হান্নান বেঁচে আছেন, না কি নেই, তা জানতে না পেরে হতাশ তার পরিবার। তাদের অভিযোগ, তার খোঁজ বের করতে পুলিশ কোনো তদন্তই করেনি।
Published : 30 Jan 2023, 12:26 AM
আট বছর আগে এক সকালে ঢাকার তেজগাঁওয়ের বাসা থেকে বেরিয়ে যে নিখোঁজ হলেন আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল হান্নান, আর তার কোনো খবর মেলেনি।
বেঁচে আছেন, না কি নেই, তা জানতে না পেরে হতাশ হান্নানের পরিবার। তাদের অভিযোগ, জিডি করা হলেও তার খোঁজ বের করতে পুলিশ কোনো তদন্ত্ই করেনি।
ছাত্রলীগ হয়ে স্বেচ্ছাসেবক লীগে নেতৃত্ব দেওয়ার পর ২০১৫ সালে নিখোঁজ হওয়ার সময় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপ-কমিটির সহ-সম্পাদক ছিলেন হান্নান। তেজগাঁও কলেজে শিক্ষকতা করতেন তিনি, উপাধ্যক্ষও হয়েছিলেন।
কলেজের হোস্টেল সুপারের বাসাটিতে থাকতেন হান্নান। সেই বাসা থেকেই ২০১৫ সালের ৭ ডিসেম্বর প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছিলেন তিনি। তারপর থেকেই নিখোঁজ।
হান্নানের স্ত্রী আফরোজা সুলতানা তেজগাঁও কলেজের শিক্ষক হওয়ায় এখনও ওই বাসায়ই থাকছেন। তাদের তিন মেয়ের বড়জনের বিয়ে হয়েছে। মেজ মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আর ছোট মেয়ে কলেজে পড়েন।
আফরোজা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “একটা লোক মরে গেলে এক কথা, লাশ পাইতাম, মৃত্যুদিন পালন করতাম। এখন আমরা সেটার কিছুই পারি না। একা হাতে বড় মেয়ের বিয়ে দিলাম।”
পুলিশ এবং স্বামীর রাজনৈতিক সহকর্মীদের ভূমিকা নিয়েও ক্ষোভ রয়েছে আফরোজার।
“সারাজীবন এই দলটারেই ভালোবাসল। অথচ উনি মিসিং হওয়ার পর কাউরেই পাশে পাইলাম না। আমাদের পুলিশ কত জটিল মামলার সমাধান করতেছে বইলা শুনি। অথচ উনার কী হইল, সেই খবর আমারে কেউ দিতে পারল না।”
হান্নান নিখোঁজ হওয়ার রহস্য উদঘাটনে পুলিশ কী করেছে- বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জিজ্ঞাসায়ও তার নিখোঁজ হওয়ার কারণ কিংবা তার খোঁজ বের করার ক্ষেত্রে অগ্রগতির কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার ফারুক হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি শেরেবাংলা নগর থানায় কথা বলার পরামর্শ দেন।
শেরেবাংলা নগর থানার ওসি উৎপল বড়ুয়া বলেন, তারা বিষয়টি নিয়ে আদালতে নিয়মিত প্রতিবেদন দিয়েছেন। তবে রহস্য উদঘাটনের কোনো অগ্রগতি নেই।
রাবি থেকে তেজগাঁও
হান্নানের পড়াশোনা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৪ পর্যন্ত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন তিনি। এরপর ঢাকায় এসে আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ গড়ে তুলতে সক্রিয় হন। তিনি ছিলেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম আহ্বায়ক। পরে সহসভাপতিও ছিলেন। ২০১৩ সালে তিনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপ-কমিটির সহ-সম্পাদকের পদ পান।
হান্নানের স্ত্রী আফরোজার বাবাও সিরাজগঞ্জের কামারখন্দ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন।
তাদের বাসার অ্যালবামের পাতা ভরা কেবল রাজনৈতিক কর্মসূচির ছবি। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার পাশে কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন, এমন একাধিক ছবি রয়েছে অ্যালবামে। আওয়ামী লীগের প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল, বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, স্বেচ্ছাসেবক লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমসহ অনেকের সঙ্গেই হান্নানকে দেখা যায় ছবির সেই অ্যালবামে।
