হীরা বলেন, "তারা কিসের ভিত্তিতে আমাদেরকে মিলনায়তন বরাদ্দ বাতিল করল? এর জন্য তো তাদের ব্যাখ্যা দিতে হবে।"
Published : 13 Apr 2025, 04:51 PM
সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপে নাট্যদল ‘প্রাঙ্গণেমোর’ প্রযোজিত 'শেষের কবিতা' নাটক অবশেষে মঞ্চে প্রদর্শনীর অনুমতি পেয়েছে।
চৈত্রসংক্রান্তি ও পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে ঢাকার নাটক সরণির মহিলা সমিতি মিলনায়তনে টানা দুই দিন এ নাটকের প্রদর্শনী হবে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
তবে ‘প্রাঙ্গণেমোর’ বলছে, তারা রোরবারের প্রদর্শনীটি করতে পারছে না। এর জন্য মঙ্গলবার তারা বাড়তি মিলনায়তন বরাদ্দ চায়।
প্রাঙ্গণেমোরের প্রধান অনন্ত হীরা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "প্রশাসন এবং মহিলা সমিতি থেকে আমাদেরকে আজকে এবং কাল শো করার জন্য বলেছে। কিন্তু থিয়েটার তো হুট করে বললেই করা যায় না। আমাদের নাটকের সেট সকালে মহিলা সমিতি থেকে ফিরে এসেছে। আমাদের দর্শকের তো জানাতে হবে। এজন্য আমরা আজকের শোটা করতে পারছি না।"
এর জন্য আরেকদিন মিলনায়তন বরাদ্দ দেয়ার জন্য মহিলা সমিতিকে বলা হয়েছে বলে জানিয়েছেন অনন্ত হীরা।
শেষের কবিতা নাটকের নির্দেশক নূনা আফরোজ জানিয়েছেন প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রদর্শনী করার ব্যাপারে ‘সর্বোচ্চ আশ্বাস মিলেছে’।
তিনি বলেন, “আমরা আজকের প্রতিবাদ সমাবেশটা করছি না। আজকে আমাদের যে সময় জানানো হয়েছে, তখন আর শো করার মত পর্যাপ্ত সময় নেই। এজন্য আজকের প্রদর্শনীটিও হচ্ছে না। তবে পহেলা বৈশাখে যথারীতি শো করবো।“
'তৌহিদী জনতার’ হুমকি চিঠি পেয়ে নাট্যদল প্রাঙ্গণেমোর প্রযোজিত 'শেষের কবিতা' নাটকের প্রদর্শনী বাতিল করা হয়েছে বলে খবর আসে সকালে।
নূনা আফরোজ বলেন, "আমরা সব রকম প্রস্তুতি শেষ করে প্রদর্শনীর জন্য প্রস্তুত ছিলাম। সকালে আমাদেরকে জানানো হল, মিলনায়তনের বরাদ্দ বাতিল করা হয়েছে। 'তৌহিদী জনতা' নাকি হুমকি দিয়েছে।"
এ নাটকের প্রদর্শনীর সময় মহিলা সমিতিতে ভাঙচুর হলে তার দায় 'তৌহিদী জনতা' নেবে না বলা হয়েছে হুমকির ওই চিঠিতে। আর ওই চিঠি পেয়ে ‘নিরাপত্তার’ কথা বিবেচানায় নিয়ে মহিলা সমিতি কর্তৃপক্ষ প্রাঙ্গণেমোরকে দেওয়া মিলনায়তন বরাদ্দ বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেয়।
হুট করে মিলনায়তন বরাদ্দ বাতিল করার প্রতিবাদে বিকেলে নাটকের পোশাক পরে মহিলা সমিতির সামনে সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছিল প্রাঙ্গণেমোর।
