“বর্ষবরণের মর্মবাণী সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারাটাই হবে সন্জীদা খাতুনের প্রতি শ্রদ্ধা।”
Published : 14 Apr 2025, 12:23 AM
ষাটের দশক। পাকিস্তানিদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে রমনার বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সূচনা করে ছায়ানট।
মানুষের মনে স্বাধিকারের চেতনা জাগানোর স্বপ্ন নিয়ে যেসব মানুষ সেদিন নগরে বর্ষবরণের গোড়াপত্তন করেছিলেন, তাদের মাঝে সন্জীদা খাতুন ছিলেন সামনের সারিতে।
এবারই প্রথম সেই সন্জীদাকে ছাড়া বর্ষবরণ করছে ছায়ানট।
ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে গত ২৫ মার্চ জীবনযাত্রা সাঙ্গ করেন তিনি।
বর্ষবরণের আয়োজনে সন্জীদা খাতুনকে স্মরণ করে বিশেষ কিছু থাকবে কি না জানতে চাইলে ছায়ানটের নির্বাহী সভাপতি ডা. সারওয়ার আলী বলেন, “এই প্রথম ছায়ানট বর্ষবরণ আয়োজন করছে, যখন সন্জীদা খাতুন নেই। তার যে চিন্তা, আমরা যেন ছড়িয়ে দিতে পারি। আয়োজনটি সুষ্ঠুভাবে করতে পারা এবং বর্ষবরণের মর্মবাণী সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারাটাই হবে সন্জীদা খাতুনকে শ্রদ্ধা জানানো।”
ছায়ানট সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এবারের আয়োজন বিগত বছরগুলোর মতই; ভিন্ন কিছু থাকছে না। গান ও পাঠে বাঙালি হওয়ার আহ্বান জানানো হবে। আর এটাই হবে সন্জীদার প্রতি শ্রদ্ধা।
এবারের অনুষ্ঠানের সজ্জায় নয়টি সম্মেলক, ১২টি একক গান ও তিনটি পাঠ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। দুই ঘণ্টার অনুষ্ঠানে সব মিলিয়ে দেড়শতাধিক শিল্পী অংশগ্রহণ করছেন।
১৯৬১ সালে রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ উদযাপন এবং তার সূত্র ধরে পরে সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট গঠন করা হয়।
১৯৬৭ সালে রমনা উদ্যানে যে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান হয়, সেটাই এখন বাঙালির বর্ষবরণের অন্যতম অনুষঙ্গ।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের বছর ছাড়া প্রতিটি পহেলা বৈশাখেই সে অনুষ্ঠান হয়েছে; নতুন বছরকে স্বাগত জানানো হয়েছে সুরের মূর্ছনা আর কথামালায়। কোভিডের দুবছর রমনা বটমূলে যেতে না পারলেও এ আয়োজন করা হয়েছে ভার্চুয়ালি।
ছায়ানটের বর্ষবরণ কথনে প্রায় প্রতিবছরই থাকত সন্জীদা খাতুনের বক্তব্য। এবার ছায়ানটের হয়ে বর্ষবরণ কথনে অংশ নেবেন ডা. সারওয়ার আলী।
২০১৭ সালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সন্জীদা খাতুন বলেছিলেন, “শুধু শহরে বসে সংস্কৃতি চর্চা করলে হবে না, যেতে হবে গ্রামের মানুষের কাছে। মুক্তিযুদ্ধের কথাবার্তা, ইতিহাস, মানবিক দিক, ধর্মের নামে যে অন্যায় হচ্ছে- এসব সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাতে হবে।”
তরুণ সংস্কৃতি কর্মীদের ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে নিজেদের কথা সহজভাবে উপস্থাপনের অনুরোধ করেছিলেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধের সময় বর্ষবরণ আয়োজনের স্মৃতিচারণ করে সন্জীদা খাতুন বলেছিলেন, “সেদিন আমি ছিলাম সাভারের একটি গ্রামের মাটির ঘরে। সেখানে বটমূল কল্পনা করে বসে আমার ছেলে-মেয়েদের নিয়ে সকাল বেলা গান গেয়েছিলাম। মানে পহেলা বৈশাখ হবে না, তা তো হতে পারে না। আমরা পারিবারিকভাবে পালন করেছিলাম। বড় করে আয়োজন হওয়ার কোনো সম্ভাবনা ছিল না। পরিস্থিতি ছিল ভয়াবহ। অনেকেরই নাম ছিল এলিমিনেশন লিস্টে।”