আফরোজা বলেন, “সারাজীবন রাজনীতিটাই করে গেছে। তিনি ছিলেন খুবই সীমিত চাহিদার মানুষ। যার কারণে চাকরি ছাড়া অন্যদিকে আয়-উপার্জনের পথ খোঁজার বিষয়ে তেমন কোনো আগ্রহ ছিল না তার।”
শেষ দিকে চাকরিতেও হান্নান আগ্রহ হারিয়েছিলেন বলে জানান আফরোজা।
“কলেজের উপাধ্যক্ষ পদটা চলে যাওয়ার পর খুবই মুষড়ে পড়েছিলেন। বলতেন, ‘এতদিন আওয়ামী লীগ করলাম, কোনোদিন বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ছাড়ি নাই। এখন পার্টি পাওয়ারে আর তারা আমার চাকরি নিয়া টানাটানি করে’।”
হান্নান ১৯৯৬ সালে বাংলা বিভাগে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে তেজগাঁও কলেজে যোগ দেন। এই কলেজের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।
২০১১ সালে তেজগাঁও কলেজের উপাধ্যক্ষ পদ সংখ্যা বাড়িয়ে তিনজন করা হলে হান্নান উপাধ্যক্ষ হন। কিন্তু উপাধ্যক্ষ পদ সংখ্যা বৃদ্ধি ও তার নিয়োগ নিয়ে আদালতে মামলা হয়। ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে তাকে সেই পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। সেই বছরের ৭ ডিসেম্বর নিখোঁজ হন তিনি।
বেরিয়ে যাওয়ার দিন
হান্নান প্রতিদিনই সকালে প্রাতঃভ্রমণে বের হতেন। নিখোঁজ হওয়ার দিনও সেভাবেই বেরিয়েছিলেন বলে জানান স্ত্রী আফরোজা।
তিনি বলেন, ট্রাইজার ও কেডস পরে বের হতেন তার স্বামী। তবে সেদিন বেরিয়েছিলেন স্যান্ডেল পরে।
আফরোজা বলেন, “এমনিতে উনি ভোরবেলায় উঠে কেডস পড়ে হাঁটতে যান, সেদিন দেখলাম পায়ে স্যান্ডেল।”
সকাল ৮টার দিকে তাকে স্যান্ডেল পরা অবস্থায় হোস্টেলের উঠানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেন আফরোজা। সেটাই স্বামীকে শেষ দেখা।
“এর একটু পরে তাকে বের হতে দেখেছিলেন এক ছাত্র ও মসজিদের মুয়াজ্জিন। তারা জিজ্ঞাসা করেছিল- কোথায় যাচ্ছেন? তিনি বলেছিলেন, ‘টিঅ্যান্ডটি মাঠের ওখানে একটা লোক আসছে, একটু দেখা করে আসি।”
খোঁজ না পাওয়ার পর কলেজের দুজন শিক্ষক এসে আফরোজাকে বলেন, তাদের সঙ্গে চন্দ্রিমা উদ্যানে দেখা হয়েছিল হান্নানের। তারা তখন প্রাতঃভ্রমণ শেষ করে ফিরছিলেন। তারা ভেবেছিলেন হয়ত দেরি করে ঘুম থেকে উঠে হাঁটতে বেরিয়েছেন হান্নান।
হান্নান সেদিন নিজের মোবাইল ফোনটি সঙ্গে নিয়ে যাননি। তার ফোনে সর্বশেষ ডায়াল তালিকায় ছিল সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক উত্তম বড়ুয়ার নম্বর। ডা. উত্তম বড়ুয়ার সঙ্গেও যোগাযোগ করেন আফরোজা। তিনি বলেন, তাকে ফোন করে হান্নান দেখা করতে আসবেন বলে জানিয়েছিলেন, তবে আসেননি।
আফরোজা জানান, নিখোঁজ হওয়ার কয়েক দিন আগে হান্নানের চিকিৎসার জন্য প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে ২ লাখ টাকা মঞ্জুর করা হয়েছিল। সেই চেক পাওয়ার পর থাইল্যান্ডে গিয়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জোগাড়যন্ত্র করছিলেন হান্নান।
চেকটি কৃষি ব্যাংকে জমা দিয়েছিলেন আফরোজা। তবে হান্নান নিখোঁজ হওয়ার পর সেই টাকা আর তুলতে পারেননি।
‘তদন্তই হয়নি’, হতাশ পরিবার
হান্নান নিখোঁজ হওয়ার পরদিন শেরেবাংলা নগর থানায় গিয়ে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন আফরোজা।
আফসোস করে তিনি বলেন, “পুলিশ কোনো তদন্তই করল না।”
পরের বছর গুলশান হামলার পর ডিবি পুলিশ জিজ্ঞাসাদ করতে এসেছিল জানিয়ে তিনি বলেন, “তার নানা তথ্য জানতে চায়, তিনি জঙ্গি কি না, এসব প্রশ্ন করে। তারা বলে, জঙ্গি সন্দেহ থেকে যারা নিখোঁজ, সব ব্যক্তিদের তথ্য সংগ্রহ করছেন। এরপর তার (হান্নান) রাজনৈতিক ক্যারিয়ার দেখে তারাই মন্তব্য করেন, ‘এই রকম লোক কী আর জঙ্গি হইব, তবু আমাদের রুটিন কাজ, তথ্য নিয়াই যাইতে হইব।”
