চলতি বছর দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ২৪ হাজার ৯০০ জন; যার মধ্যে ১৫ বছর বয়সি শিশুর সংখ্যা ৪ হাজার ৭৪৮।
Published : 25 Sep 2024, 01:04 AM
রাজধানীর পীরেরবাগের পাঁচ বছরের শিশু মুনতাসিম তাহমিদ দেড় মাসের ব্যবধানে দ্বিতীয়বার ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে, তাকে নিয়ে উদ্বেগে রয়েছে তার পরিবার।
তাহমিদের পাশে রয়েছেন তার মা তাহমিনা খাতুন। তিনি বলছেন, অগাস্টের প্রথম সপ্তাহে জ্বর হয়েছিল ছেলের। সে সময় পরীক্ষায় ডেঙ্গু পজিটিভ আসে। চিকিৎসায় সুস্থও হয়ে যায় সে। তবে গত শুক্রবার আবার জ্বর আসে।
“শনিবার সকালে হাসপাতালে এলে ডাক্তার পরীক্ষা করাতে দেয়। ডেঙ্গু ধরা পড়লে রোববার তাকে এই হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছি। তার জ্বর, ঠান্ডা, কাশি হচ্ছে প্রচণ্ড; এটাই সমস্যা।”
চিকিৎসকদের মতে, বর্ষার শেষ দিক থেকে শরৎজুড়ে সাধারণত দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয়; এবারও পরিস্থিতি তেমনই। অগাস্ট থেকে ঢাকাসহ সারাদেশে এইডিস মশাবাহিত রোগটিতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে, যার মধ্যে একটি বড় অংশই শিশু।
সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছর দেশে যত ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে, তাদের প্রতি পাঁচজনের একজনের বয়সই ১৫ বছরের কম। কারও কারও কয়েক সপ্তাহর ব্যবধানে দ্বিতীয়বারও ডেঙ্গু হচ্ছে বলে হাসপাতালে আসা রোগীদের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে।
শিশুদের ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ায় সতর্কতা হিসেবে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে চালু করা হয়েছে বিশেষায়িত ডেঙ্গু কর্নার। রোববার পর্যন্ত সেখানে ১৬টি শয্যা পাতা হয়; সোমবার তা বাড়িয়ে করা হয় ২৪টি।
সোমবার সকাল পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় ১১টি শিশু ভর্তি হয় বাংলাদেশ শিশু হাসপাতালে। সোমবার পর্যন্ত ভর্তি ২৫টি শিশুর মধ্যে দুজন নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র বা আইসিইউতে রয়েছে।
সোমবার হাসপাতালটির বিশেষায়িত ডেঙ্গু ওয়ার্ডে গিয়ে প্রতিটি শয্যাতেই ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুকে দেখা যায়।
তাদের মধ্যে একজন মরিয়ম আলম, যার বয়স মাত্র এক বছর। তার অবস্থা বেশ আশঙ্কাজনক হওয়ায় চিকিৎসকের পরামর্শে শরীয়তপুর থেকে তাকে এখানে এনে ভর্তি করা হয়েছে।
মরিয়মের মা আসমা আক্তার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মেয়েটির প্রচণ্ড জ্বর হয়, তাপমাত্রা বেড়ে ১০৩ ডিগ্রি পর্যন্ত ওঠে যায়। শরীয়তপুরে ডাক্তার দেখাইছি। ডেঙ্গু ধরা পড়ার পর তারা বলল, ঢাকায় নিয়ে আসার জন্য। এখানে ভালো চিকিৎসা হবে।”
ঢাকার ফার্মগেটের ইন্দিরা রোডের ছয় বছরের আলিজা ইসলাম পাশের আরেকটি শয্যায় ভর্তি। শয্যার পাশে কথা হল তার মা খাদিজা সুলতানার সঙ্গে।
তিনি বলেন, গত সোমবার রাতে মেয়ের প্রথম জ্বর হয়। পরদিন সকালে প্যারাসিটামল সিরাপ খাওয়ালে জ্বর কমে, বিকালে আবার জ্বর উঠে। জ্বর না কমায় আলিজাকে নিয়ে চিকিৎসকের কাছে আসেন তারা।
“ডাক্তার টেস্ট করাতে বললেন, করালম; ডেঙ্গু ধরা পড়ল। প্লাটিলেট নেমে যায় ৫০ হাজারে। অবস্থা কিছুটা খারাপ হলে গত শুক্রবার রাতে এসে এই হাসপাতালে ভর্তি করাইছি।”
এখন অবস্থা কিছুটা ভালো হওয়ায় কিছুটা স্বস্তিতে আছেন তারা।
বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের জরুরি বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক মাহমুদুল হক চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এক সপ্তাহ ধরে দেখছি ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে। সংখ্যাটি গত বছরের মত নয় কিন্তু প্রস্তুতি হিসেবে আমরা ডেঙ্গু কর্নার করেছি।”
প্রচণ্ড জ্বর, পেট ব্যথা, বমিসহ বিপদ চিহ্ন থাকলেই হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় জানিয়ে এই চিকিৎসক বলেন, “বাকিদের ব্যবস্থাপত্রে ওষুধ এবং বাসায় নিয়ে কী করতে হবে, তা লিখে বাড়ি পাঠিয়ে দিই। শিশুর বাবা-মাকে বলা থাকে আমাদের ফিভার ক্লিনিকে এসে ফলোআপ করিয়ে যাওয়ার জন্য।”
এ হাসপাতালে চলতি বছরের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, জানুয়ারি থেকে ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এখানে ডেঙ্গু নিয়ে ভর্তি হয়েছে ২১০টি শিশু, তাদের মধ্যে ৮৩ জনই সেপ্টেম্বরের প্রথম তিন সপ্তাহে ভর্তি হয়েছে।
জানুয়ারিতে ১০, ফেব্রুয়ারিতে ৬, মার্চে ১০, এপ্রিলে ৭, মেতে ১৩, জুনে ৫, জুলাইয়ে ৩১ এবং অগাস্টে ৪৫ জন শিশু ডেঙ্গু নিয়ে শিশু হাসপাতালে ভর্তি হয়।
ভর্তি শিশুর মধ্যে ৫ জনের মৃত্যু হয় চলতি বছর, তাদের তিনজনই আবার মারা যান এই সেপ্টেম্বরে।
শিশু হাসপাতালের অদূরেই শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও গত কয়েকদিনে ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশু ভর্তির সংখ্যা বেড়েছে। মঙ্গলবার পর্যন্ত এখানে ৭৭ জন ডেঙ্গু রোগী ছিল, যার মধ্যে শিশু ওয়ার্ডে ছিল ১৮ জন।
সাভারের জামগড়া থেকে আবু সাঈদ শাকের নামে আড়াই বছরের শিশু সন্তানকে নিয়ে এসেছেন তার পিতামাতা।
শাকেরের বাবা শফিকুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গত রোববার ছেলের জ্বর আসে। তার শরীরের তাপমাত্রা ১০৪ ডিগ্রি পর্যন্ত উঠেছিল। সাভার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসক দেখে পরীক্ষা দিলে ডেঙ্গু ধরা পড়ে।
“ডাক্তার ওষুধ দিল কিন্তু জ্বর ১০২ থেকে ১০৪ মধ্যে ওঠানামা করছিল। ডাক্তাররা ঢাকায় নিয়ে আসতে বললে কাল (সোমবার) দুপুরের পর এখানে এনে ভর্তি করাই। রাতে একবার তার নাক দিয়ে রক্ত বের হয়েছিল। ডাক্তাররা চিকিৎসা দিয়েছেন। এখন শরীর কিছুটা ভালো।”
শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের শিশু বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সাঈদা আফরোজা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এ বছর ডেঙ্গু নিয়ে আসা শিশুদের বেশির ভাগেরই সাধারণ লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।
“প্রচণ্ড জ্বর, গায়ে ব্যথা, বমি, সর্দি-কাশি, মাথা ব্যথা দেখা যাচ্ছে। কোনো বাচ্চার গায়ে লালচে র্যাশ উঠছে। কিছু শিশু আসছে, যাদের টনসিল ফুলে যাচ্ছে, কারও পাতলা পায়খানাও হচ্ছে।”
ডা. সাঈদা আফরোজা বলেন, ডেঙ্গু হয়ে গেলে শিশুর চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে।
“ডেঙ্গু হওয়ার পর প্রথম ও প্রধান কাজ হবে তাকে প্রচুর তরল খাওয়ানো। ফলের রস, স্যুপ, নরম খিচুড়ি বা ভাত খাবে যেন সহজে হজম হয়। শিশুকে মশারির ভেতর রাখতে হবে, যেন মশা তাকে কামড়ে আবার অন্য কাউকে কামড়াতে না পারে।”
বাংলাদেশে ডেন-১, ডেন-২, ডেন-৩ ও ডেন-৪ এই চার ধরনের ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় মানুষ।
গত বছরের জুন, জুলাই ও অগাস্টে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে ভর্তি ডেঙ্গু আক্রান্ত ১ হাজার ৩৯ জন শিশুর মধ্যে থেকে ৭২২ জন শিশুর ডেঙ্গু ভাইরাস সংক্রমণের রোগতাত্ত্বিক ও সেরোটাইপ নির্ধারণের ওপর একটি গবেষণা কার্যক্রম চালানো হয়।
শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের রোগতত্ত্ব ও গবেষণা বিভাগ ও আইসিডিডিআর’বি যৌথভাবে এ গবেষণা পরিচালনা করেছিল।
গবেষণার ফলাফল বিশ্লেষণ করে গত বছর জানানো হয়েছিল, আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে ৮৭ শতাংশ ‘ডেন-২’ ধরনে এবং বাকি ১৩ শতাংশ শিশু ‘ডেন-৩’ ধরনে আক্রান্ত।
চলতি বছর শিশুদের কত শতাংশ কোন ধরনের ডেঙ্গুতে আক্রান্ত জানতে চাইলে আইইডিসিআর এর পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরিন মঙ্গলবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা এবার অ্যাজ এ হোল সেরোটাইপ করেছি। সেখানে দেখা গেছে এ বছর ডেন-২ তে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ।
“ডেঙ্গুর সেরোটাইপ চারটি। কেউ যদি প্রথমবার ডেন-১ এ আক্রান্ত হয়, এরপর ডেন-২ বা ডেন-৩ তে আক্রান্ত হয়; তাহলে তার ইনফেকশনের মাত্রাটা বেশি থাকে। আবার প্রথমবার ডেন-১ এ আক্রান্ত হয়ে দ্বিতীয়বার একই ধরনে আক্রান্ত হলে সিভিয়ারিটি কম থাকে।”
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সোমবার সকাল ৮টার আগ পর্যন্ত দেশে এক দিনে ৮৬৬ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে; তাদের মধ্যে ১৫ বছর পর্যন্ত বয়সি শিশুর সংখ্যা ১২৬ জন। শিশু ভর্তির এই সংখ্যা মোট ভর্তি রোগীর ১৫ শতাংশ।
চলতি বছর দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ২৪ হাজার ৯০০ জন; যার মধ্যে ১৫ বছর বয়সি শিশুর সংখ্যা ৪ হাজার ৭৪৮। শতকরা হিসাবে তা মোট ভর্তি রোগীর সংখ্যার ১৯ দশমিক ০৬ শতাংশ।
আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে ছেলে শিশুর সংখ্যা বেশি- ২ হাজার ৭৯৬ জন। বাকি ১ হাজার ৯৫২ জন মেয়ে শিশু।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া ১৩৩ জনের মধ্যে ২১ জন শিশু।
ডেঙ্গুর বিস্তার রোধে মাঠে রয়েছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। দেশের সব সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা মিলে মাঠে কাজ করছেন ৩২১৪ জন কর্মী।
মঙ্গলবার এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য তুলে ধরে মন্ত্রণালয় বলছে, চলমান ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবেলায় স্থানীয় সরকার বিভাগের এক জরুরি সভায় ১০টি টিম গঠন করা হয়েছে, যারা ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশনসহ দেশের ১২টি সিটি করপোরেশন এবং ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা সাভার, দোহার, তারাব, রূপগঞ্জ ও অন্যান্য পৌরসভায় মশক নিধন অভিযান কর্মসূচি বাস্তবায়ন, সমন্বয় ও নিবিড়ভাবে তদারকি করছে।
ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব মোকাবেলায় জনসচেতনতা বাড়াতে বিভিন্ন এলাকায় মাইকিং, লিফলেট ও পোস্টার বিতরণ করা হয়েছে বলে বিজ্ঞপ্তিতে তুলে ধরা হয়েছে।
বাংলাদেশে ডেঙ্গুর বিক্ষিপ্ত প্রার্দুভাব দেখা যায় ১৯৬৪ সাল থেকে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যুর তথ্য রাখে ২০০০ সাল থেকে। এর মধ্যে ২০২৩ সালে এ রোগ নিয়ে সবচেয়ে বেশি ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়।
রোগটিতে সবচেয়ে বেশি ১ হাজার ৭০৫ জনের মৃত্যুও হয় ২০২৩ সালে। ওই বছর ডিসেম্বরে ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশে ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া প্রতি ছয়জনেরই একজন শিশু, যাদের বয়স ১৫ বছরের নিচে।