ঢাকায় সেনাবাহিনীর এক অবসরপ্রাপ্ত চিকিৎসকের বাসা থেকে লাইসেন্স করা পিস্তল চুরির ঘটনার চার বছর পর বরিশালের গৌরনদী এলাকা থেকে সেটি উদ্ধার করে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
পিবিআইয়ের বিশেষ পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলম জানিয়েছেন, শনিবার রাতে বরিশালের গৌরনদী থানার বাটাজোর ইউপির নোয়াপাড়া গ্রাম থেকে তারেক হাওলাদার নামের ওই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার বাড়ির রান্নাঘরের মেঝের মাটি খুঁড়ে উদ্ধার করা হয় চুরি যাওয়া পিস্তলটি।
পুলিশ বলছে, ২০১৯ সালে এই চুরির মামলাতেই তারেক গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তবে সে সময় তিনি কিছু স্বীকার করেননি। পরে জামিনে বেরিয়ে তিনি পরিবার নিয়ে ঢাকা ছেড়ে গৌরনদীতে চলে যান।
তারেকের বিরুদ্ধে চুরি ও মাদকসহ বেশ কয়েকটি মামলা রয়েছে বলেও জানিয়েছে পিবিআই।
ঘটনার বিবরণে বিশেষ পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকা সেনানিবাস এলাকা থেকে চিকিৎসক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সামছুল হুদার ফ্ল্যাট থেকে নগদ ৩২ লাখ টাকা, বেশ কিছু বিদেশি মুদ্রা, স্বর্ণালঙ্কার, পিস্তল-গুলি-ম্যাগাজিনসহ প্রায় ৫৬ লাখ টাকার মালামাল চুরি হয়।
চুরির পরপরই ভাষানটেক থানায় মামলা করেন সামছুল হুদা। এপর পুলিশ ওই বাড়ির দারোয়ান, গাড়িচালক এবং তারেক হাওলাদারকে গ্রেপ্তার করেন।
“কিন্তু জিজ্ঞাসাবাদে তারেকের কাছ থেকে পুলিশ কোনো তথ্য বের করতে পারেনি। ঘটনার প্রায় চার বছর পর গত শনিবার রাতে বরিশাল থেকে সেই তারেককে আবারও গ্রেপ্তার করে পিবিআই। এবার জিজ্ঞাসাবাদে তারেক অপরাধ স্বীকার করেছে,“ বলেন জাহাঙ্গীর আলম।
রোববার আগারগাঁওয়ে পিবিআই ঢাকা মেট্রো উত্তরের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এসে ওই চুরি এবং তারেককে গ্রেপ্তারের বিস্তারিত বলছিলেন তিনি। মামলার বাদী সামছুল হুদাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
তারেককে ধরতে গ্রামের লোকজন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা পুলিশকে নানাভাবে সহযোগিতা করেছে জানিয়ে জাহাঙ্গীর আলম বলেন, “তারেকের দেওয়া তথ্যমতে তার বাড়ির রান্নাঘরের মেঝেতে তিন ফুট মাটি খুঁড়ে পলিথিন দিয়ে প্যাঁচানো অবস্থায় পিস্তলটি উদ্ধার করা হয়। তবে এর সঙ্গে চুরি যাওয়া গুলি ও ম্যাগাজিন উদ্ধার হয়নি।
“তারেক জানিয়েছে ওই বাড়ি থেকে সে ১৮ লাখ টাকা পেয়েছিল। কিন্তু তার কাছে কোনো টাকাই পাওয়া যায়নি, সে সব টাকা খরচ করে ফেলেছে বলে দাবি করেছে। এছাড়া তারেক একাই ওই চুরির ঘটনাটি ঘটিয়েছে বলে পুলিশের কাছে স্বীকারও করেছে।“
জাহাঙ্গীর আলম জানান, অস্ত্র উদ্ধারের পর গৌরনদীতে তারেকের বিরুদ্ধে নতুন করে মামলা দায়ের করা হয়েছে। নতুন মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠিয়েছে সেখানকার পুলিশ।
