ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে প্রভাত ফেরির মিছিল হবে পথে পথে; শহর থেকে গ্রাম সবখানেই সেই মিছিল গিয়ে শেষ হবে একই জায়গায়।
Published : 21 Feb 2025, 01:57 AM
রক্ত দিয়ে মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষার লড়াইয়ের বেদনাবিধুর দিন একুশে ফেব্রুয়ারি; একইসঙ্গে তা ভাষার অধিকার রক্ষার গৌরবোজ্জল স্মৃতির স্মরণও।
সেই রক্তভেজা একুশ এখন বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বের সব ভাষাভাষির অধিকার রক্ষার দিনও। বাংলাদেশের নতুন প্রেক্ষাপটে ‘মাথানত না করার’ প্রেরণা নিয়ে আবার সেইদিন স্মরণ করছে জাতি।
পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে বাঙালির প্রথম প্রতিরোধের ৭৩তম বার্ষিকী এবার এমন সময়ে এল, যখন ছাত্র-জনতার আরেক রক্তাক্ত গণ অভ্যুত্থান পেরিয়ে ‘নতুন বাংলাদেশ’ গঠনের স্বপ্নের কথা বলা হচ্ছে।
রাজধানীতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ঘিরে জুলাই-অগাস্টের গণ অভ্যুত্থানের আবহের মধ্যে বৃহস্পতিবার প্রথম প্রহরে শ্রদ্ধা নিবেদনে শুরু হয়েছে ভাষা নিয়ে গর্ব আর শোকের এই দিন পালনের কর্মসূচি।
মাতৃভাষার জন্য রক্ত ঝরানো বীরদের স্মরণে প্রথম প্রহরের এই ক্ষণে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাশাপাশি শহর আর নগর ছাপিয়ে সব শহীদ মিনারেও চলছে শ্রদ্ধা নিবেদন।
শুক্রবার দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও পালন করা হবে শহীদ দিবস আর সব ভাষাভাষির অধিকার রক্ষার পথ দেখানোর গৌরববময় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসটি।
দিনের প্রথম প্রহরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জাতির পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টা ১০ মিনিটের ব্যবধানে পুষ্পস্তবক অর্পণ শেষে সেখানে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থেকে ভাষাশহীদদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
রাজনৈতিক পালাবদলের প্রেক্ষাপটে এবার ভিন্ন এক আবহে জাতি স্মরণ করছে ভাষা শহীদদের।
একুশে ফেব্রুয়ারিতে এবার ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানানোর আয়োজনে রয়েছে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ছাপ। প্রতিবছর শহীদ মিনার এলাকার দেয়ালে বিভিন্ন স্লোগান, কবিতা ও গানের লাইন লেখা হলেও এবার ভিন্ন প্রেক্ষাপটে সেখানে জায়গা করে নিয়েছে গ্রাফিতি।
এর বাইরে কোনো কোনো দেয়ালের উপরে ব্যানার বসানো হয়েছে, যেগুলোয় বিভিন্ন গান ও কবিতার লাইন কিংবা নানা স্লোগানে একুশকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
সব পথ মিশেছে শহীদ মিনারে
শ্রদ্ধা আর শহীদ স্মরণে ফুল হাতে দেশে-বিদেশে শহীদ স্মৃতির মিনারমুখী হয়েছে হাজারো মানুষ।
প্রথম প্রহরের আগেই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারসহ দেশের সব শহীদ মিনারে জড়ো হতে থাকেন মানুষ। ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে মধ্যরাতে ঘড়ির কাঁটা ১২টা ছোঁয়ার আগেই বরাবরের মত হাজারো মানুষ হাতে ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে যান শহীদ মিনার অভিমুখী লাইনে।
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাষ্ট্র পরিচালনায় নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তি এবং বিশিষ্টজনদের পর শহীদদের বেদীতে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন তারা।
একুশের প্রথম প্রহরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে প্রথমে শ্রদ্ধা জানান রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন এবং এর ১০ মিনিট পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
তারা যখন পুস্পস্তবক অপর্ণ করছিলেন তখন মাইকে বাজছিল অমর সেই গান ‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি…’। শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে তখন বেদনাবিধুর এক আবহ তৈরি হয়।
ছাত্র-জনতার গণ আন্দোলনে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ভিন্ন বাস্তবতায় রাষ্ট্রপতি হিসেবে দ্বিতীয়বার একুশের বেদিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন সাহাবুদ্দিন।
