গত দেড় দশকে উচ্চ আদালত অধিকার হরণ করার, মানুষকে নির্যাতন করার হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে, বলেন তিনি।
Published : 28 Dec 2024, 10:16 PM
উচ্চ আদালতে ‘ভালো’ বিচারককে দায়িত্ব দেওয়ার গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছেন, ৫২ বছর আগের একটি সংবিধান তাদের কাজ থামিয়ে দেবে তা তিনি মানতে রাজি নন।
উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগ বিষয়ক অধ্যাদেশ নিয়ে শনিবার এক মতবিনিময় সভায় তিনি এ কথা বলেন।
বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে ‘সুপ্রীম কোর্টের বিচারক নিয়োগ অধ্যাদেশ, ২০২৪‘ শীর্ষক এই মতবিনিময় সভায় উপদেষ্টা বলেন, “উচ্চ আদালতে ভালো বিচারক নিয়োগ করতে হবে। আমাদের কিছু করতে হবে।”
বিদ্যমান ব্যবস্থা কাজ করছে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, কিছু করতে হলে আইনের মাধ্যমে করতে হবে। উচ্চ আদালতে আরো সৎ, আরো যোগ্য ও আরো নিবেদিত বিচারককে দায়িত্ব দিতে হবে।
অধ্যাদেশের চূড়ান্ত খসড়া করা ও সাংবিধানিকভাবে সাংঘর্ষিক কিছু আছে কি না তা দেখার প্রয়োজনীয় তুলে ধরে তিনি বলেন, “৫২ বছর আগের একটি সংবিধান আমাদের থামিয়ে দেবে, তা মানতে আমরা রাজি না।”
উচ্চ আদালতে ভালো বিচারককে দায়িত্ব দেওয়া কেন গুরুত্বপূর্ণ, তা ব্যাখ্যা করে আসিফ নজরুল বলেন, “আমাদের নাগরিকদের সমস্ত অধিকার সংক্রান্ত মামলা উচ্চ আদালতের বিচারকরা শোনেন। বালাদেশের ১৬/১৭ কোটি মানুষের মৌলিক অধিকার লংঘন সংক্রান্ত মামলা উচ্চ আদালতের বিচারকরা শোনেন।”
উচ্চ আদালতের বিচারকদের আপিল বিভাগের বিচারক হিসেবে কাজ করার বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদ এর অধীনে, এমনকি মৌলিক বিষয় ছাড়াও অন্য বিষয়ে তারা নিশ্চিত হলে হস্তক্ষেপ করতে পারেন।
নিম্ন আদালতের তদারকির কথা স্মরণ করিয়ে তিনি বলেন, “বাংলাদেশের সংবিধানে উচ্চ আদালতের বিচারকদের প্রচণ্ডভাবে ক্ষমতাশালী করা হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠান যদি নষ্ট করা যায়, তাহলে যেকোনো ‘রিপ্রেসিভ গভর্নমেন্ট’ এসে সকল ধরনের মানবাধিকার দমন করার এক অবাধ সুযোগ পেয়ে যাবে।
“একজেক্টলি গত ১৫ বছরে এ কাজটিই করা হয়েছে। উচ্চ আদালত অধিকার হরণ করার, মানুষকে নির্যাতন করার হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।”
এ বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী খাদিজাতুল কোবরার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “এমন ঘটনাও ঘটেছে, আপিলেট ডিভিশন জামিনের পিটিশন ডিলে করেছে শুধু খাদিজাতুল কোবরা যে মেয়েটা ছিল, তাকে বেশিদিন জেলে রাখার জন্য। জঘন্য সব ঘটনা ঘটেছে।”
ক্ষমতার পালাবদলের পর সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সংস্কারের দাবি ওঠে। তার আঁচ লাগে বিচার বিভাগেও। তাদের দাবির মুখে গত ১০ অগাস্ট প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান পদত্যাগ করেন।
এরপর অক্টোবরে উচ্চ আদালতের ১২ বিচারপতিকে বিচারিক দায়িত্ব থেকে বিরত রাখার সিদ্ধান্ত হয়। ডিসেম্বরে কয়েকজন বিচারপতির বিষয়ে তদন্ত শেষে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রতিবেদন পাঠিয়েছে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল। এর আগে বিচারপতি অপসারণে জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনর্বহাল করা হয়।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারেরে আমলে বিচারক নিয়োগে অনিয়মের কথা তুলে ধরে আইন উপদেষ্টা বলেন, “উচ্চ আদালতে এমন বিচারক নিয়োগ পেয়েছিল যে নিম্ন আদালতে বিচারক নিয়োগ পরীক্ষায় ফেল করেছিল, যে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করেছে। আইন কলেজ থেকে পাশ করেছে। এমন বিচারক আছে যে কোনোদিন কোর্টে প্র্যাকটিস করে নাই।
“আমাদের আইন সমিতির প্রোগ্রাম যখন হতো, সবচেয়ে ফাঁকিবাজ, নিম্ন মরালিটির, সবচেয়ে অমনোযোগী, সবচেয়ে পলিটিক্যালি বায়াসড যাদেরকে দেখতাম তাদেরকে… আমি হতবাক হয়ে যেতাম তারা বলে– স্যার আমি তো জাজ। হাই কোর্টের জাজ।”
এ সমস্যা নিয়ে তাদের কাজ করতে হবে বলেছেন আসিফ নজরুল।
শুধুমাত্র উচ্চ আদালতে নয়, প্রধান বিচারপতিসহ সর্বোচ্চ আদালতেও নিয়োগ বা জ্যেষ্ঠতা দেওয়ার ক্ষেত্রে অনিয়ম অনাচারের কথা বলেন তিনি।
প্রত্যেকটি বিষয় একে একে সামনে এনে সেগুলো নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমরা অত্যন্ত লাকি। আমরা রিফর্ম মাইন্ডেড একজন চিফ জাস্টিস পেয়েছি। সবাই আসেন আমরা ভালো কিছু আইন করে যাই। ভালো কিছু অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়ে যাই।”
মতবিনিময় সভায় সভাপতিত্ব করেন আইন উপদেষ্টা নিজেই। শুরুতে প্রস্তাবিত অধ্যাদেশের খসড়া উপস্থাপন করেন আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মারুফ আল্লাম। এরপর সবাই মতামত দেওয়া শুরু করেন।
সেখানে বক্তব্য রাখেন- পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক বোরহান উদ্দিন খান, সাবেক বিচারপতি মিফতাহ উদ্দিন চৌধুরী ও শামীম আহসান, অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জয়নুল আবেদীন, রুহুল কুদ্দুস কাজল, সারাহ হোসেন, জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।