“প্রতিটি ট্রাকে ৩৫০ জন পণ্য পাবেন; এখন এর বেশি যদি লোক দাঁড়ায়- তাৎক্ষণিকভাবে তো দেওয়ার সুযোগ থাকে না,” বলেন টিসিবির যুগ্ম পরিচালক হুমায়ুন।
Published : 03 Dec 2024, 01:40 AM
“লাইনে কোনো শৃঙ্খলা নাই। আমার পরে এসেও মানুষ মালামাল নিয়ে চলে গেছে। লাইন কেউ মানতে চায় না। মানবে কেমনে? মালামাল কম। এগুলো কোনো নিয়ম?”
ঢাকার তিতুমীর কলেজের সামনে টিসিবির ট্রাক সেলের সামনে ক্ষোভ নিয়ে বলছিলেন নাসিমা বেগম। মহাখালীর ওয়্যারলেস গেইট এলাকার এই বাসিন্দা গত বৃহস্পতিবার বিকাল ৩টায় লাইনে দাঁড়িয়ে সাড়ে ৫টার পর শোনেন ‘পণ্য শেষ’।
একই এলাকায় প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন টিবি গেইটের বাসিন্দা জহিরুল ইসলাম। পেশায় সংবাদকর্মী জহিরুলও বললেন, লাইন ভেঙে অন্যরা মালামাল নিয়ে গেলেও তিনি পাননি।
নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে টিসিবির ট্রাক সেলের লাইন দীর্ঘ হচ্ছে। কিন্তু পণ্যের যোগান না বাড়ায় সেই লাইনে দেখা যাচ্ছে বিশৃঙ্খলা। আর রোজ প্রতিটি স্পটে খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে কয়েক ডজন মানুষকে।
আবার পণ্য পেয়েও ব্যবস্থাপনা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন অনেকে। তারা বলছেন, শুরুতে সব পণ্য মিললেও খানিক বাদে কাঙ্ক্ষিত পণ্য মেলে না। দীর্ঘ সময় ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে সব পণ্য না পেয়ে কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ে কোনো কোনো দিন।
রোববার সকালে রাজধানীর খিলগাঁও এলাকায় প্রায় দুই ঘণ্টা দঁড়িয়ে ভর্তুকি মূল্যে পণ্য পাওয়ার পর ষাটোর্ধ্ব জাফর আহমেদ বললেন, “জীবনযুদ্ধ জয় করলাম মনে হচ্ছে। এত লম্বা লাইন। ভাবছিলাম মালই পামু না। যাক, অবশেষে পাইলাম।”
টিসিবির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীর ৫০টি স্থানে ট্রাকে করে পণ্য বিক্রি করে টিসিবি, প্রতিটি ট্রাকে ৩৫০ জনের জন্য পণ্য থাকে।
তবে খিলগাঁও, শাহবাগ, মহাখালী, মতিঝিল এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সবগুলো স্পটেই অন্তত ৫০ থেকে ১০০ জন বেশি মানুষ অপেক্ষায় ছিলেন, যাদেরকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে খালি হাতে ফেরত যেতে হয়েছে।
‘বাজারে দাম কইমা গেলে আর খাড়ান লাগে না’
গৃহকর্মীর কাজ করেন শাহানাজ বেগম। রাজধানীর কড়াইলের টিঅ্যান্ডটি কলোনি সংলগ্ন বেলতলা এলাকায় থাকেন।
ষাট বছর বয়সী এই নারী গত শনিবার বিকেল পৌনে ৩টায় খিলগাঁও এলাকায় ট্রাক সেলের লাইনে দাঁড়ান। ৫টার দিকে কাঙ্ক্ষিত পণ্য হাতে পান।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জিজ্ঞাসায় তিনি বলেন, “এত লম্বা লাইন, এতক্ষণ ধরে খাড়াইয়া থাইকা পাইলাম। কোনো কোনো দিন পাইও না। যদি আরও বেশি করে মালামাল দিত সরকার। আমাগো জন্য সুবিধা হইত।