আর আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ছাত্রদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সরকারপ্রধানের দায়িত্ব নেওয়া মুহাম্মদ ইউনূস প্রথমবার প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। তিনি শহীদ মিনারে আসেন ১২টা ১০ মিনিটে। দুই মিনিট পর শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ফুল দেন।
এরপর প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদসহ আপিল বিভাগ ও হাই কোর্টের বিচারপতিরা ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।
তারা ফুল দেওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা একসঙ্গে শহীদদের বেদীতে ফুলেল শ্রদ্ধা জানান।
এরপর ঢাকায় দায়িত্বরত রাষ্ট্রদূত,কূটনীতিক, হাই-কমিশনাররা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বেদীতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন ও কমিশনাররা ভাষা শহীদদের বেদীতে এরপর ফুলেল শ্রদ্ধা জানান।
প্রথম প্রহরে শহীদ মিনারে এরপর তিন বাহিনীর প্রধানদের মধ্যে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল
মোহাম্মদ নাজমুল হাসান ও বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁন ফুল দেন।
এরপর অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান ফুল দিতে আসেন শহীদদের বেদীতে।
ভাষাশহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বেদীতে এরপর একে একে শ্রদ্ধা জানান পুলিশ মহাপরিদর্শক বাহারুল আলমসহ বিভিন্ন আইনশঙ্খলা বাহিনীর প্রধানরা।
সহকর্মীদের নিয়ে এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খানের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সদস্যরা শ্রদ্ধা জানান।
তাদের পুস্পস্তবক অর্পণ শেষে রাত ১২টা ৪০ মিনিট থেকে শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠনসহ অন্যরা শ্রদ্ধা নিবেদন করতে আসেন।
জুলাই-অগাস্টে ছাত্র-জনতার তুমুল আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে একুশে ফেব্রুয়ারিতে এবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানানোর আয়োজনে রয়েছে সেই অভ্যুত্থানের ছাপ। প্রতিবছর শহীদ মিনার এলাকার দেয়ালে বিভিন্ন স্লোগান, কবিতা ও গানের লাইন লেখা হলেও এবার ভিন্ন প্রেক্ষাপটে সেখানে জায়গা করে নিয়েছে গ্রাফিতি।
কোনো কোনো দেয়ালের উপরে ব্যানার বসানো হয়েছে, যেগুলোয় বিভিন্ন গান ও কবিতার লাইন কিংবা নানা স্লোগানে একুশকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় বাঙালির আত্মত্যাগের এ দিন এখন আর বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ নয়। ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে বিশ্বজুড়ে। বাঙালির ভাষার সংগ্রামের একুশ এখন বিশ্বের সব ভাষাভাষীর অধিকার রক্ষার দিন।
ঢাকার পাশাপাশি চট্টগ্রামসহ সারাদেশে প্রথম প্রহরেই শহীদ মিনারে শুরু হয়েছে শ্রদ্ধা জানানোর পালা, ফুলে ফুলে ভরে উঠতে শুরু করেছে স্মৃতির মিনার।
এবারও প্রথম প্রহরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অনুপস্থিত ছিল বিএনপি।
অন্য রাজনৈতিক দলের মধ্যে প্রথম প্রহরে শহীদ মিনারে এসেছে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ, রাজনৈতিক দল বিপ্লবী ধারা, বাংলাদেশ কংগ্রেস, গণ সংহতি আন্দোলন, গণ অধিকার পরিষদ, এবি পার্টি, গণ ফোরাম, জাতীয় নাগরিক কমিটি, ছাত্রদল, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, জুলাই অভ্যুত্থানে আহতদের পক্ষে একটি প্রতিনিধি দল, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি।
প্রথম প্রহরের অনুষ্ঠানের পর শুক্রবার দিনব্যাপী শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাবেন সবাই।
প্রভাত ফেরির মিছিল হবে পথে পথে
গৌরবময় সেই অতীত স্মরণ রাতেই শেষ হবে না। ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে প্রভাত ফেরির মিছিল হবে পথে পথে। শহর থেকে গ্রাম সবখানেই সেই মিছিল গিয়ে শেষ হবে একই জায়গায়, স্মৃতির মিনারে।