“আদালতের অনুমতি নিয়ে ভাসানটেকের চুরির মামলায় তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে পিবিআই। তখন চুরির ঘটনাটি নিয়ে আরও তথ্য বেরিয়ে আসতে পারে।“
ওই অভিযানে অংশ নেওয়া পিবিআইয়ের পরিদর্শক জুয়েল মিয়া বলেন, বাবা-মাকে নিয়ে তারেক ঢাকার ভাসানটেকের একটি বস্তিতে থাকতেন। সামছুল হুদার চুরির মামলায় গ্রেপ্তার হওয়ার পর জামিন পেয়েই বাবা-মাকে নিয়ে গ্রামে চলে যান তিনি তারেক।
“সেখানে তাদের আর্থিক অবস্থার দৃশ্যমান পরিবর্তন ঘটেছে। তারেক সেখানে বিয়ে করেছেন, নতুন করে বাড়ি-ঘর করেছেন।“
সামছুল হুদার মূল দুঃশ্চিন্তা ছিল অস্ত্র নিয়ে
অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সামছুল হুদা সংবাদ সম্মেলনে জানান, ২০১৯ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে তিনি অন্য দিনের মত গুলশান ল্যাব এইডে রোগী দেখতে যান। ওই সময় তার স্ত্রী কানাডায় ছেলের কাছে থাকায় বাসা ফাঁকাই ছিল।
রাত ১১টার দিকে বাসায় ফিরে তালা খুলে ভেতরে ঢুকতে পারছিলেন না। এরপর তালাচাবির মিস্ত্রী আনার পর দেখা যায় বাড়ির দরজা ভেতর থেকে লক করা। এরপর বাসার কেয়ার টেকার বাড়ির চারদিক ঘুরে বুঝতে পারেন, পেছন দিকে জানালার গ্রিল কাটা। তখন সামছুল হুদার গাড়িচালক সেই কাটা গ্রিলের ফোঁকর দিয়ে ভেতরে ঢুকে মূল দরজার ছিটকিনি খুলে দেন।
সামছুল হুদা বলেন, “ভেতরে ঢুকে দেখি বেডরুমের আলমারির ড্রয়ার বিছানায় পড়ে আছে এবং আলমারী খোলা ও তছনছ করা। ড্রয়ারে একটি ব্যাগের ২৫ লাখ টাকার মতো ছিল, যা জলসিঁড়ি প্রকল্পের জমির দাম বাবদ তুলে এনে রাখা হয়েছিল। এর বাইরে আরও সাত লাখের মত নগদ টাকা, দুই হাজার কানাডিয়ান ডলার, ৪৫ ভরি স্বর্ণাঙ্কার চোর নিয়ে গেছে। এছাড়া ৫০ রাউন্ড গুলি এবং দুটি ম্যাগাজিনসহ ইতালির তৈরি লাইসেন্স করা পিস্তলটিও নেই।”
সামছুল হুদা জানান, তিনি তখন পুলিশকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কিসের ভিত্তিতে তারেকসহ বাকিদের গ্রেপ্তার করা হল। জবাবে পুলিশ জানিয়েছিল, তারা (গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিরা) এলাকার তালিকাভুক্ত চোর, এরাই জানবে ঘটনাটি কে ঘটিয়েছে। কিন্তু জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশ তারেকের কাছ থেকে কিছুই বের করতে পারেনি। পরে তিনি জামিনে বেরিয়ে যান।
চুরির পর থেকে পিস্তলটির জন্য খুবই চিন্তিত ছিলেন বলে জানান সামছুল হুদা। ওই অস্ত্র দিয়ে কোনো অঘটন ঘটে গেলে সেই দায় তার ওপরও বর্তায় কি না, সেই চিন্তা থেকে গত প্রায় চার বছর তিনি পুলিশের বিভিন্ন দপ্তরে গেছেন, যাতে অন্তত পিস্তলটা উদ্ধার করা হয়। এরপর মামলার তদন্তভার পায় পিবিআই।
ওই ঘটনার চার বছর পর শনিবার রাতে পিবিআই এর পরিদর্শক জুয়েল মিয়া তাকে ফোন করে জানান, পিস্তল উদ্ধার করা হয়েছে সেই তারেক হাওলাদারের কাছ থেকেই।