“পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের এমন কাউকে রক্ষা করা উচিত না, যিনি বেআইনি কাজে জড়িয়ে গেছেন।”
Published : 25 Jun 2024, 01:48 AM
পুলিশের সাবেক কয়েকজন কর্মকর্তার বিপুল সম্পত্তি নিয়ে সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশের পর বাহিনীর কর্মকর্তাদের সংগঠন পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন যে বিবৃতি দিয়েছে, তাকে সমর্থন করছেন না সাবেক আইজিপি নুরুল হুদা।
বাহিনী ও তার সদস্যদের স্বার্থ-সুনাম রক্ষা করতে গিয়ে অপরাধে জড়িতদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে পুলিশ কর্মকর্তাদের সমিতিকে পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
১৯৭০ সালে পুলিশে যোগ দেওয়া নুরুল হুদা ২০০০ সালের ৭ জুন থেকে ২০০১ সালের ৬ নভেম্বর পর্যন্ত পুলিশের মহাপরিদর্শক বা আইজিপির দায়িত্ব পালন করেন। পরে তিনি যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সচিবের দায়িত্ব পালন করে ২০০৩ সালে অবসরে যান।
১৯৯৪ সালে জাতিসংঘের মাদক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির অধীনে জাতীয় পরামর্শকও ছিলেন নুরুল হুদা। ১৯৯৫ থেকে ১৯৯৭ সালে পুলিশের কৌশলগত পরিকল্পনা প্রণয়নে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এখন অবসর জীবনে লেখালেখিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের নিয়মিত আয়োজন ইনসাইড আউটে অংশ নিয়ে সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করেছেন নুরুল হুদা। তিন দশকের বেশি সময় ধরে পুলিশে কাজ করার অভিজ্ঞতার আলোকে এ বাহিনী নিয়ে তার মূল্যায়নও উঠে এসেছে এ আলোচনায়।
সোমবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ফেইসবুক পেইজ ও ইউটিউব চ্যানেলে সম্প্রচার করা হয় ইনসাইড আউটের এই সর্বশেষ পর্বটি।
সাবেক আইজিপির কাছে প্রশ্ন ছিল, “পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন বিবৃতি দিয়ে পুলিশ কর্মকর্তাদের সম্পদের বিষয়ে সংবাদ প্রকাশে সতর্কতার কথা বলেছে। সাংবাদিকরা বলছেন, এই অবস্থান দুর্নীতিতে উৎসাহিত করবে। ব্যক্তির দায় এভাবে বাহিনীর কাঁধে নিয়ে নেওয়া হচ্ছে না কি?”
জবাবে তিনি বলেন, “পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন নিশ্চয় বাহিনী ও এর সদস্যদের স্বার্থ ও সুনামের বিষয়টি দেখবে। কিন্তু এ কাজ করতে গিয়ে তাদের এমন কাউকে রক্ষা করা উচিত না, যিনি বেআইনি কাজে জড়িয়ে গেছেন।”
খবর প্রকাশের ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের ওই বিবৃতির প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, “এই দুই প্রতিষ্ঠানের সুনির্দিষ্ট দায়দায়িত্ব রয়েছে এবং এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য একে অন্যকে বলা উচিত নয়, কাকে কোনটা করতে হবে। যার যে দায়িত্ব তার সেই কাজ করা উচিত।”
সাবেক এই আইজিপি বলেন, “সেবাদাতা হিসাবে কাজের ক্ষেত্রে গণমাধ্যমকে পুলিশের খুব বেশি দরকার। সুতরাং, একে অপরকে বিরোধী ভাবাপন্ন না করাই হবে জনস্বার্থের কাজ। এক্ষেত্রে একে অপরের দায়িত্বের বিষয়ে বোঝাপড়া এবং মূল্যায়নের পরিবেশ থাকা দরকার।”
দেশের বিভিন্ন এলাকায় সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের বিঘার পর বিঘা সম্পত্তি, রিসোর্ট, ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় বাড়ি ও ফ্ল্যাট, বেশি কিছু কোম্পানিতে তার ও পরিবারের সদস্যদের মালিকানার বিষয়টি নিয়ে মাস দুয়েক ধরে তুমুল আলোচনা চলছে।
আদালতের আদেশে বেনজীরের খোঁজ পাওয়া সব সম্পদ জব্দ এবং ব্যাংক হিসাব ও কোম্পানির শেয়ার অবরুদ্ধ করা হয়েছে।
তবে ওই আদেশ আসার আগেই ব্যাংক থেকে ‘টাকা তুলে’ সাবেক আইজিপি ও তার পরিবারের সদস্যরা দেশ ছেড়েছেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের তলবে একবার সময় চেয়েও তাদের কেউ হাজির হননি।
ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক প্রধান আছাদুজ্জামান মিয়া এবং তার পরিবারের সদস্যদের সম্পদ নিয়েও গত কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রতিবেদন আসছে সংবাদ মাধ্যমে। আছাদুজ্জামানও দেশের বাইরে আছেন, যদিও দাবি করেছেন, তিনি ফিরবেন এবং সব প্রশ্নের জবাব দেবেন।
পুলিশের পদে থাকা একাধিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার বিষয়েও প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে; তাদের সম্পদের পরিমাণ আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কি না, সে প্রশ্ন উঠেছে।
এমন প্রেক্ষাপটে পুলিশ সদস্যদের সংগঠন পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন শুক্রবার এক বিবৃতিতে এসব প্রতিবেদনকে ‘তথ্যসূত্রবিহীন বাস্তবতা বিবর্জিত’ বলে দাবি করেছে।
পুলিশ বাহিনী নিয়ে ভবিষ্যতে সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে ‘অধিকতর সতর্কতা ও সাংবাদিকতার নীতিমালা’ যথাযথভাবে অনুসরণের অনুরোধ জানায় পুলিশের এ সংগঠন।
সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেল বলেন, সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ এবং সাবেক ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়ার বিপুল সম্পদ নিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশের পরিপ্রেক্ষিতেই তারা ওই প্রতিবাদলিপি দিয়েছেন।
পুলিশ কর্মকর্তাদের এই বিবৃতির প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন পাল্টা বিবৃতি দিচ্ছে।
ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে), ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, টেলিভিশন সাংবাদিকদের সংগঠন ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টার, ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ বা ক্র্যাবের এসব বিবৃতিতে পুলিশের বিবৃতির ভাষার সমালোচনা করা হয়েছে।
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি বলেছে, পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের এই অবস্থানে মধ্যে দিয়ে ‘ব্যক্তিগত দুর্নীতি উৎসাহিত হওয়ার’ আশঙ্কা রয়েছে।
বেনজীরের বিষয়ে তথ্য দিতে পুলিশের গোয়েন্দা শাখা কি ব্যর্থ?
নুরুল হুদার কাছে প্রশ্ন ছিল বেনজীরের এই বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি অর্জনের বিষয়ে সরকারকে সময়মত তথ্য জানাতে পুলিশের গোয়েন্দা সংস্থা ব্যর্থ হয়েছে কি না।
জবাবে তিনি বলেন, “কোনো ব্যক্তির অন্যায় বা অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ– এগুলো অভিযোগ। অভিযোগ আদালতে প্রমাণ হওয়ার আগে সুনির্দিষ্ট মতামত দেওয়া খুব কঠিন।
“তবে অভিযোগের আঙুল তোলা যায়। কেননা এখানে বহু অভিযোগ এসেছে এবং দুর্নীতি দমন কমিশনও কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। দেখা যাচ্ছে, অভিযোগের প্রাথমিক সারবত্তা রয়েছে।”
এটি প্রাথমিকভাবে দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়িত্ব ছিল বলেও মনে করেন নুরুল হুদা। তিনি বলেন, “তাদের কাজই হল সরকারি কর্মীদের অবৈধ সম্পদ অর্জন ও দুর্নীতির বিষয়টি দেখা।”
বেনজীর বাহিনীর প্রধান থাকায় কর্মকর্তাদের মধ্যে কিছু ‘দ্বিধা’ কাজ করে থাকতে পারে মন্তব্য করে নুরুল হুদা বলেন, “তারা জানলেও তারা এই ক্ষেত্রে ফৌজদারি ব্যবস্থা নিত কি-না, সে বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে।”
পুলিশের গোয়েন্দা শাখার ব্যর্থতার প্রশ্নে নুরুল হুদা বলেন, “সেটা বলতে পারেন।“
বেনজীর আগেই দেশ ছাড়লেন কীভাবে
বেনজীর আহমেদের দেশের বাইরে চলে যাওয়ার খবর এবং এ বিষয়ে সরকারি ভাষ্যের অস্পষ্টতা নিয়ে সাবেক আইজিপির কাছে প্রশ্ন ছিল– এই ধরনের একজন ব্যক্তির বিদেশ যাত্রার ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা কী থাকে? তিনি দেশের বাইরে যাচ্ছেন কি না, এই তথ্যটা কোথায় জানানোর কথা?
