শেখ হাসিনার পতনের পর ঢাকার কচুক্ষেত থেকে মিন্টোরোডের ডিবি কার্যালয়, আরও কত জায়গায় নিখোঁজদের খুঁজে ফিরছেন স্বজনরা।
Published : 08 Aug 2024, 01:36 AM
আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১৫ বছরে নিখোঁজ ও গুম হওয়া ব্যক্তিদের খোঁজ শুরু করেছেন স্বজনরা, যার অংশ হিসেবে ঢাকার ডিবি কার্যালয়ের ভেতরে ‘তল্লাশি’ চালিয়েছেন তারা।
আওয়ামী লীগ শাসন আমলে নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনেরা ঢাকার মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে আসছেন। ডিবির সদস্যরা তাদের ভেতরে গিয়ে দেখিয়ে নিয়ে আসছেন যে ‘কোথাও কেউ নেই’।
ভেতর ঘুরে এসে কয়েকজন বলেন, ভেতরে তারা অনেকগুলো ছোট ছোট ‘সেল’ দেখেছেন। যেখানে নিকট অতীতে মানুষ ছিল বলে তাদের মনে হয়েছে।
স্বজনরা বলছেন, এত দিন ডিবির কর্মকর্তারা বিভিন্ন জায়গায় গ্রেপ্তার অভিযান চালিয়েছেন। অন্যায়ভাবে লোকজনকে এখানে বন্দি করে রাখার কথা তারা জেনেছেন। সে কারণে এবার ডিবি কার্যালয়ের ভেতরে ঢুকে নিজেরাই তল্লাশি করে দেখছেন।
বুধবার বিকালে ডিবি কার্যালয়ের সামনে গিয়ে দেখা যায়, সেনা সদস্যরা ফটকে অবস্থান নিয়েছেন। কিছু তরুণ ডিবির দেওয়ালে গ্রাফিতি আঁকছেন। সেখানে লেখা হয়েছে, ‘স্টপ ফলোয়িং অর্ডারস দ্যাট ডাজ নট সার্ভ জাস্টিস- আদেশক্রমে সাধারণ জনগণ’।
গুম বন্ধের দাবি জানিয়ে লেখা হয়েছে, ‘নো মোর ইল্যিগাল অ্যারেস্ট ইন বাংলাদেশ’। যে সরকারই থাকুক না কেন পুলিশ যেন জনগণকে সেবা দেয় সে বিষয়টিও এসেছে তাদের গ্রাফিতিতে- ‘হুয়েভার ইজ ইন পাওয়ার, পুলিশ মাস্ট সার্ভ দ্যা পাবলিক’।
তখন নিখোঁজ ব্যক্তিদের কিছু স্বজন ভিড় করছিলেন ফটকে। নিখোঁজদের স্বজন পরিচয় দিলে তাদের ছোট ছোট দলে ভেতরে নিয়ে গিয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়ে আনছেন ডিবির এএসআই রাজিউল ইসলামসহ কয়েকজন।
এএসআই রাজিউল বলছেন, যেদিন শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে সেদিন বিকালেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা এসে ডিবি কার্যালয় ঘুরে কোটা আন্দোলনে গ্রেপ্তার হওয়া সব বন্দিদের মুক্ত করে নিয়ে গেছেন। এখন আর ভেতরে কেউ নেই।
মোবাইল ফোন বের করে কোটা আন্দোলনের সমন্বয়কদের ডিবি কার্যালয়ে ‘তল্লাশি অভিযানে’র ছবি দেখান এএসআই রাজিউল। এরপরও যদি কেউ সন্তুষ্ট না হন, তাহলে তাকে ভেতরটা ঘুরিয়ে আনছেন তিনি ও তার সহকর্মীরা।
বুধবার সন্ধ্যায় ডিবি কার্যালয়ে আসেন গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের সংগঠন ‘মায়ের ডাক’ এর সদস্য ছয়টি নিখোঁজ পরিবার। পরে সংগঠনটির সহপ্রতিষ্ঠাতা সানজিদা তুলিসহ দুজনকে ডিবি কার্যালয়ের ভেতরে নিয়ে যান এএসআই রাজিউল।
সেখানে তারা কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের (সিটিটিসি) আটতলা ভবন, ডিবি প্রধানের বসার অফিসসহ (দোতলা) আশপাশের টিনশেড স্থাপনাগুলোও ঘুরে দেখেন। তারা ডিবির আটতলা ভবনটিতেও যান। এক ঘণ্টারও বেশি সময় ভেতরে ঘুরে ফিরে বাইরে বেরিয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলে সানজিদা তুলি।
