Published : 07 May 2024, 05:00 PM
অস্ত্র মামলার পর বিশেষ ক্ষমতা আইনে করা মামলা থেকেও বেকসুর খালাস পেয়েছেন মনির হোসেন, যাকে ‘গোল্ডেন মনির’ নাম দিয়েছিল র্যাব।
ঢাকার সপ্তম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ তেহসিন ইফতেখার গত রোববার এ রায় দেন। তবে সে খবর জানা যায় মঙ্গলবার।
মনিরের আইনজীবী আমিনুল গণী টিটো বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তার মক্কেলের কাছ থেকে র্যাবের জব্দ করা আট কেজি সোনা, ১ কোটি ৯ লাখ টাকা এবং বিদেশি মুদ্রা ‘বৈধ উপার্জনের মাধ্যমে অর্জিত’ বলে সিদ্ধান্ত দিয়ে আদালত; সেগুলো ফেরত দিতে রাষ্ট্রকে নির্দেশ দিয়েছে।
এ আইনজীবী বলেন, সোনা ও টাকা উদ্ধারের ঘটনায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলাটি করা হয়েছিল। কিন্তু জব্দ তালিকার সাক্ষীরা আদালতে বলেছেন, পুলিশ তাদের কাছ থেকে ‘সাদা কাগজে স্বাক্ষর’ নিয়েছে। কথিত স্বর্ণালঙ্কার ও অন্যান্য সামগ্রী জব্দের তালিকা করে তাতে স্বাক্ষর নেয়নি। তাদের সামনে সেগুলো জব্দও করা হয়নি। এটা খালাসের অন্যতম কারণ।
“খালাসের আরো একটি কারণ হল, মনিরের আয়কর নথিতে ১০ হাজার গ্রাম স্বর্ণের তথ্য ছিল। এর বাইরে দেড় গ্রাম বেশি দেখাল তদন্ত কর্মকর্তা। আমি জেরায় বললাম, এই দেড় গ্রাম আপনাদের বানানো। আর ঘটনার সময় নিয়েও গড়মিল ছিল। বিচারকের রায় সুবিবেচনা প্রসূত।“
অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনাকারী পাবলিক প্রসিকিউটর মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, “পূর্ণাঙ্গ রায় হাতে পাওয়ার পর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে আপিলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তবে আমরা ন্যায়বিচার পাইনি।”
২০২০ সালের ২০ নভেম্বর ঢাকার বাড্ডায় মনিরের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে নগদ ১ কোটি ৯ লাখ টাকা, চার লিটার মদ, ৮ কেজি স্বর্ণ, একটি বিদেশি পিস্তল ও কয়েক রাউন্ড গুলি জব্দ করার কথা জানায় র্যাব।
র্যাবের পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘সোনা চোরাচালানে’ জড়িত থাকার কারণে তাকে সবাই ‘গোল্ডেন মনির’ নামে চেনে। সোনা চোরাচালান দিয়ে সম্পদ গড়া শুরু করলেও পরে জমির ব্যবসায় জড়িয়ে ‘মাফিয়া’ হয়ে উঠেছিলেন মনির। তার গাড়ির ব্যবসাও রয়েছে।
তদন্তকারীরা সে সময় বলেন, মনিরের ১ হাজার ৫০ কোটি টাকার উপরে সম্পদ রয়েছে। বাড্ডা, নিকেতন, কেরানীগঞ্জ, উত্তরা ও নিকুঞ্জে দুইশর বেশি প্লট রয়েছে তার।
গ্রেপ্তারের পরদিন অস্ত্র, মাদক ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে তিনটি মামলা হয় মনিরের বিরুদ্ধে। এছাড়া সিআইডি মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে কেটি মামলা করে। আর জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে আরেকটি মামলা করে দুদক।
তদন্ত শেষে র্যাবের করা তিন মামলাতেই অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। গত ৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালত অস্ত্র মামলায় মনিরকে খালাস দেয়। এবার বিশেষ ক্ষমতা আইনের মামলাতেই একই ফল হল।
র্যাবের করা মাদক আইনের মামলা এবং দুদকের মামলা এখনও বিচারাধীন। সিআইডির মামলার তদন্ত এখনও চলছে।
কেন খালাস?