ফুলে ফুলে ভরে উঠবে শহীদ মিনারের বেদি। কবির ভাষায়, “প্রভাতফেরির মিছিল যাবে/ছড়াও ফুলের বন্যা/বিষাদগীতি গাইছে পথে/ তিতুমীরের কন্যা।“
ফুলের গুচ্ছ, স্তবক আর মালা থাকবে হাতে হাতে। কণ্ঠে মর্মস্পর্শী গান, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি...’।
১৯৫২ সালের এই দিনে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার গৌরবদীপ্ত আন্দোলনকে থামিয়ে দিতে রক্ত ঝরানোর নেশায় বন্দুক হাতে মেতে উঠেছিল তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের মিছিলে নির্বিচারে চলে গুলি। একে একে শহীদ হন রফিক, শফিক, জব্বার, বরকত, শফিউদ্দীন, সালামসহ আরও অনেকে।
বাঙালির সেই আত্মত্যাগের দিন এখন কেবল আর বাংলার নয়, প্রতিটি মানুষের মায়ের ভাষার অধিকার রক্ষার দিন। রাষ্ট্রীয় সীমানা ছাড়িয়ে ২১ ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষায় অমর একুশের চেতনা আজ অনুপ্রেরণার অবিরাম উৎস।
’দেশের উন্নয়নে ভাষার মর্যাদা রক্ষায় নিবেদিত সরকার’
বাঙালি জাতির ইতিহাসে স্মরণীয় এ দিবস উপলক্ষে দেওয়া বাণীতে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, “শত বছরের শোষণে ও শাসনে জর্জরিত বাঙালি জাতির মুক্তি সংগ্রামের প্রথম জয়যাত্রার সূচনা হয় ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে।
“বাঙালি জাতির মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়েই একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠনের ভিত রচিত হয়েছিল।”
সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারদের আত্মত্যাগ স্মরণ করে তিনি বলেন, ১৯৫৬ সালে বাংলা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পায় এবং ২১ ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস হিসেবে ঘোষণা করে এই দিনে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশ ও দেশের ভাষাসমূহের মর্যাদা রক্ষায় নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে, যা দেশের উন্নতি ও সমৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য।
“তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করতেও সরকার কাজ করছে। এছাড়াও ব্রেইল বইসহ বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর মাতৃভাষায় পাঠ্যপুস্তক বিনামূল্যে বিতরণ করা হচ্ছে।”
রক্তঝরা সেই দিন
বায়ান্নর সেই রক্তঝরা দিনে ভাষা সংগ্রামীদের মূলত তিনটি স্লোগান ছিল। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, রাজবন্দিদের মুক্তি চাই এবং সর্বস্তরে বাংলা চালু কর।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছিল পূর্ববাংলা ব্যবস্থাপক পরিষদের বাজেট অধিবেশন। সেদিন ডাকা হয় ধর্মঘট। ধর্মঘট প্রতিহত করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও তার আশপাশের এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে প্রশাসন। সেদিন ১৪৪ ধারা ভেঙে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে মিছিল নিয়ে এগিয়ে যায় বাংলা মায়ের দামাল সন্তানেরা। পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর নির্দেশে মিছিলের ওপর পুলিশের গুলি চলে।
ঢাকায় ছাত্রদের মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণে হত্যার প্রতিবাদে সেদিনেই দীর্ঘ কবিতা লিখেছিলেন চট্টগ্রামের রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী।
তিনি লিখেছিলেন- ‘যারা আমার মাতৃভাষাকে নির্বাসন দিতে চেয়েছে/ তাদের জন্য আমি ফাঁসি দাবি করছি/ যাদের আদেশে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে তাদের জন্য/ ফাঁসি দাবি করছি।”
এটিই ছিল একুশ নিয়ে লেখা প্রথম কবিতা।
অন্যদিকে ঢাকা মেডিকেলে আহত ছাত্রদের দেখতে গিয়েছিলেন তখনকার ঢাকা কলেজের ছাত্র আবদুল গাফফার চৌধুরী। মেডিকেলের বহির্বিভাগে তিনি ভাষা সংগ্রামী রফিকের মাথার খুলি উড়ে যাওয়া লাশ দেখতে পান।
সংগ্রামী রফিকের নিথর দেহ দেখে আবদুল গাফফার চৌধুরী লেখেন অমর কবিতা ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’। প্রথমে আব্দুল লতিফ ও পরে আলতাফ মাহমুদের সুরে সেই কবিতা হয় গান, যা এখন একুশে ফেব্রুয়ারি আয়োজনের অন্যতম অনুষঙ্গ।
