“রাষ্ট্র শুধু একটি জাতি বা ধর্মের মানুষের অধিকার নিশ্চিত করলে রাষ্ট্রের সৌন্দর্য থাকে না।”
Published : 19 Jun 2023, 01:19 AM
নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় এসে নানা বঞ্চনা থেকে মুক্তির আকুতি জানালেন প্রান্তিক জনগোষ্ঠী রাখাইনদের প্রতিনিধিরা।
রোববার পটুয়াখালীর একটি হোটেলে এই মতবিনিময় সভা হয়। কুয়াকাটার রাখাইন জনপদ সরেজমিন পরিদর্শন শেষে ওই সভায় অংশ নেয় ঢাকা থেকে যাওয়া নাগরিক প্রতিনিধি দল।
সভায় রাখাইনরা পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারণে জমি হারানোর পর এখন পুনর্বাসনের দাবি জানান। কুয়াকাটায় বিভিন্নভাবে তাদের ভূমি দখল হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন।
পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পে উচ্ছেদ হওয়া ছ আনী পাড়ার বাসিন্দা চিং ধা মো রাখাইন বলেন, “পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র আমাদেরকে আজ ২০ মাস আগে উচ্ছেদ করে বাসা ভাড়া করে রেখেছে। তারা আমাদেরকে স্থাপনার জন্য ক্ষতিপূরণ দিলেও সম্মানজনকভাবে পুনর্বাসন করছে না। আমরা যে জায়গায় আছি, সে জায়গার বাঙালিদের সাথে খাদ্যভাস মিলে না।”
কুয়াকাটার শ্রীমঙ্গল বৌদ্ধ বিহারের উপাধ্যক্ষ ইন্দ্রবংশ ভিক্ষু বলেন, “কুয়াকাটা পর্যটন কেন্দ্র হওয়ার কারণে আমাদের এলাকার জমির দাম বেড়েছে। ফলে ক্রমান্বয়ে আমাদের শ্মশান দখল করা হয়েছে। এখন আমাদের বৌদ্ধ বিহারের ভূমিও দখল করা হচ্ছে।
“আমাদের বিহারের পাশ দিয়েই বেড়িবাঁধ স্থাপন করা হয়েছে। বিহারের ভেতরের ৩৫ ফুট রাস্তাও বেড়িবাঁধের বলে দাবি করা হচ্ছে। এখন আবার আমাদের যে জাদি আছে, সেই জাদির জায়গাটি প্রেস ক্লাবকে দেওয়া হচ্ছে বলে জানা যাচ্ছে। এভাবে দিন দিন আমাদেরকে হুমকির মধ্যে রাখা হচ্ছে।”
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের বরিশাল অঞ্চলের সভাপতি মংচোথিন তালুকদার বলেন, “এখানে যে আমরা বসবাস করছি, তার অবদান আমাদের পূর্বপুরুষরা। তারাই আমাদের এই কুয়াকাটা অঞ্চলের বন-জঙ্গল পরিষ্কার করে, আবাদ করে বসবাস যোগ্য করেছেন। এই আঞ্চলের রাখাইন আদিবাসীদের যে বঞ্চনার মধ্যে রাখা হয়েছে, তা থেকে মুক্তির জন্য স্থানীয় নাগরিক সমাজের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।”
নাগরিক প্রতিনিধি দলের সদস্য বাংলাদেশ জাসদের সাধারণ সম্পাদক, সাবেক সংসদ সদস্য নাজমুল হক প্রধান বলেন, “এসব জাতিগোষ্ঠীরা ফুলের বাগানের ফুলের মতো। সকল ফুলের সমাহারে বাগানের সৌন্দর্য বাড়ে। কিন্তু মালি যদি এক ধরনের ফুলের প্রতি যত নেয়, তাহলে সৌন্দর্য থাকবে না। ঠিক তেমনই রাষ্ট্র শুধু একটি জাতি বা ধর্মের মানুষের অধিকার নিশ্চিত করলে রাষ্ট্রের সৌন্দর্য থাকে না।”
সভায় লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন নাগরিক প্রতিনিধি দলের সদস্য অ্যাডভোকেট প্রকাশ বিশ্বাস। তিনি বলেন, “বাংলাদেশ বহু সংস্কৃতি ও বহু জীবনের এক বৈচিত্র্যময় দেশ। বৃহত্তর বাঙালি জাতি ছাড়াও এখানে ৫১ বা তারও কম বেশি আদিবাসী জাতির বসবাস। দেশের মোট ৩০ লাখ আদিবাসী জনসংখ্যার ভেতর রাখাইনদের সংখ্যা বর্তমানে মাত্র কয়েক হাজার। বৃহত্তর বাঙালিসহ মূলধারার কাছে দেশের সকল আদিবাসী জাতিসমূহের আত্মপরিচয় এখনও অস্পষ্ট।”
পটুয়াখালী সরকারী মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ মোসাদ্দেক হোসেন বিল্লা বলেন, “রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দেওয়া। তাদের স্বার্থ রক্ষা করা। তার পাশাপাশি যারা আমরা সংখ্যাগুরু আছি, তাদের আরও বেশি দায়িত্ব এই সংখ্যালঘুদেরকে রক্ষা করা। আমরা মনে করি আমাদের সকল নাগরিকদেরও দায়িত্ব রয়েছে এই বঞ্চিত ও অনগ্রসর মানুষের পাশে দাঁড়ানো।”
নাগরিক উদ্যোগের নির্বাহী পরিচালক জাকির হোসেন বলেন, “একটি দেশের শাসন পদ্ধতি কেমন তা সেদেশের সংখ্যালঘুদের অবস্থা দেখলেই বোঝা যায়। আমাদের অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলেও আমাদের বহুসংস্কৃতির দেশ বলে সংবিধানে বলা আছে, সেই বিষয়টি লঙ্ঘন হচ্ছে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌসের পরিচালনায় সভায় অন্যদের মধ্যে অংশ নেন পটুয়াখালী প্রেস ক্লাবের সভাপতি দৈনিক সাথীর সম্পাদক আনোয়ার হোসেন, টেলিভিশন জার্নালিস্ট ফোরামের পটুয়াখালীর সাধারণ সম্পাদক মুজাহিদুল ইসলাম প্রিন্স, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রিফাত মাহমুদ, মোহসিনা হোসাইন, শরীফা উম্মে শিরিনা, ইলিয়াস হোসেন, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আসাদুজ্জামান মুন্না, আফজাল হোসেন।