“বাজারেও জিনিসপত্রের দাম বাড়তি। যদি দামটা একটু কইমা যাইত, বাজার থাইকাই কিনতে পারতাম।”
এই এলাকায় লম্বা লাইন ঘিরে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজনকে বাগবিতণ্ডায়ও জড়াতে দেখা গেল।
শনিবারই শাহবাগ এলাকায় ঢাকা ক্লাবের ঠিক সামনে টিসিবির একটি ট্রাককে দাঁড়ানো দেখা গেল।
সেখানে আনুশা আক্তার নামের একজন বেসরকারি চাকরিজীবী বলেন, “আমি থাকি টঙ্গী। এখানে ট্রাক দেখে বাস থেকে নেমে পড়লাম। কিন্তু এখানে দেখছি সবাই সিরিয়াল ভেঙে নিয়ে নিচ্ছে।
“খুব বাজে অবস্থা। আমি প্রায় এক ঘণ্টা হল দাঁড়িয়ে আছি।”
শাহবাগে একটি ফুলের দোকানে কাজ করা রহিমা বেগম থাকেন আজিমপুরে। তিনিও ঢাকা ক্লাবের সামনে পণ্য কিনতে এসেছিলেন। প্রায় ১ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে পণ্য পেয়ে স্বস্তি দেখা গেল তার চোখে মুখে। তার ভাষ্য, যদি পণ্য আরও বাড়ানো যায়, তবে বিশৃঙ্খলা কম হবে।
৫৯ বছরের ফারজানা বেগম থাকেন রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে। শাহবাগে তার একটি ফুলের দোকান রয়েছে। তিনিও প্রায় দেড় ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন, একপর্যায়ে লাইনেই বসে পড়েন।
ফারজানা বললেন, “পণ্য হয়ত পাব। কিন্তু, এই রোদে এতক্ষণ দাঁড়ায়ে থাকা খুব কষ্টের। যদি আরেকটু সহজে পাওয়া যেত।”
টিসিবির পণ্যের দাম কত
টিসিবির ফ্যামেলি কার্ডধারীদের বাইরেও সাধারণ মানুষ যাতে কম দামে নিত্যপণ্য কিনতে পারেন, সেজন্য ২৪ অক্টোবর থেকে ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে ট্রাক সেল শুরু করে টিসিবি। এ কর্মসূচি চলার কথা ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত।
টিসিবির ট্রাক থেকে একজন ক্রেতা সর্বোচ্চ ২ লিটার সয়াবিন তেল, ২ কেজি মসুর ডাল, ৫ কেজি চাল ও ৩ কেজি আলু কিনতে পারেন। শুরুতে তিনটি পণ্য বিক্রি করা হলেও আলুর দাম বাড়ায় ২০ নভেম্বর থেকে তাও যোগ করে টিসিবি।
শুক্রবার রাজধানীর মহাখালী কাঁচাবাজার ও নিকেতন কাঁচাবাজার ঘুরে দেখা গেছে, বাজারে নতুন আলু ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা, বগুড়ার আলু ১০০ টাকা, শীলবিলাতি আলু ১২০ থেকে ১৩০ টাকা ও পুরনো আলু ৮০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।
টিসিবির বিক্রি করা পণ্যের মধ্যে প্রতি লিটার ভোজ্যতেল ১০০ টাকা, প্রতি কেজি মসুর ডাল ৬০, চাল ৩০ টাকা ও আলু ৪০ টাকায় কেনা যায়। এই চার পণ্য কিনতে একজন গ্রাহককে দিতে হয় ৫৯০ টাকা।
আর খুচরা বাজার থেকে এসব পণ্য কিনতে লাগে প্রায় ১ হাজার ৫০ টাকা, অর্থাৎ টিসিবির ট্রাক থেকে পণ্য কিনলে অন্তত ৪৫০ টাকা সাশ্রয় হয়।
লাইন কেন লম্বা হচ্ছে?