মনিরকে অভিযোগ থেকে খালাসের রায়ে আদালত স্থানীয় নিরাপত্তাকর্মী মোবারক হোসেন এবং ওষুধের দোকানদার এমাদ উদ্দিনের জবানবন্দির তথ্য তুলে ধরেছে।
সাক্ষী এমাদ উদ্দিন আদালতকে বলেছিলেন, ২০২০ সালের ১৯ নভেম্বর সকাল সাড়ে ৯টা বা ১০টার দিকে র্যাবের কয়েকটি গাড়ি আসে। এরপর রাত সাড়ে ১১টার দিকে তাকে মনিরের বাসায় যেতে বলেন র্যাব সদস্যরা। পরে রাত সাড়ে ১২টার দিকে মনিরের বাসায় বসা অবস্থায় সাদা কাগজে তার সই নেওয়া হয়। তাকে ১১ ঘণ্টা মনিরের বাসায় বসিয়ে রাখা হয়েছিল।
মোবারকও আদালতকে বলেন, তার কাছ থেকে সাদা কাগজে সই নেওয়া হয়েছিল।
মামলাটির আরেক সাক্ষী আবদুল হামিদ ছিলেন মনিরের গাড়ি বিক্রয়কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক। তিনি আদালতকে বলেন, রাত সাড়ে ১০টার দিকে র্যাব সদস্যরা বিক্রয়কেন্দ্রে যান। পরে সেখান থেকে দুটি গাড়ি (নিশান কার) নিয়ে যান তারা। জোর করে সাদা কাগজে তার একটি সইও নেওয়া হয়।
বিক্রয়কেন্দ্রের আরেক কর্মী আবুল কালামও সাক্ষ্যে আদালতকে বলেছিলেন, তাকেও সাদা কাগজে সই করতে বলা হয়।
ওষুধের দোকানিসহ পাঁচজন সাক্ষী রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগকে সমর্থন করেননি জানিয়ে রায়ে আদালত বলেছে, ওই পাঁচ সাক্ষীকে রাষ্ট্রপক্ষ বৈরী ঘোষণা করেনি।
উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত তুলে ধরে বিচারক রায়ে বলেন, “সাক্ষীদের উপস্থিতিতে তল্লাশি করাকে কেবল একটি আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে দেখা উচিত নয়। বরং তাদের অবশ্যই পুলিশ কর্তৃক পরিচালিত পুরো তল্লাশির প্রত্যক্ষদর্শী হতে হবে। প্রতিটি জিনিস কোথা থেকে পাওয়া গেল, তা স্পষ্টভাবে দেখতে সক্ষম হতে হবে।”
রায়ে ফৌজদারি কার্যবিধির সংশ্লিষ্ট ধারা তুল ধরে বলা হয়, আইনের বিধানগুলো কঠোরভাবে অনুসরণ ছাড়া কোনো তল্লাশি বা জব্দ করা বেআইনি বলে গণ্য হবে। ওষুধের দোকানদারসহ পাঁচজন সাক্ষীর সাক্ষ্য থেকে প্রমাণিত হয় যে তারা র্যাবের তল্লাশির প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী নয়। কোথা থেকে আলামত জব্দ করা হয়েছে, তা তারা দেখেননি।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সহকারী পুলিশ সুপার (তৎকালীন ডিবির পরিদর্শক) আবদুল মালেক সাক্ষী হিসেবে আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে বলেন, মামলার এজাহারে ঘটনার সময় উল্লেখ করা হয়েছে ২০২০ সালের ২১ নভেম্বর সকাল সাড়ে ৬টা থেকে সকাল ১০টা ৪৫ মিনিট। আর বাড্ডা থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে পরদিন (২০২০ সালের ২২ নভেম্বর) সকাল ৬টায়। অভিযান শেষে এবং এজাহার দায়েরের মধ্যবর্তী সময়ে আসামি মনির কোথায় ছিলেন, সেটা তিনি জানেন না।
বিচারের সময় সাফাই সাক্ষ্য দেন বেসরকারি দুটি টেলিভিশনের দুজন সাংবাদিক। তাদের একজন বলেন, ২০২০ সালের ২০ নভেম্বর রাত সাড়ে ১০টার সময় মনিরের বাসায় র্যাবের অভিযান চলে। পরদিন সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বেলা ১১টার মধ্যে র্যাবের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করা হয়।
আরেক সাংবাদিক তার সাক্ষ্যে আদালতকে বলেন, র্যাবের অভিযানের সময় তিনি ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে সরাসরি সম্প্রচার করেছিলেন। সেই প্রতিবেদনও আদালতে জমা দেন তিনি।
মামলার এজাহারে র্যাব ঘটনার সময় উল্লেখ করেছিল সকালে। তবে কয়েকজন সাক্ষী আদালতকে বলেন, ঘটনার সময় ছিল রাতে। বিচারক এ বিষয়ে তার রায়ে বলেন, সাক্ষীদের সাক্ষ্য ও আদালতে উপস্থাপিত দালিলিক প্রমাণ মামলার এজাহার ও রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের বক্তব্যের সত্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
অস্ত্র মামলায় কেন খালাস পেয়েছিলেন
র্যাবের করা তিন মামলার মধ্যে অস্ত্র মামলায় গত ৫ ফেব্রুয়ারি মনিরকে খালাস দেন ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের তৎকালীন বিচারক মো. আসাদুজ্জামান।
সেই রায়ে বিচারক বলেছিলেন, মনির ও তার স্ত্রীর নামে লাইসেন্স করা অস্ত্র থাকার কথা পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেছেন। নিজেদের নামে বৈধ অস্ত্র থাকা অবস্থায় আরেকটি অবৈধ অস্ত্র ঘরে রাখার ঘটনা স্বাভাবিক ও বিশ্বাসযোগ্য নয়।
রায়ে বলা হয়, ২০২০ সালের ২০ নভেম্বর সকাল সাড়ে ৬টায় মনির হোসেনের বাড্ডার বাসায় তোশকের নিচ থেকে অস্ত্র উদ্ধারের অভিযোগ রাষ্ট্রপক্ষ প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
পুরনো খবর
'গোল্ডেন মনিরের' নামে তিন মামলা, রিমান্ডে চায় পুলিশ
মনিরের ২০০ প্লট: 'যাচাই করে ব্যবস্থা' নেবে সরকার