তারা তখন হান্নানের একটি ছবিও নিয়ে গিয়েছিলেন জানিয়ে আফরোজা বলেন, “বলেছিল ছবিটি ফেরত দিয়ে যাবে। তবে এখনও দিয়ে যায়নি। ওই ছবিটার একটা কপিই আছিল। কিন্তু আর দিল না।”
আফরোজার আক্ষেপ, জীবনভর আওয়ামী লীগ করলেও হান্নানের নিখোঁজ হওয়ার পর দলের কেউও তাদের পাশে এসে দাঁড়াননি।
হান্নানের ভাই আইনজীবী আহসানউল্লাহও বলেন, পুলিশ হান্নানের খোঁজ বের করার কোনো চেষ্টাই করেনি। উল্টো তথ্য নেওয়ার নামে জামালপুরের সরিষাবাড়ির গ্রামের বাড়িতে গিয়ে ‘হয়রানি’ করে গেছে।
তিনি বলেন, “২০১৬ সালে হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পর সরিষাবাড়ী থানার এক এসআই আইসা বলছে, ‘ঘটনা তো ভিন্নখাতে যাইতেছে, হান্নান সাব না কি জঙ্গি হয়ে গ্যাছে’। পুলিশ বলছে তারা এরকম রিপোর্ট ওপর মহলে দিচ্ছে। তখন আমি কইছি যা পারেন দ্যান গা। হান্নান ভাইরে জননেত্রী শেখ হাসিনা ব্যক্তিগতভাবে চেনেন। পরে অবশ্য পুলিশ এরকম কিছু লেখেনি।”
আহসানউল্লাহ বলেন, “ওই কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতি হচ্ছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। ওই কলেজের একজন সাবেক ভাইস প্রিন্সিপাল নিখোঁজ হল, অথচ কোনো তদন্তই হইল না। পুলিশ একেবারেই কিচ্ছু করেনি, কিচ্ছুই না।
“ভাই নিখোঁজ হওয়ার পর ভাবি বারবার মন্ত্রী মহোদয়ের কাছে গেছেন, স্বামীকে ফিরে পেতে। কিন্তু তিনি কেবলই আশ্বাস দিয়ে গেছেন। কিন্তু তাকে খুঁজে বের করতে দৃশ্যমান কোনো তৎপরতা আমরা দেখি নাই। এটাই আমাদের বড় কষ্ট।”
“উনি নিখোঁজ হওয়ার পরদিনই আমরা জিডি করলাম। অথচ পুলিশের একটা দিনের কার্যক্রম দেখে মনে হয়নি যে তাকে খুঁজে বের করতে আসলেই তৎপর। এখন তো সিসি ক্যামেরার ফুটেজ, মোবাইল ট্র্যাকিংসহ পুলিশের তদন্তের কত উপায় রয়েছে। পুলিশের কাছে গেলেই খালি বলত- ‘আমরা দেখতাছি’। কিন্তু তারা কী দেখল, কী পাইল, তা এতদিনেও জানলাম না,” বলেন তিনি।
হান্নান বিষণ্নতায় ভুগছিলেন এমন তথ্যও শোনা গিয়েছিল। এ বিষয়ে জানতে চাইলে আহসানউল্লাহ বলেন, “উনি ডিপ্রেশনে ছিলেন শুধু কলেজের বিষয়টা নিয়ে। এছাড়া ডিপ্রেশন আর কিছুই না। উনি (হান্নান) ভাইস প্রিন্সিপাল হয়েছিলেন। পরে তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়।”
হান্নানকে কেউ অপহরণের পর গুম করেছে বলে ধারণা তার ভাইয়ের।
“আমরা বিশ্বাস করি, অপহরণকারীরা রেকি করছে। তারপর উনি হাঁটতে বের হওয়ার পর ধরে নিয়ে গেছে।”
অন্য কোনো দুর্ঘটনার সম্ভাবনা নাকচ করে আহসানউল্লাহ বলেন, “উনি যদি কোনো দুর্ঘটনায় মারা যান, তাহলে তো তার বডিটা অন্তত পাওয়া যাবে। আমরা হাসপাতাল, ডোমঘর সব জায়গায় খুঁজছি, পাইনি।”
হান্নানের পরিবারের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আব্দুল হান্নানকে একজন ভালো শিক্ষক, সংগঠক হিসেবেই আমরা চিনতাম। আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু ও নেত্রীর প্রতি কমিটেড এমন একজন লোককে পাওয়া যাচ্ছে না, এটা অত্যন্ত হৃদয় বিদারক ঘটনা। এটা শুধু পরিবারের না, আমাদের সবার জন্য বেদনাদায়ক।”
তিনি বলেন, “প্রথমে যখন শুনেছি তাকে পাওয়া যাচ্ছে না, তখন বিষয়টা নিয়ে পরিবারের লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছি। এর কিছুদিন পরে জিডিও হয়েছে।
“এখন আব্দুল হান্নানের হারিয়ে যাওয়ার বিষয়টার আইনি সমাধানের প্রয়োজন। সে মারা গেছে, নাকি কোথাও আছে? এটা বের করার দরকার। এর জন্য আমরা সাংগঠনিকভাবে সহযোগিতা যতটুকু প্রয়োজন করব।”
প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের নিজস্ব প্রতিবেদক কাজী মোবারক হোসেন