মায়ের ভাষার সেই আন্দোলনকে দমাতে না পেরে শেষমেষ পিছু টান দেয় পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী। এরপর বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয় তারা। ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালে সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
বাঙালির সেই আত্মত্যাগের দিন এখন শুধু আর বাংলার নয়, প্রতিটি মানুষের মায়ের ভাষার অধিকার রক্ষার দিন। রাষ্ট্রীয় সীমানা ছাড়িয়ে ২১ ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষায় অমর একুশের চেতনা আজ অনুপ্রেরণার অবিরাম উৎস।
১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কোর এক ঘোষণায় ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
২১ ফেব্রুয়ারি দেশে সাধারণ ছুটির দিন। ভাষা শহীদদের স্মরণে এদিন জাতীয় পতাকা থাকবে অর্ধনমিত। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে অনুষ্ঠান হবে। জাতিসংঘের বাংলাদেশ মিশনেও অনুষ্ঠান হবে।
আলপনায় রঙিন শহীদ মিনারে চারপাশ
ভাষা শহীদদের স্মরণে প্রস্তুত রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। প্রতিবারের মত এবারও সাজ-সজ্জার দায়িত্ব পালন করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থীরা। তাতে সঙ্গে ছিলেন সাবেক শিক্ষার্থীরাও।
শহীদ মিনারে আলপনা আঁকার কাজ সাড়া হয়েছে আগেই। দিনের বেলায় শহীদ মিনারের মূল বেদির সিঁড়িগুলো লাল রঙে রঞ্জিত করা হয়। পরে রাতে বাকি আলপনা আঁকা হয় আশপাশের সড়কগুলোতে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কারুশিল্প বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী তূর্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "আমরা প্রতিবছর আলপনা আঁকার কাজটি পাই; এতে আমরা গর্বিত। এ বছর রং করার কোনো কাজ হয়নি; সবই আলপনা।"
আরেক শিক্ষার্থী সুপ্তি বলেন, শহীদ মিনার সংলগ্ন সড়কের পাশাপাশি টিএসসি চত্বরেও আলপনা আঁকা হয়েছে।
আরেক শিক্ষার্থী সৌরভ সরকার বলেন, "এই দিনটি বাঙালি জাতির সবচেয়ে বড় অর্জন। রক্তের বিনিময়ে আমরা কথা বলার স্বাধীনতা অর্জন করেছি।
“এই ভাষা আমরা রং তুলির মাধ্যমে আজীবন তুলে ধরব। যেখানেই থাকি, দিনটি এলে ছুটে আাসি এই প্রাঙ্গণে রক্তের আলপনা আঁকতে।"
নিরাপত্তার জাল
একুশের শ্রদ্ধানুষ্ঠান ভাবগাম্ভীর্য ও শান্তিপূর্ণভাবে পালনের লক্ষ্যে সন্ধ্যা থেকেই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারসহ পুরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সাধারণের প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়; পথ চলায়ও ছিল নিয়ন্ত্রণ।
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে কয়েক স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ। র্যাব ও গোয়েন্দারাসহ পুলিশের বিশেষ ইউনিটগুলো তাদের দল মোতায়েন করেছে পুরো এলাকায়।
একুশে ফেব্রুয়ারিতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে চার স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা বলেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী।
শহীদ দিবসে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার বিষয়ে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মো. সরওয়ার বলেন, শহীদ মিনারকেন্দ্রিক ব্যাপক লোক সমাগম হবে সেজন্য সাতটি পয়েন্ট রোড ব্লকার দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হবে।
পয়েন্টগুলো হল- শাহবাগ ক্রসিং, নীলক্ষেত ক্রসিং, শহিদুল্লাহ হল ক্রসিং, হাই কোর্ট ক্রসিং, চাঁনখারপুল ক্রসিং, পলাশী ও বকশীবাজার ক্রসিং।
পায়ে চলাচলের রাস্তা হল- পলাশী ক্রসিং হতে ভাস্কর্য ক্রসিং, জগন্নাথ হল ক্রসিং হয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে প্রবেশ এবং শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে রোমানা ক্রসিং-দোয়েল চত্বর ক্রসিং হয়ে বের হয়ে যেতে পারবেন। অন্য কোনো পথ দিয়ে বের হতে পারবে না।
তিনি বলেন, সাধারণত সন্ধ্যা ৬টায় সংশ্লিষ্ট রাস্তা বন্ধ করা হয়। তবে এবার ঢাকা শহরের ট্রাফিক পরিস্থিতি বিবেচনায় রাত ৮টায় নির্ধারণ করা হয়।