২০০১ সালে ছায়ানটের বৈশাখ বরণের অনুষ্ঠানে বোমা হামলা চালায় জঙ্গিরা। তাতে ১০ জন নিহত হন। এরপর থেকে কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে প্রতিবছর বর্ষবরণের এ আয়োজন হচ্ছে।
ছায়ানটের নেতৃত্ব দেওয়ার পাশাপাশি জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলিন পরিষদের সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন সন্জীদা খাতুন।
মৃত্যুর আগের কয়েক বছর তিনি শারীরিকভাবে অসুস্থই ছিলেন। ২০২৩ সালে তার ৯০তম জন্মদিনে ‘নবতিপূর্ণা’ শিরোনামের অনুষ্ঠানে লিখিত বক্তব্য পড়ে শুনিয়েছিলেন, অনুষ্ঠানে এসেছিলেন হুইলচেয়ারে বসে।
সেদিন সন্জীদা খাতুন বলেছিলেন, “অল্পে তুষ্ট সহজ সরল জীবনের এই সার্থকতায় আমি ধন্য হয়েছি।”
ছায়ানটের মূল অনুষ্ঠান রমনার বটমূলে বৈশাখের প্রথম প্রত্যূষে বাংলা নববর্ষের আবাহন। ছায়ানটের গণ্ডি ছাড়িয়ে এটি এখন জাতীয় উৎসবে পরিণত।
ঢাকার রমনা উদ্যানের অশ্বত্থ গাছের নিচে ১৩৭৪ বঙ্গাব্দের প্রথম প্রভাত, ১৯৬৭ সালের মধ্য এপ্রিলে হয়েছিল প্রথম অনুষ্ঠান। পঞ্চবটী বলতে অশ্বত্থ, বট, বিল্ব, আমলকি ও অশোক বোঝায়। ভালো শোনায় বলে অনুষ্ঠানস্থলের নাম করা হয় বটমূল।
১৯৬৭ সালে ছায়ানট প্রথম বর্ষবরণের আয়োজন গণ্য করা হলেও শুরুটা হয়েছিল আরও আগে; ১৯৬৩ সালে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিপারেটরি স্কুলে (বর্তমানে উদয়ন উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়) প্রথম আয়োজনটি করা হয়েছিল। সেটা ছিল আসলে ছায়ানটের বর্ষপূর্তির আয়োজন। সরু একটা গলির ভেতর অপূর্ব সুন্দর এক কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে প্রথম নববর্ষ উদযাপন করা হয়েছিল বলে জানিয়েছিলেন সন্জীদা খাতুন।
সেই সময়ের স্মৃতিচারণ করে সন্জীদা খাতুন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, “জায়গাটা আমাদের দেখিয়ে দিয়েছিলেন বন্ধু নওয়াজেশ আহমেদ। বর্ষবরণ ছিল বাঙালি জাতির জাগরণের যাত্রা। এটার মধ্য দিয়ে আমরা মানুষের মনে স্বাধিকার চেতনা জাগ্রত করতে চেয়েছিলাম।”
বাঙালি সমাজকে নিয়ে মুক্তির পথযাত্রী হতে এবার ছায়ানটের বর্ষবরণের বার্তা- 'আমার মুক্তি আলোয় আলোয়'।
ছায়ানটের ৫৮তম এ আয়োজন যথারীতি শুরু হবে নতুন বছরের প্রথম দিন ভোর সোয়া ৬টায়।
ভোরের আলো ফুটতে ফুটতে ভৈরবীর রাগালাপ দিয়ে ছায়ানটের ১৪৩২ বঙ্গাব্দবরণের সূচনা হবে বলে জানায় আয়োজন সংশ্লিষ্টরা।
ছায়ানট সাধারণ সম্পাদক লাইসা আহমদ লিসা বলেন, "বিশ্বব্যাপী যেমন ক্ষয়ে চলেছে মানবতা, তেমনি এদেশেও ক্রমান্বয়ে অবক্ষয় ঘটছে মূল্যবোধের। তবুও আমরা আশাহত হই না, দিশা হারাই না, স্বপ্ন দেখি হাতে হাত রেখে সকলে একসাথে মিলবার, চলবার।"
"বাঙালি জাগবেই, সবাই মিলে সুন্দর দিন কাটানোর সময় ফিরবেই। সার্থক হবেই হবে মানুষ, এ দেশ ও পৃথিবীকে ভালোবেসে চলবার মন্ত্র।"
রমনা উদ্যান থেকে এ আয়োজন সরাসরি সম্প্রচার হবে ছায়ানটের ইউটিউব চ্যানেল (youtube.com/@chhayanautbd) ও ফেইসবুক পেইজে (facebook.com/chhayanautbd)। বিটিভিও সরাসরি সম্প্রচার করবে অনুষ্ঠান।
আরও পড়ুন-