খিলগাঁও, মহাখালী, শাহবাগ, মতিঝিল এই চার স্পট ঘুরে দেখা গেছে- এসব লাইনে যারা দাঁড়িয়েছেন, তাদের বেশির ভাগই স্বল্প আয়ের মানুষ। তবে মধ্যবিত্তদেরও এসব লাইনে দাঁড়াতে দেখা গেছে।
মতিঝিলের বক চত্বর এলাকায় লাইনে দাঁড়ানো বেসরকারি চাকুরে আফতাব আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আসলে সত্যি বলতে আমি অন্য সময় লাইনে দাঁড়াতাম না। কিন্তু এখন উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির কারণে হাসফাঁস অবস্থা। বাধ্য হয়েই দাঁড়িয়েছি।
“আয় তো আর বাড়ে না। কিন্তু জিনিসপত্রের দাম তো লাফিয়ে-লাফিয়ে বাড়ে। এখন দাঁড়ালাম যদি দুইটা পয়সা সেইভ হয়।”
পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট ভিত্তিতে অক্টোবরে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা চলতি অর্থবছরের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।
অর্থাৎ, ২০২৩ সালের অক্টোবরে যে পণ্য বা সেবা ১০০ টাকায় মিলেছে, তা এ বছরের অক্টোবরে কিনতে ব্যয় করতে হয়েছে ১১০ টাকা ৮৭ পয়সা।
জানতে চাইলে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “টিসিবির ট্রাক সেলে এখন নিম্ন মধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্তরাও লাইনে দাঁড়ান। মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের আয় হয়ত টাকার অংকে ঠিকই আছে, কিন্তু পারচেজিং পাওয়ার (কেনার ক্ষমতা) কমে গেছে। সেজন্য যেখানেই একটু সাশ্রয় হয়, সেখানেই মানুষ ছোটে।”
তার ভাষ্য, এটাই ট্রাকসেলের পেছনে মানুষের দীর্ঘ লাইনের প্রধান কারণ। এজন্যই মধ্যবিত্তের লাইনে দেখা যায়।
গোলাম রহমান বলেন, “এটার (ট্রাকসেল) ফলে কিছু মানুষ উপকৃত হচ্ছেন, তবে এই পদক্ষেপে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে যে খুব কার্যকর ভূমিকা রাখবে, তা কিন্তু না। শহর এলাকায় এটা বাড়ানো গেলে- উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়বে।”
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরবরাহ পরিস্থিতি উন্নতির পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, “যদি মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে হয়, তাহলে সরবরাহ পরিস্থিতির উন্নতি করতে হবে। এবং টাকার অবচয়ের কারণে ইমপোর্ট প্রাইস বেড়েছে, দেশেও উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। সে জায়গা অ্যাড্রেস করতে হবে।
“মূল্যস্ফীতি ৪ থেকে ৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে। মানুষের আয় যদি না বাড়ে- তাহলে এই উচ্চ মূল্যস্ফীতি কিন্তু বিস্ফোরক পরিস্থিতি তৈরি করবে।"
‘যোগান বাড়ানো হবে’
টিসিবির যুগ্ম পরিচালক হুমায়ুন কবির বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের পণ্যগুলো প্যাকেজ আকারে বিক্রি হয়। হয়তো বিশেষ কোনো কারণে কেউ চাল পেয়েছেন, ডাল পাননি, বা ডাল পেয়েছেন, আলু পাননি এমন ঘটনা ঘটতে পারে৷
“যদি সেই এলাকার ডিলারের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ আসে, আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।”
দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়েও পণ্য না পাওয়ার অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, “আমরা শুরু থেকেই বলে আসছি, প্রতিটি ট্রাকে ৩৫০ জন পণ্য পাবেন। এখন এর বেশি যদি লোক দাঁড়ায়, তাৎক্ষণিকভাবে তো দেওয়ার সুযোগ থাকে না।”
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ট্রাক সেলে পণ্যের সরবরাহ আর স্পট সংখ্যা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়েছেন বাণিজ্য সচিব সেলিম উদ্দিন৷
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা সংখ্যাটা বাড়াব। এখন প্রতিটি ট্রাকে সাড়ে ৩৫০ করে ফ্যামিলিকে দেওয়া হচ্ছে, আমরা এটাকে বাড়িয়ে ৪০০ করব। কারণ ৪০০-র বেশি ম্যানেজ করা যায় না এক ট্রাকে।"
সেলিম উদ্দিন বলেন, “টিসিবিকে বলেছি আরও কিছু স্পট বাড়ানো যায় কি না, একটা রিপোর্ট আমাদের দেন। কারণ তাদের তো সক্ষমতা বা লোকজনের বিষয় আছে মনিটরিংয়ের।
“আমরা নীতিগতভাবে- তাদের সক্ষমতা থাকলে, এটা বাড়াতে চাই। আমরা বলেছি, যদি তাদের সক্ষমতা থাকে- তাহলে আমরা ট্রাক সেলের ফ্যামিলির সংখ্যা বাড়ানোর বিষয়ে ইতিবাচক।”
পাশাপাশি ট্রাক সেলে পণ্য বিক্রি কর্মসূচির মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্য সচিব।
“এটা আমরা বাড়িয়ে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত করার কথা বলেছি।”