হীরা বলেন, "তারা কিসের ভিত্তিতে আমাদেরকে মিলনায়তন বরাদ্দ বাতিল করল? এর জন্য তো তাদের ব্যাখ্যা দিতে হবে। যে তৌহিদী জনতার দোহাই দিয়ে আমাদের বরাদ্দ বাতিল করেছে, সেই চিঠিটা পর্যন্ত আমাদের দেয়নি। পুলিশকেও জানায় নি।"
"প্রশাসনকে জানিয়েছি। প্রশাসন আমাদের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। এজন্য আমরা আগামিকালের শোটা করবো। তার পরদিন মিলনায়তন চেয়েছি। আজ বিকেলে প্রতিবাদ সমাবেশটাও হবে, এই সমাবেশ থেকেই আমরা দর্শকদের বিস্তারিত জানাবো।"
মহিলা সমিতির এক্সিকিউটিভ অফিসার সৈয়দা শারমিন আরা রোববার দুপুরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "পুলিশের কর্মকর্তারা এসেছিলেন। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকেও আমাদের সঙ্গে কথা বলেছে। আমরা প্রাঙ্গণেমোরকে দুই দিনের জন্য যে মিলনায়তন বরাদ্দ দিয়েছিলাম, তার বরাদ্দ এখন বহাল রেখেছি। তারা চৈত্রসংক্রান্তি এবং পয়লা বৈশাখে শো করতে পারবেন। এটা তাদের জানিয়ে দিয়েছি।"
সকালে শারমিন আরা বলেছিলেন, "আমাদের কাছে একটা চিঠি এসেছে 'তৌহিদী জনতা' নামে। মহিলা সমিতিতে তো আরো অনেক ধরণের কার্যক্রম পরিচালিত হয়। মহিলা সমিতির নিরাপত্তার কথা ভেবে প্রাঙ্গণেমোরকে দেওয়া মিলনায়তন বরাদ্দ বাতিল করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।"
পুলিশ প্রশাসনের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে কী না প্রশ্নে তিনি বলেছিলেন, "বিষয়টি পুলিশকে জানানো হয়নি। আমাদের কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়ে মিলনায়তন বরাদ্দ বাতিল করেছে।"
‘তৌহিদী জনতার’ চিঠিতে যা আছে
‘তৌহিদী জনতার’ চিঠির একটি কপি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম দেখেছে।
তৌহিদী জনতা নাটক বন্ধের দাবি জানিয়ে যে চিঠি দিয়েছে, তাতে বিষয়ে লেখা আছে '১৩ ও ১৪ জুলাই ফ্যাসিবাদের দোসর নুনা আফরোজের নাটক বন্ধ বিষয়ে'।
চিঠিতে লেখা হয়েছে, "আসসালামু আলাইকুম। আপনি/আপনারা অবগত আছেন যে গত ৫ অগাস্ট ২০২৪ স্বৈরাচার শেখ হাসিনা নিরীহ ছাত্র জনতার উপর যে পৌশাচিক হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল। আর সেই হত্যাযজ্ঞ সমর্থন করে তখন অনেক কথিত সংস্কৃতিকর্মীরা ফ্যাসিস্ট হাসিনার সুরে জয়ধ্বনী দিয়েছিল। তারা ফেইসবুকসহ বিভিন্ন মিডিয়াতে সাধারণ জনতার বিরুদ্ধে গিয়ে লেখালেখি ও মিথ্যে প্রচারণা শুরু করে যা এখনো অব্যাহত আছে। তাদের মধ্যে অন্যতম একজন নুনা আফরোজ।"
