ব্যাপক দর্শনার্থী সমাগমে খুশি বিক্রয় কর্মীরা। বইপ্রেমীরা স্টল ঘুরে ঘুরে বই দেখছেন, কিনছেন আর স্মৃতি হিসেবে নিজেদের মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় ধরে রাখছেন।
Published : 09 Feb 2025, 12:22 AM
রেওয়াজ মেনে ভাষার মাসের প্রথম দিনে অমর একুশে বইমেলার পর্দা উঠলেও মেলা জমল সপ্তাহ শেষে সরকারি ছুটির দিনে গিয়ে।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যান প্রাঙ্গণে শুক্র ও শনিবারের জনস্রোতে উৎসবের প্রাণ পেয়েছে প্রকাশনীগুলো; যেন এই দুই দিনের জন্যই অপেক্ষায় ছিলেন বিক্রয়কর্মীরা।
ব্যাপক দর্শনার্থী সমাগমের সঙ্গে বিক্রি বাড়ায় তারা খুশি। বইপ্রেমীরাও স্টল ঘুরে ঘুরে বই দেখছেন, কিনছেন আর স্মৃতি হিসেবে নিজেদের মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় ধরে রাখছেন ঘোরাঘুরি আর প্রিয়জনের সঙ্গে দেখা হওয়ার ক্ষণটুকু।
চব্বিশের রক্তঝরা গণআন্দোলনে ক্ষমতার পালাবদলে এবার এক ভিন্ন এক প্রেক্ষাপটে ১ ফেব্রুয়ারি পর্দা উঠেছে বইমেলার। ভাষা শহীদ, মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের পাশাপাশি জুলাই আন্দোলনে প্রাণ হারানো ছাত্র-জনতাকেও মেলায় শ্রদ্ধার আবহে রাখা হয়েছে। রঙ আর সাজসজ্জাতেও সেই ছটা ফুটেছে।
মেলা শুরুর পর থেকে প্রতিদিনই আসছে নতুন বই। ক্রেতা-দর্শনার্থীরাও আসছেন দূর-দূরান্ত থেকে।
তাদের কেউ কেউ বলছেন, সবকিছু ঠিক থাকলেও কোথায় যেন মনে হচ্ছে খানিকটা ‘ছন্দপতন’। শনিবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে মেলায় এসে সে কথাই বললেন কবি, গবেষক জয়দুল হোসেন। নবান্ন প্রকাশনী থেকে এসেছে তার ‘ফুল পাখি চাঁদ’ কবিতার বই।
তার ভাষায়, মেলায় লেখক-সাহিত্যিকদের উপস্থিতি তুলনামূলক কম। হয়ত সে কারণেই খানিকটা ‘অন্যরকম’ লাগছে।
জয়দুলের সুর মিলল কবি শাহেদ কায়েসের কথাতেও। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “বইমেলার পরিবেশ এবার খুব ভালো। লিটলম্যাগ চত্বরকে এবার বিগত কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে নান্দনিক লাগছে। বসার জায়গাও করা হয়েছে।
“কিন্তু লিটলম্যাগ কর্মীদের অনেককেই মেলায় দেখছি না। প্রাণবন্ত আড্ডাটা নেই। লেখকদের উপস্থিতিও বিগত বছরের তুলনায় কম।”
ক্ষমতার পালাবদলে পরিবর্তিত পরিস্থিতির মধ্যে হচ্ছে এবারের বইমেলা। ফলে আগের সরকারের সঙ্গে ‘সখ্য থাকায়’ কবি-লেখকদের অনেকে মেলা থেকে নিজেদের দূরে রাখছেন বলে বইমেলা সংশ্লিষ্টদের কেউ কেউ দাবি করছেন।
নাম প্রকাশ না করে প্রকাশকদের একজন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অনেক লেখকই আছেন, যারা মেলায় আসলে ঝামেলা হতে পারে।…এজন্য অনেক লেখকই মেলায় আসছেন না। তবে এখন পর্যন্ত মেলার পরিবেশ ভালো।”
অপরদিকে মেলার শিশু চত্বরে শুক্রবার আসেনি সিসিমপুরের ইকরি-হালুমরা। ফলে শিশুপ্রহরে তাদের না পেয়ে শিশু-সন্তানদের নিয়ে আসা অনেকেই হতাশ হন।
শনিবার গেছে বইমেলার অষ্টম দিন। দুপুর ২টা থেকে শুরু হয়ে মেলা চলে রাত ৯টা পর্যন্ত। আগের দিন শুক্রবারের মত এদিনও উপচে পড়া ভিড় ছিল মেলায়। নিরাপত্তার দায়িত্বে দেখা গেছে পুলিশ সদস্যদের।
বইমেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব সরকার আমিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পুলিশের ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে, মেলার মাঠের নিরাপত্তা নিয়ে আরও তৎপর হয়েছেন।”
নতুন বই
বইমেলা পরিচালনা কমিটির জনসংযোগ বিভাগ বলছে, শনিবার মেলায় নতুন বই এসেছে ১০২টি। এর মধ্যে গল্প ১৬টি, উপন্যাস ১৯টি, প্রবন্ধ ছয়টি, কবিতা ২৯টা, ছড়া দুইটি, জীবনী বই তিনটি, বিজ্ঞান বিষয়ক একটি, ভ্রমণ বিষয়ক দুটি, ইতিহাস নির্ভর একটি, রাজনীতি বিষয়ক দুটি, ধর্মীয় বই চারটি, অনুবাদ বই একটি এবং অন্যান্য বিষয়ের ১৫টা বই এসেছে।
এর মধ্যে কথাপ্রকাশ এনেছে ওয়াসি আহমেদের প্রবন্ধের বই 'টিকিটাকা'। আগামী প্রকাশনী এনেছে এ কে শেরামের 'বাংলাদেশের মণিপুরী ত্রয়ী সংস্কৃতির ত্রিবেণিসংগমে'।
বাংলা একাডেমি এনেছে তানভীর দুলালের 'তিন কবির কাব্যভাষা: শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, আল মাহমুদ'।
গান, কবিতা, আলোচনা
অমর একুশ উদযাপনের অংশ হিসেবে সকাল সাড়ে ৯টায় বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে শিশু-কিশোর সংগীত প্রতিযোগিতার প্রাথমিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে তিন শাখায় মোট ১৩৯ প্রতিযোগী অংশগ্রহণ করে।
এদিন 'লেখক বলছি' মঞ্চে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন কবি ও প্রাবন্ধিক মজিদ মাহমুদ এবং কবি জব্বার আল নাইম।
জুলাইর গল্প মঞ্চে জুলাই গণঅভ্যুত্থান ২০২৪ এর শহীদ স্মরণে অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে কথা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মালিহা নামলাহ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাফিসা ইসলাম সাকাফি।
বিকাল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘একজন মোহাম্মদ হারুন-উর-রশিদ’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন রফিক-উম-মুনীর চৌধুরী। আলোচনায় অংশ নেন আবদুস সেলিম এবং মোহাম্মদ হারুন রশিদ। সভাপতিত্ব করেন খালিকুজ্জামান ইলিয়াস।
রফিক-উম-মুনীর চৌধুরী বলেন, “মোহাম্মদ হারুন-উর-রশিদ ছিলেন একাধারে শিক্ষক, শিক্ষাবিদ, প্রশাসক, কবি, লেখক, অনুবাদক ও সুফিবাদ চর্চাকারী। তার লেখনী ও ভাষার অন্যতম আকর্ষণীয় বিষয় হল সহজবোধ্যতা ও রসবোধ। সময়ের পেক্ষাপটে তার চিন্তাচেতনা বেশ আধুনিক ও সময়োপযোগী ছিল, যার আবেদন বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে আরও অর্থবহ হয়ে উঠেছে।”
সাংস্কৃতিক পর্বে কবিতা পাঠ করেন কবি ফরিদ সাইদ ও প্রদীপ মিত্র। আবৃত্তি পরিবেশন করেন কামাল মিনা ও ফারহানা পারভীন হক তৃণা।
মেলায় সংগীতের পাশাপাশি নাচ পরিবেশনাও ছিল।
রোববার যা থাকছে
সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবস রোববার মেলা শুরু হবে বিকাল ৩টায়, চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত। বিকাল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে হবে ‘স্মরণ: মাকিদ হায়দার’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন চঞ্চল আশরাফ। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন আসিফ হায়দার এবং সৈকত হাবিব।