জবাবে তিনি বলেন, “যেহেতু অভিযোগগুলো দেখভাল করছে দুর্নীতি দমন কমিশন, এক্ষেত্রে অভিযোগের প্রাথমিক সারবত্তা থাকলে এটা তাদের দায়িত্ব।
“যদি তারা মনে করত তারা যে ব্যক্তির বিষয়ে কাজ করছে, সে দেশ থেকে পালিয়ে যেতে পারেন, তাহলে এটা আদালতের নজরে আনা উচিত ছিল তাদের। এবং আদালত এক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞার আদেশ দিতে পারত।”
কারো ভ্রমণের বিষয় দেখার দায়িত্ব তার জানা মতে কোনো সংস্থার নেই জানিয়ে সাবেক আইজিপি বলেন, “বাধা দেওয়ার কোনো কারণ না থেকে থাকলে ভ্রমণের অধিকার সাংবিধানিকভাবে যে কারও আছে।
“সুতরাং সুনির্দিষ্ট এই ঘটনার ক্ষেত্রে যেহেতু কেউ একজনের অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ এসেছে, কিছু সংস্থা তদন্ত করছে এবং প্রাথমিক প্রমাণ আছে এবং তাহলে তাদের উচিত ছিল বিষয়টি যথাযথ কর্তৃপক্ষকে জানানো।
“এক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপের আবেদন জানিয়ে বিষয়টি আদালতের নজরে আনা দরকার ছিল। এরপর আদালতের আদেশ অনুযায়ী ইমিগ্রেশন পুলিশসহ অন্যরা ব্যবস্থা নিতে পারত।”
আনারের ঘটনাতেও কি পুলিশ ব্যর্থ?
ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার ভারতে খুন হওয়ার পর তার বিরুদ্ধে স্বর্ণ চোরাচালানসহ নানা অভিযোগের তথ্য সামনে আসছে। এ নিয়েও প্রশ্ন রাখা হয়েছিল সাবেক আইজিপি নুরুল হুদার সামনে।
পুলিশ ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে অথবা তারা সরকারের যথাযথ পর্যায়ে বিষয়গুলো তুলতে পারেনি কি না- এই জিজ্ঞাসার বিপরীতে নুরুল হুদা বলেন, “এটারও (স্বর্ণ চোরাচালান) তদন্ত হওয়া দরকার। অভিযোগ আসছে, চোরাচালানের লাভের ভাগ নিয়ে খুন হয়ে থাকতে পারেন। তদন্ত না হওয়া পর্যন্ত কার সম্পৃক্ততা কতটুকু, তা নিয়ে কথা বলা আগাম মন্তব্য হয়ে যায়।
“তবে আপনি বলতে পারেন, অনেক তথ্য আসছে, সেগুলোর পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত হওয়া দরকার।”
ঘটনা ঘটে যাওয়ার আগে কেন সেসব বিষয়ে ধারণা পাওয়া যায় না- এই প্রশ্নে সাবেক আইজিপি বলেন, “কিছু কিছু ঘটনা ঠেকানো যায় না।… কোনো বড় ব্যক্তি চোরাচালানে জড়িত বা পৃষ্ঠপোষকতা করছেন কি না, সেটি গোয়েন্দা সংস্থার কাজ। তাদের এগুলো নিয়ে জানা থাকা উচিত। সেই সঙ্গে সেগুলো ঠেকাতেও কাজও করা উচিত।”
পুলিশে কি জনগণের বন্ধু হতে পেরেছে?