নুনা আফরোজের সমালোচনা করে চিঠিতে লেখা হয়েছে, "এই নুনা আফরোজ ফ্যাসিস্ট হাসিনার আলো আসবেই গ্রুপের অন্যতম সক্রিয় সদস্য। যে এখনো বিভিন্ন সময়ে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অপপ্রচার ও কটুক্তি করে চলেছে। তারই নির্দেশনায় আগামী ১৩ ও ১৪ এপ্রিল আপনাদের মহিলা সমিতি মিলনায়তনে প্রাঙ্গনেমোর নাট্যদল নাটক করবে। আপনারা এই ফ্যাসিস্টের দোসরকে কোন নীতিতে হল বরাদ্দ দিয়েছেন তা আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে।
"এমনিতে সারা দুনিয়ায় মুসলমান নিধন বিশেষ করে ফিলিস্তিনের নিরীহ মুসলমাদের উপর যে হত্যা তৎপরতা ইহুদিরা ঘটিয়ে চলেছে সেই মুহূর্তে ফ্যাসিস্টদের নাটক নিয়ে আনন্দ উদযাপন করার জন্য আপনারা যে সুবিধা তাদের করে দিচ্ছেন তা খুবই দুঃখজনক।"
"আপনাদের কাছে বিনিত অনুরোধ জানাচ্ছি, আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে খুনি হাসিনার সহযোগী আলো আসবেই গ্রুপের অন্যতম সদস্যা নুনা আফরোজ এবং প্রাঙ্গনেমোরের নামে হল বরাদ্দ বাতিল করে নাটকটি বন্ধ করতে সহযোগিতা করুন। নয়তো তৌহিদী জনতার পক্ষ থেকে আমরা তা বন্ধ করে দিতে বাধ্যে হব এবং যে কোন আরাজক পরিস্থিতির দায় তৌহিদি জনতা নেবে না। ছাত্র জনতার পক্ষে নতুন বাংলাদেশ নির্মাণে আপনাদের সহযোগিতা আশা করি।"
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাস থেকে এর নাট্যরূপ দিয়েছেন অনন্ত হীরা আর নির্দেশনা দিয়েছেন নূনা আফরোজ। এটি দলের ষষ্ঠ প্রযোজনা।
এর আগে গত ফেব্রুয়ারি মাসে মহিলা সমিতি মিলনায়তনে একদল ব্যক্তির হুমকির মুখে স্থগিত হয়েছিল ‘ঢাকা মহানগর নাট্যোৎসব’। পরে রোজার মাসে মহিলা সমিতি কর্তৃপক্ষ কোনো নাট্যদলকে মিলনায়তনে বরাদ্দ দেয় নি।
রোজার ঈদের পর প্রাঙ্গণেমোরের 'শেষের কবিতা' দিয়ে মহিলা সমিতিতে ফের নাটকের প্রদর্শনী শুরু হওয়ার কথা থাকলেও, ‘তৌহিদী জনতার’ হুমকি চিঠিতে সেই প্রদর্শনীও অনিশ্চয়তায় ডুবতে বসেছিল।
চলতি মাসের শুরুতে মসজিদ কমিটির লোকজন ও ‘এলাকাবাসীর’ বাধায় স্থানীয় রানীগঞ্জ উদয়ন সংঘের একটি নাটকের প্রদর্শনী বন্ধ হয়ে যায় গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলায়। পরে অবশ্য ‘রাজনৈতিক নেতাদের দ্বন্দ্বে’ বন্ধ হয়ে যাওয়া 'আপন-দুলাল' নাটকটি মঞ্চস্থ হয় একদিন পর।
এর আগে গেল বছরের নভেম্বরের শুরুতে রাজধানীতে শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় একদল ব্যক্তির বিক্ষোভের মুখে 'নিত্যপুরাণ' নাটকের প্রদর্শনী মাঝপথে বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছিলেন আয়োজকরা।
'তৌহিদী জনতার' হুমকি চিঠি, 'শেষের কবিতা' নাটকের প্রদর্শনী বাতিল
হুমকির মুখে স্থগিত ঢাকা মহানগর নাট্যোৎসব
সমাজে 'কু-প্রভাব' পড়ে! কাপাসিয়ায় আটকানো হল নাটকের মঞ্চায়ন
কাপাসিয়ায় 'দ্বন্দ্ব মিটিয়ে' মঞ্চে 'আপন-দুলাল'
হঠাৎ বিক্ষোভে শিল্পকলায় মাঝপথে বন্ধ হল নাটকের প্রদর্শনী