“দেশে আয়নাঘরের মত দৃষ্টান্ত হতে দেওয়া সবার অপরাধ।“
Published : 12 Feb 2025, 04:14 PM
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতা হারানোর আগে আওয়ামী লীগ সরকার দেশের সবক্ষেত্রে ‘আইয়্যামে জাহেলিয়া’ প্রতিষ্ঠা করে গেছে বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
বুধবার ঢাকার তিন এলাকায় আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে কুখ্যাতি পাওয়া তিনটি গোপন বন্দিশালা ঘুরে দেখে তিনি বলেছেন, “আয়না ঘর তারই একটি নমুনা। দেশে আয়নাঘরের মত দৃষ্টান্ত হতে দেওয়া সবার অপরাধ।“
ইউনূস বলেন, “আইয়্যামে জাহেলিয়া বলে একটা কথা আছে, গত সরকার আইয়্যামে জাহেলিয়াকে প্রতিষ্ঠিত করে গেছে সর্বক্ষেত্রে। এটা তার একটা নমুনা।”
রাজধানীর আগারগাঁও, কচুক্ষেত ও উত্তরা এলাকায় গোপন বন্দিশালা পরিদর্শনের সময় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সেই নির্যাতন পেরিয়ে বেঁচে ফিরে আসা কয়েকজন ভুক্তভোগী আর সাংবাদিকরা ছিলেন।
উপদেষ্টা পরিষদের কয়েকজন সদস্য এবং গুম তদন্ত কমিশনের সদস্যরাও এসময় তার সঙ্গে ছিলেন বলে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস অফিস থেকে জানানো হয়েছে।
প্রেস অফিস বলছে, প্রধান উপদেষ্টাকে ঢাকার আগারগাঁওয়ের একটি নির্যাতনকেন্দ্রে ব্যবহৃত একটি বৈদ্যুতিক চেয়ার দেখানো হয়। একজন গুমের শিকার ব্যক্তি কচুক্ষেত এলাকায় প্রধান উপদেষ্টাকে নির্যাতন সেলের দেয়াল দেখান।
আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে বিরোধী মতের বহু মানুষকে তুলে নিয়ে বিচার বহির্ভূতভাবে অজ্ঞাত স্থানে আটক রাখার অভিযোগ ওঠে, সেইসব বন্দিশালার প্রতীকী নাম রাখা হয়েছে ‘আয়নাঘর’।
এ ধরনের বন্দিশালা দেশজুড়ে ‘আছে’ জানিয়ে ইউনূস বলেন, “আমার ধারণা ছিল এটা মনে হয় এখানেই আয়নাঘর বলতে যে কয়েকটা আছে। এখন শুনতেছি আয়নাঘরে বিভিন্ন ভার্সন সারা দেশজুড়ে আছে। কেউ বলবে সাতশ’, কেউ বলবে আটশ’। সংখ্যাও নিরূপণ করা যায়নি এখন পর্যন্ত। কতগুলো জানা আছে, কতগুলো অজানা রয়ে গেছে।
“আইয়্যামে জাহেলিয়া বলে একটা কথা আছে, গত সরকার আইয়্যামে জাহেলিয়াকে প্রতিষ্ঠিত করে গেছে সর্বক্ষেত্রে।"
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “নৃশংস অবস্থা,যতটা শুনি অবিশ্বাস্য মনে হয়, এটা কি আমাদের জগৎ, আমাদের সমাজ! যারা নিগৃহীত হয়েছে, যারা এটার শিকার হয়েছে তারাও আমাদের সঙ্গে আছেন। তাদের মুখের থেকে শুনলাম কিভাবে হয়েছে, কোনো ব্যাখ্যা নাই। একটা ব্যাখ্যা থাকলে কিছু একটা হলে মানুষ বোঝে এটার কারণ ছিল, এটা বিনা কারণে, রাস্তা থেকে উঠিয়ে আনার মত। বিনা দোষে কতগুলো সাক্ষী-সাবুদ হাজির করে কতগুলো গাড়ির মধ্যে ঢুকায় দিয়া তারে বলছে তুমি সন্ত্রাসী-জঙ্গি, এগুলো বলে বলে তাকে নিয়ে আসা হয়েছে।"
তুলে নেওয়া সেসব মানুষদের কেউ কেউ বহু দিন পর পরিবারের কাছে ফিরে বীভৎস নির্যাতনের বিবরণ দিলেও অনেকের খোঁজ এখনও মেলেনি। বিভিন্ন বাহিনীর আওতাধীন এমন আয়নাঘরের সন্ধান পাওয়ার কথা বলেছে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত ‘গুম তদন্ত কমিশন'।
গত ১৯ জানুয়ারি বৈঠকে কয়েকটি গুমের ঘটনার নৃশংস বর্ণনা প্রধান উপদেষ্টার সামনে তুলে ধরা হয়। ছয় বছরের শিশু গুম হওয়ার ঘটনাও তদন্তে উঠে এসেছে বলে জানান কমিশন সদস্যরা।
গুম কমিশনকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “তারা বহু কষ্ট করেছে। অন্যান্য কমিশনতো করেছে অন্তত তারা নিজেদের ঘরে বসে করতে পেরেছে। গুম কমিশনকে এগুলো বের করতে আসতে হয়েছে। কিসের মধ্যে ঢুকিয়েছিল, কারা কি করেছে, এখনও ধ্বংসাবশেষ।"
‘আয়নাঘর’কে দেশের চূড়ান্ত অবনতির প্রতিচ্ছবি বলে বর্ণনা করেছেন মুহাম্মদ ইউনূস।
তিনি বলেন, “গুম কমিশন যেটা আমাদের সামনে নিয়ে আসলো, সেটা হল কী পরিমাণে একটা দেশকে সর্বদিকে ধ্বংস করা যায়, এমনকি মানুষের সামান্যতম মানবিক অধিকার, সেটুকু থেকে বঞ্চিত করে রেখে দেওয়া হয়েছে। আজকে এটা জাতির জন্য একটা বড় চূড়ান্ত রকমের একটা ডকুমেন্ট হবে। আপনাদের সাক্ষী রেখে, আপনাদেরকে নিয়ে এসে আমরাও শরিক হলাম।"
পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ”এখানে ভুক্তভোগী, তাদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বললাম। ভুক্তভোগীর সংখ্যা আমাদের জানা মতে সতেরশ প্লাস। অজানা কত এটাতো আমরা জানি না। কেউ কেউ বলে এটা তিন হাজারের বেশি হবে।"
‘আয়নাঘরের’ ভয়াবহতা তুলে ধরে তিনি আরও বলেন, “উধাও হয়ে গেছে মানুষ, নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। কেউ বলতে পারছে না সে কোথায়। তার মেয়ে আপনাদের সামনেই ছিল আজকে। বলছে, আমার মাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে নয় বছর ধরে আমরা খোঁজ পাইনি। সে নিজেও ছিল, এগারো বছর বয়সে মায়ের সঙ্গে ছিল। তাকে রেখে মাকে নিয়ে চলে গেছে। সামান্য একটা দৃশ্য, এ দৃশ্য বড় করুণ দৃশ্য। এটার কঠিনতম লেসনটা হল, যারা করেছে তারা আমাদেরই সন্তান, আমাদেরই ভাই, আমাদেরই ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। আমরা যদি এ সমাজকে যদি এর থেকে বের করে না আনতে পারি এ সমাজতো টিকে থাকবে না। এভাবে যদি হয়, আমাদের সন্তানরা যদি এগুলো করে।"
গোপন বন্দিশালায় এক বন্দির অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে ইউনূস বলেন, “একজন বলছিল, খুপরির মধ্যে তাকে রাখা হয়েছে, গ্রামেতো মুরগীর খাঁচা এর থেকে বড় হয়। মুরগীও নড়াচড়ার যে রকম জায়গা পায় না, ওরও নড়াচড়ার কোন জায়গা নাই। ওকে ওই অবস্থায় রাখা হয়েছে মাসের পর মাস, বছরে পর বছর।"
এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরির পেছনে ‘সবারই দায় রয়েছে’ বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান উপদেষ্টা।
তিনি বলেন, “আজকে আমরা মুক্ত হলাম। এ মুক্ত বাংলাদেশে আমরা যেন নতুন করে আবার সমাজ গড়তে পারি, এটার থেকে অতি দূরে যেন আমরা চলে যেতে পারি। এটার নমুনা, এটার সাক্ষী, এটার ডকুমেন্টেশন গুম কমিশনের রিপোর্টের মধ্যে থাকবে এবং এটা অবশ্য পাঠ্য হিসাবে সবাইকে পড়তে হবে। এবং যারা করেছে তাদের বিচার করতে হবে, তা না হলে আমরা নিষ্কৃতি পাবো না এটা থেকে। আমাদের আবেদন দেশের সবার কাছে, এ বিচরটা যেন করতে পারি।"
‘আয়নাঘর’ ও এর আনুসাঙ্গিক সামগ্রী প্রমাণ হিসাবে সিলগালা করে রাখা হবে জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “বিচারের কাজে যেন প্রমাণ হিসাবে ব্যবহার করতে পারে।”
ন্যায় বিচার নিশ্চিত করা সরকারের প্রধান অগ্রাধিকার জানিয়ে ইউনূস বলেন, “আমরা দেখছি যে ন্যায় বিচারটা তার যেন হয়, অতি তাড়াতাড়ি হয়। বিচার দীর্ঘসূত্রিতায় পরে থাকবে, সে যেন নিস্কৃতি পায়, এটা আমাদের ফার্স্ট প্রেফারেন্স।
“এই সরকারের অস্তিত্ব এটার কারণেই। আমরা অন্ধকারে থাকতে চাই না, যেটা আমাদের চারপাশে গড়ে তোলা হয়েছিল। আমরা নতুন পরিবেশ তৈরি করতে চাই, নতুন বাংলাদেশ গঠন করতে চাই। গুম কমিশন আমাদের এগুলো দেখিয়েছে। যদি আমাদের এ কমিশন না থাকতো তাহলে এটি একটি গল্পই থাকতো, এখন আমাদের হাতে প্রমাণ আছে। এটা প্রথম পদক্ষেপ।"
এ ধরনের ঘটনার যাতে কোনো পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেটাই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিজ্ঞা বলে জানিয়েছেন ইউনূস।
২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ৫ অগাস্ট সরকার পতনের দিন পর্যন্ত সময়ের ঘটনা গুম কমিশনের বিবেচনায় আনা হয়।
কমিশন গত ১৪ ডিসেম্বর অন্তর্বর্তী একটি প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দেয়। পরদিন এ প্রতিবেদনের কিছু অংশ প্রকাশও করা হয়।
‘গুমের’ ঘটনায় বিচার প্রক্রিয়া শুরু এবং র্যাব বিলুপ্তির সুপারিশ করা হয় ‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ’ শিরোনামে জমা দেওয়া ওই প্রতিবেদনে।
সেদিন প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর গুম বিষয়ক কমিশনের প্রধান মইনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, তারা মার্চে আরও একটি অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন দেবেন। চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিতে কমপক্ষে আরও এক বছর সময় প্রয়োজন পড়বে।