ইনসাইড আউটে প্রশ্ন ছিল, পুলিশ বাহিনীর পক্ষ থেকে বারবার বলা হয়, পুলিশ জনগণের বন্ধু। আসলে কি বন্ধু হতে পেরেছে? যদি না পারে, কোথায় বাধা?
জবাবে সাবেক আইজিপি বলেন, “পুলিশ এটা বলে থাকে। কিন্তু এটি কর্মের মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে। কোনো কোনো সময় তারা বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েছে, মানুষকে সহযোগিতা করেছে। আবার উল্টো ঘটনাও আছে। পুলিশের যা করার কথা ছিল, তারা তা করেনি। আবার এমন কাজও করেছে যা তাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে।
“বলা যায়, দুই ধরনের চিত্রই আছে। তবে নবীন কর্মকর্তাদের একটি বড় অংশের মধ্যে এই উপলব্ধি আছে যে, একটি সফল পুলিশ বাহিনী হতে হলে তাদেরকে জনগণের সমর্থন পেতে হবে।”
গুলশানে হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলায় প্রাণ হারানো এক পুলিশ কর্মকর্তার নিজের এলাকা মানিকগঞ্জে শিক্ষা বিস্তারের, একজন ডিআইজির বৃক্ষ রোপণ, বেদেসহ পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর পক্ষে কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার উদ্যোগের কথা তুলে ধরে নুরুল হুদা বলেন, “পুলিশ তার সুনাম বাড়াতে কাজ করছে না, এটা বলাটা ঠিক হবে না।”
পুলিশের কোন জায়গাটায় পরিবর্তন জরুরি বলে মনে করছেন- এই প্রশ্নে সাবেক আইজিপি বলেন, “পুলিশ সদস্যদের মনে রাখতে হবে তারা বেসামরিক বাহিনী। জনগণের সঙ্গে তাদের মিথস্ক্রিয়া জরুরি। এ জন্য বিভিন্ন ফোরাম অবশ্য আছেও।
“আমি একজন রোটারিয়ান, চাকরি জীবনেও এর সদস্য ছিলাম। এখন আনজুমান মফিদুল ইসলামের সঙ্গে জড়িত। এমন আরো সংগঠন আছে। পুলিশ কর্মকর্তারা এগুলোর সদস্য হয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলতে পারেন ।”
তবে ‘কিছু করে দেখানো জরুরি’ মন্তব্য করে নুরুল হুদা বলেন, “একটি জনবান্ধব পুলিশ বাহিনীর দাবি জনগণের পক্ষ থেকে উঠে আসা জরুরি। তাহলেই পরিস্থিতির উন্নতি হবে। তবে পুলিশ কর্মকর্তাদেরও দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে হবে, তাহলেই জনগণ আশ্বস্ত হবে।”
অন্য এক প্রশ্নে পুলিশ বাহিনীতে বহু ধাপে জবাবদিহিতার ব্যবস্থা থাকার কথা তুলে ধরে সাবেক আইজিপি বলেন, “প্রথম জবাবদিহিতা নিকটতম ঊর্ধ্বতনদের কাছে, সেটি ১৯৪৩ সালের পুলিশ রেগুলেশন অব বেঙ্গলে সবিস্তারে আছে। ফৌজদারি বিষয় হলে সেটা কোর্টে যাবে। এরপর রাজনৈতিক নির্বাহীদের কাছে জবাবদিহিতা। সুতরাং বহু ধাপে জবাবদিহিতা রয়েছে।
“এসব পদে যেসব ব্যক্তি রয়েছে তাদের উপর দায়িত্ব নির্ধারিতই হয়েছে। সুতরাং জবাবদিহিতার ব্যবস্থা নেই– এমনটা বলা যথাযথ হবে না।”
অপরাধের ক্ষেত্রে আদালতের নির্দেশনা দেওয়ার সুযোগ থাকার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমার পেশাগত জীবনে দেখেছি, যখন কোনো অনিয়ম আদালতের নজরে এসেছে, তারা নির্দেশনা দিয়েছে।