সানজিদা বলেন, “ডিবির সদস্যরা আমাদের ভেতরে নিয়ে গিয়েছেন। আমরা সিটিটিসির ভবন, হারুন সাহেবের অফিসসহ ডিবির অফিসটাও ঘুরে দেখেছি। হারুন সাহেব যে ভবনে বসতেন সেখানে একটি হাজত আছে। সেটি আবার শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত।
“এ ছাড়া আরেকটি ভবনে (সিটিটিসি) আমরা গিয়েছি। সেখানে নিচতলায় একটি হাজত আছে। আবার ওপরের তলায় অনেকগুলো ছোট ছোট সেল আমরা দেখেছি। দু-তিনজন লোক থাকতে পারে এ রকম একেকটি সেলের মেঝেতে থাকার ব্যবস্থা। সেলের সঙ্গে এটাচড বাথরুম। সেলগুলোর সামনে লোহার শিক দিয়ে আটকানো, শিকের ওপর আবার স্টিলের নেট দিয়ে মোড়ানো। সেখানে আমরা তোশক-বিছানা দেখতে পেয়েছি। পানির বোতল-ওষুধও দেখেছি একটিতে। “
এরকম আটটি সেল দেখার কথা তুলে ধরেন সানজিদা। তিনি সেখানকার ভিডিও ধারণ করেছেন। তার ভিডিও দেখে ধারণা করা যায়, একেকটি সেলের আকার আট ফিট বাই পাঁচ ফিটের মত। কোনো জানালা নেই। একটা এটাচড বাথরুম আছে। ভবনের নিচতলায় নিয়মিত হাজতখানার বাইরে ওপরতলায় এ রকম সেল দেখে সন্দেহ প্রকাশ করে সানজিদা বলেন, “এখানে নিশ্চই কাউকে আটকে রাখা হয়েছিল।”
তবে ডিবির এএসআই রাজিউল বলছেন, ডিবিতে এখন আটক কোনো ব্যক্তি নেই। কোটা আন্দোলনে আটকদের সোমবারই নিয়ে গেছেন সমন্বয়কারীরা। বাকিদের খবর তিনি জানেন না ।
ডিবির আটটি ডিভিশনে কোটা আন্দোলন ছাড়াও বিভিন্ন মামলার রিমান্ডের আসামিসহ আরও কিছু ব্যক্তি আটক ছিলেন বলে জানাচ্ছেন কর্মকর্তারা। তাদের কারাগারে পাঠানোর সুযোগ পাওয়া যায়নি। কিছু নিয়মিত মামলার আসামি পালিয়ে যেতে পারেন বলে একজন কর্মকর্তা ধারণা দিয়েছেন। তবে কর্মকর্তাদের কেউ দপ্তরে না আসায় বিষয়গুলো এখনও সুনির্দিষ্টভাবে নিরূপণ করা যায়নি।
কচুক্ষেত থেকে মিন্টোরোডে স্বজনেরা
সানজিদার ভাই স্থানীয় বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনসহ আটজনকে ২০১৩ সালের ২ ডিসেম্বর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা ও শাহীনবাগ থেকে র্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই সময়ই সুমনের মা হাজেরা খাতুনকে কেন্দ্র করে তার পরিবারের উদ্যোগে গড়ে ওঠে ‘মায়ের ডাক’ নামের সংগঠনটি। গত প্রায় ১১ বছর ধরে নিখোঁজ স্বজনদের খুঁজে পেতে সংবাদ সম্মেলন, মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করে আসছেন তারা।
বলপূর্বক অন্তর্ধান বা গুমের আন্তর্জাতিক পর্যায়েও এই নিখোঁজের বিষয়টি নিয়ে গেছেন সানজিদা। ঢাকায় কর্মরত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত বিভিন্ন সময় তাদের বাসায় গেছেন, এটি নিয়ে রাজনীতিতে অনেক আলোচনাও হয়েছে।
শেখ হাসিনার পতনের পর গত দুই দিন ধরে সানজিদাসহ মায়ের ডাকের সদস্যরা ঢাকার কচুক্ষেতে সরকারের একটি সংস্থার কার্যালয়ের সামনে অবস্থান করছিলেন।
সানজিদা বলছিলেন, “আমাদের ধারণা ছিল, আমাদের স্বজনরা ডিজিএফআইর কাছে আছে। সেখানে ‘আয়নাঘর’ নামের একটি বন্দিশালায় তাদের আটকে রাখা হয়েছে। আমরা আশা করছিলাম, শেখ হাসিনার পতনের পর তাদের মুক্তি দেওয়া হবে।
