মণ্ডল, আশরাফ মাহমুদ। যন্ত্রানুষঙ্গে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ পাল (তবলা), রবিন্স চৌধুরী (কি-বোর্ড), মোঃ হাসান আলী (বাঁশি) এবং বিশ্বজিৎ সেন (মন্দিরা)।

শুক্রবার ছুটির দিনে যা থাকবে

শুক্রবার বইমেলার ২৪তম দিন। মেলা চলবে সকাল ১১টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। সকাল ১১টা থেকে বেলা ০১টা পর্যন্ত মেলায় শিশুপ্রহর চলবে। এছাড়া সকাল ১০:৩০টায় শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন, আবৃত্তি ও সংগীত প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার প্রদান করা হবে। অনুষ্ঠানে স্বাগত ভাষণ প্রদান করবেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার। সভাপতিত্ব করবেন অভিনেত্রী ফেরদৌসী মজুমদার।

বিকাল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে আধুনিকতা, উত্তর-আধুনিকতা ও পরবর্তীকালের সাহিত্যতত্ত্ব শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন মাসুদুজ্জামান। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন নিরঞ্জন অধিকারী, এজাজ ইউসুফী, বিপ্লব মোস্তাফিজ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন রাশিদ আসকারী।