“বিভিন্ন অফিসে নিবন্ধন খাতা রয়েছে, বিশেষ করে পুলিশ সুপারের অফিসে, যেটাকে আদালতের মতামত রেজিস্ট্রারও বলা হয়। এই রেজিস্ট্রারে লেখা হয়ে থাকে এবং তার ধারাবাহিকতায় বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
“সুতরাং পুলিশ কর্মকর্তারা অন্যায় কাজে জড়িত হলে শুরুতে বিভাগীয় তদন্তের মুখোমুখি হয়। যদি বিষয় গুরুতর এবং দণ্ডনীয় হয়, তাহলে তার অন্য যে কোনো নাগরিকের মত আইনের মুখোমুখি হওয়ার কথা।”
পুলিশে শাস্তির তথ্য ‘প্রকাশ্য থাকা উচিত’
নানা অভিযোগে পুলিশে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ সদস্যের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়, চাকরিচ্যুতিও হয়। কিন্তু বিষয়গুলোর প্রচার হয় না। এতে করে বাহিনীর সদস্যরাও সতর্ক হন না। নাগরিকরাও জানতে পারে না।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সাবেক আইজিপি নুরুল হুদা বলেন, “এসব তথ্য গোপন থাকা উচিত না। পুলিশ জনগণের টাকায় চলে, কাজেই জনগণের এসব জানার অধিকার আছে। পুলিশের বার্ষিক যে প্রতিবেদন প্রকাশ হয় সেটি জনগণের জন্য। এগুলো প্রকাশ করায় কোনো ক্ষতি নেই।
“বরং এটি পুলিশের ভাবমূর্তি বাড়াবে, কারণ, জনগণের আত্মবিশ্বাস জন্মাবে যে পুলিশ বাহিনী তার সদস্যদের অবৈধ কার্যকলাপের বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়।”
নুরুল হুদা দাবি করেন, তিনি যখন দায়িত্বে ছিলেন, তখন গণমাধ্যমের চাহিদা অনুযায়ী এসব বিষয়ে তথ্য সরবরাহ করা হয়েছে।
পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে যখনই কোনো অভিযোগ আসে, ঊর্ধ্বতনদের পক্ষ থেকে বলা হয়, অভিযোগ পেলে খতিয়ে দেখা হবে। দিন শেষে দায় বাহিনীর ওপরও বর্তায় কি না, সেই প্রশ্নে সাবেক আইজিপি বলেন, “বেশিরভাগ সদস্যের বিরুদ্ধেই বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এসব ব্যবস্থা আদালতের মতই।
“এখানেও অভিযোগ গঠন করা হয়, যার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়, তাকে ব্যাখ্যা দিতে হয়। যদি তার ব্যাখ্যা সন্তোষজনক না হয়, ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হয়। এখানেও সাক্ষ্য তলব করা হয়, সেসব সাক্ষ্য যাচাইবাছাই হয়। এরপর যুক্তি উপস্থাপন হবে, এরপর রায় দেওয়া হয়।”
গুরুতর অভিযোগ থাকলে দুটি পদ্ধতি আছে জানিয়ে নুরুল হুদা বলেন, “পুলিশের কাছে অভিযোগ করা যায় অথবা আদালতের কাছে অভিযোগ করা যায় “
তবে পুলিশ সদস্যরা নিজেদের কর্মকর্তাদের রক্ষার জন্য কাজ করে- এমন অভিযোগ থাকার কথা জানিয়ে সাবেক আইজিপি বলেন, “এর কিছু উদাহরণ আছে। তবে অপরাধের কারণে চাকরিচ্যুতির উদাহরণও আছে।
“আদালতের মাধ্যমে বিচারের ঘটনাও আছে। সংখ্যাটি সব পক্ষের কাছে সন্তোষজনক নাও হতে পারে, তবে প্রক্রিয়া আছে।”
তদন্তে দুর্বলতা ও দীর্ঘসূত্রতা কেন?