“এর মধ্যেই দুইজন সেখান থেকে মুক্তি পেয়েছেন বলে আমরা শুনেছি। এদের একজন জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আজমের ছেলে সাবেক সেনা কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ হিল আমান আজমি, আরেকজন জামায়াতের মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত নেতা মীর কাসেম আলীর ছেলে ব্যারিস্টার আহমাদ বিন কাসেম আরমান।”
জামায়াতের অফিসিয়াল টেলিগ্রাম চ্যানেলে মঙ্গলবার এই দুজনের মুক্তি তথ্য দেওয়া হয়।
সানজিদা বলেন, বুধবারও তারা দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কচুক্ষেতে অবস্থান করেছেন।
সারা দিন কচুক্ষেতে অপেক্ষার পর এখানে কেন এলেন জানতে চাইলে সানজিদা বলেন, “আমরা শুনেছি ডিবি অফিসের ভেতরে গোপন বন্দিশালা আছে, সেখানে অনেককে আটকে রাখা হয়েছে। এমন খবরে আমরা এখানে এসেছি।
“আমরা দেশে এ রকম যতোগুলো গোপন বন্দিশালার খবর জানব, সবগুলোতে গিয়ে গিয়ে দেখতে চাই। আমরা এখন উত্তরায় র্যাব-১ এ যাব। সেখানে লোকজনকে আটকে রাখা হয় এমন খবরও শুনেছি।”
২০১৩ সালের ২৮ নভেম্বর পুরান ঢাকা থেকে নিখোঁজ খালেদ হাসান সুমনের স্ত্রী নিপাও এসেছিলেন ডিবি কার্যালয়ের সামনে। স্বামীর ছবি হাতে তিনি বসে ছিলেন।
তিনি বলছেন, “শেখ হাসিনার পতনের পর সোমবার রাতে আমরা কচুক্ষেতে ‘আয়নাঘর’র সামনে গিয়েছিলাম, আমাদের স্বজনদের ফিরে পাওয়ার আশায়। তারা পরদিন আসতে বলেন। মঙ্গলবার গেলে জানানো হয় বুধবার তারা বিষয়টি জানাবেন।
“তবে মঙ্গলবার সেখান থেকে দুজনকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বলে আমরা শুনেছি। কিন্তু এখনও আমাদের স্বজনদের না পেয়ে আমরা এখানে এসেছি।”
স্বজনেরা জানাচ্ছেন, বুধবার তারা কচুক্ষেতে গিয়ে নিখোঁজ স্বজনদের ফেরত দেওয়ার দাবিতে স্লোগান দিয়েছেন। তারা সরকারি সংস্থাটির কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছেন। কিন্তু কেউ তাদের সাথে কথা বলেননি।
তবে গুম হওয়া ব্যক্তিদের ফেরত চেয়ে অনেক স্বজন তাদের বরাবর আবেদনপত্র দিয়েছেন। সেই আবেদনপত্রে তারা লিখেছেন, তারা বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পেরেছেন এখানে তাদের স্বজনদের আটকে রাখা হয়েছে। তাদের স্বজনদের যেন তাদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয় সেই কথা তারা আবেদনপত্রে লিখেছেন।
সানজিদা বলছেন, “গত ১৫ বছরে অন্তত ৬০০ ব্যক্তি নিখোঁজ হয়েছেন। তারা কোথায় আছেন, আমরা সেই জবাব চাই। আমরা আমাদের স্বজনদের ফেরত চাই।”
ঢাকার তেজগাঁও কলেজের নিখোঁজ সাবেক অধ্যক্ষ ও আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল হান্নান ২০১৫ সালের ৭ ডিসেম্বর প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে নিখোঁজ হন।
সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের ঘনিষ্ট তেজগাঁও কলেজের সাবেক একজন অধ্যক্ষকে এ জন্য সন্দেহ করেন তার ভাই আহসানউল্লাহ।
বুধবার আহসানউল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা যাকে সন্দেহ করি ওই ব্যক্তি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘনিষ্ট ছিলেন। এ জন্য আমরা মনে করছি, তাকে ‘আয়নাঘরে’ রাখা হতে পারে। বুধবার সকাল থেকেই আমাদের পরিবারের লোকজন সেখানে অপেক্ষা করছিল। কিন্তু কোনো খোঁজ মেলেনি।”
আরও পড়ুন