প্রায় ৩২ বছরের চাকরি জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে নুরুল হুদা বলেন, এখানে বেশ কিছু বিষয় কাজ করে। সংক্ষেপে এর জবাব দেওয়া কঠিন।
“তদন্তের মান উন্নত হতে হবে, সেই সঙ্গে ল্যাব ও ফরেনসিক সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। সেই সঙ্গে পুলিশ কর্মকর্তাদের খুব দ্রুত বদলি করে দেওয়া উচিত হবে না, যাতে করে তারা আদালতে সাক্ষী হতে পারেন।
“সাক্ষী হাজির করার জন্য আরও বেশি বরাদ্দ থাকা উচিত। কারণ, যাতায়াত ভাড়া ও অন্যান্য খরচ না দিলে সাক্ষীরা আদালতে হাজির হতে চান না; বিচারকের সংখ্যাও বাড়াতে হবে। ফলে সব দিক দিয়েই পদক্ষেপ নিতে হবে।”
তদন্তের মান বাড়ানোর ক্ষেত্রে পুলিশ কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ এবং তদন্তের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে বরাদ্দ বাড়ানোর তাগিদ দেন সাবেক আইজিপি।
তিনি বলেন, “পুলিশ মোটাদাগে দুই দিক দিয়ে কাজ করে। প্রথমত, অপরাধ প্রতিরোধ; দ্বিতীয়ত, অপরাধ শনাক্ত ও তদন্ত। অপরাধ প্রতিরোধে ভালো অর্থ বরাদ্দ থাকলেও তদন্তের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত বাজেট থাকে না।”
কী ধরনের প্রশিক্ষণ ও পদক্ষেপ জরুরি জানতে চাইলে তিনি বলেন, “তদন্ত কর্মকর্তা যদি ইচ্ছাকৃত কোনো কিছু করেন, তাহলে তাকে শাস্তি দিতে হবে। আগেই বলেছি ল্যাব সুবিধা থাকতে হবে। তদন্তের মান উন্নয়নের জন্য প্রশিক্ষণে ক্রাইম সিন সংরক্ষণ, আঙুল ও পায়ের ছাপ সংগ্রহসহ তদন্তে যেসব বিষয় গুরুত্বপূর্ণ, সেগুলো আদালতে তথ্য-প্রমাণকে বিশ্বাসযোগ্য করে, সেগুলো সংগ্রহে বেশি জোর দিতে হবে।
“স্বীকারোক্তিনির্ভর প্রমাণ কোনো লাভ হয় না। কারণ, স্বীকারোক্তি খুব দুর্বল প্রমাণ। এগুলো বাদ দিয়ে বস্তুগত প্রমাণ জোগাড় করতে হবে, যাতে করে মামলা প্রমাণ করা যায়।”
তদন্ত কর্মকর্তা বদলি হয়ে যান, সাক্ষ্য দিতে আসতে পারেন না; তাতে বিচারেও বিলম্ব হয়। এসব নিয়ে অনেক কথা হলেও সমাধান হয়নি কেন, এমন প্রশ্নও ছিল সাবেক আইজিপির কাছে।
জবাবে তিনি বলেন, “এর উত্তর দেওয়া খুব কঠিন। একজন কর্মকর্তাকে অনেক কারণে বদলি করা হয়। তবে বদলি কমাতে চেষ্টা করতে হবে। কারণ, তদন্ত কর্মকর্তাই মামলার শেষ সাক্ষী এবং তার সাক্ষ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
“এগুলো প্রশাসনিক বিষয়। পুলিশ কর্মকর্তা ও বিচারিক হাকিমদের মধ্যে মাসিক বৈঠক হয়ে থাকে। পুলিশও মাসিক ও ত্রৈমাসিক বৈঠক করে থাকে। এসব ফোরামে এই বিষয়গুলো তোলা উচিত।
“এতে হয়ত সময় লাগবে। তবে তদন্তের স্বার্থে এবং জনগণের স্বার্থে এটা (তদন্ত কর্মকর্তার বদলি) কমানোর চেষ্টা করা উচিত।”
অন্য এক প্রশ্নে নুরুল হুদা বলেন, “পুলিশের স্বাধীন থাকা উচিত নয়। স্বায়ত্তশাসিত আর কাজের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ থাকা উচিত। আর তদন্তে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ থাকা উচিত না।”