“রোজা আসলেই ইফতার নিতে চকবাজারের আসি; নানা আইটেমের নানা স্বাদ, যেমন মন চায় নিয়ে যাই,” বলেন ক্রেতাদের একজন।
Published : 04 Mar 2025, 12:06 AM
বাসার আশেপাশে বিভিন্ন ইফতারির দোকান থাকলেও চকবাজারের ইফতারের স্বাদ অন্য কোথাও পান না পুরান ঢাকার মোগলটুলির বাসিন্দা মমতাজ উদ্দিন।
একটা সময় রোজায় প্রায় প্রতিদিনই ইফতারির জন্য আসতেন চকবাজারে। এখন আসেন ছেলেমেয়ে আর নাতি-নাতনিদের পুরনো সেই স্বাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে।
সত্তরোর্ধ্ব মমতাজ উদ্দিন সোমবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আসলে এখানে কিছু কিছু আইটেম থাকে যা অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। এখানকার স্বাদও আর কোথাও পাই না। বাইরে থেকে ইফতার কিনতে হলে এখান থেকেই কিনি।
“তবে এখন বয়স হয়েছে। ছেলেমেয়েরা আমার নাতিদের রোজা উপলক্ষে নিয়ে আসে। তাদের তো চকবাজারের ইফতারি ছাড়া আর কিছু খাওয়ানো যায় না। এখানকার ইফতারির ব্যাপারটাই আলাদা।”
লক্ষ্মীবাজারের ষাটোর্ধ্ব সুলাইমান হোসেনও বললেন, চকবাজারে ইফতার অনুষঙ্গ তার পরিবারের ঐতিহ্য হয়ে গেছে।
তার কথায়, “সেটা বলতে পারেন আমার বাপের আমল থেকে। রোজা আসলেই আমি ইফতার নিতে চকবাজারের চলে আসি। নানা আইটেমের নানা স্বাদ। তাই যেমন মন চায়, নিয়ে যাই।”
পুরান ঢাকার চকবাজারের শাহী মসজিদ এলাকা জমজমাট হয়ে ওঠে রোজার মাসে। ঐতিহ্যবাহী মুখরোচক নানা পদের ইফতারের জন্য দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসে লোকজন। এবারও তার ব্যতিক্রম নেই।
রোজার দ্বিতীয় দিন সোমবার দুপুর থেকেই দেখা গেল বিক্রেতাদের হাঁকডাক। ইফতারির বিভিন্ন পদের পসরা সাজিয়েছেন বিক্রেতারা। তাদের কেউ ব্যবসায় নতুন, কেউ আবার বাপ-দাদার আমল থেকেই এই ব্যবসায় চালিয়ে আসছেন।
চকবাজারের ইফতারের স্বাদ নিতে সোমবার শান্তিনগর থেকে ছেলেকে নিয়ে আসেন সচিবালয়ে কর্মরত সুমাইয়া ইসলাম। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “চকবাজারের ইফতারি বিখ্যাত, তাই প্রতি বছর এখান থেকে ইফতারি নিয়ে যাই। প্রতি দিন নিতে পারি না। যেদিন সময় পাই, চলে আসি চকবাজারে। তা ছাড়া বাসায় কোনো মেহমান আসলে আমরা চকবাজার থেকেই ইফতার নিয়ে যাই।”
‘বড় বাপের পোলায় খায়’
চকবাজারের ইফতারে ক্রেতাদের কাছে প্রধান আকর্ষণ ‘বড় বাপের পোলায় খায়’। বিভিন্ন উপাদান দিয়ে বানানো এই খাবার বিক্রির সময় হাঁকডাক চলে, ‘বড় বাপের পোলায় খায়, ঠোঙা ভইরা নিয়ে যায়’।
কয়েকজন বিক্রেতা ও স্থানীয় লোকজন বলছেন, অত্যন্ত পরিচিত এ ইফতারি পদ তৈরিতে মাংস, সুতি কাবাব, মাংসের কিমা, ডাবলি, বুটের ডাল, ডিম, মগজ, আলু, ঘি, কাঁচা ও শুকনো মরিচসহ নানা উপাদান ও মসলার প্রয়োজন হয়। দোকান ও মানভেদে ৮০০-১২০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয় এ খাবার।
‘বড় বাপের পোলায় খায়’ বিক্রিতে ক্রেতা আকর্ষণে সোমবার নানা ভঙ্গিতে ডাকাডাকি করতে দেখা গেল বিক্রেতাদের। কেউ বলছিলেন, ‘ধনী-গরিব সবাই খায়, মজা পাইয়া লইয়া যায়’, ‘মজার খাওন খাইয়া যান, প্যাকেট ভইরা লইয়া যান’, ‘আসল খাওন দেইখা যান, বাসার লাইগা নিয়া যান’।
উত্তরা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সাইফুল্লা আব্বাসী সিয়াম ও তার কয়েক বন্ধু ‘বড় বাপের পোলায় খায়’ নিতে আসেন চকবাজারে।
সিয়াম বলেন, “আজকে আমাদের কয়েকজন বন্ধুরা মিলে একসঙ্গে ইফতার করব। সবাই বলল চকবাজার থেকে ইফতার নিতে। আমরা কয়েকটা আইটেম নিয়েছি। ‘বড় বাপের পোলায় খায়’ খুবই ঐতিহ্যবাহী, বলে এটাও নিয়েছি, বন্ধুরাও বলেছে এটা নিতে।”
বিক্রেতা মোহাম্মাদ আলীর ভাষ্য, “আমাদের এই ব্যবসা ‘বড় বাপের পোলায় খায়’, এটা প্রায় ৭০ বছরের পুরনো। পাকিস্তানি আমলে আমার বাপ বিক্রি করত, তারও আগে আমার দাদা বিক্রি করত। ঐতিহ্যবাহী ‘বড় বাপের পোলায় খায়’ বানানো বাপের কাছ থেকে শিখে নিয়েছি।”
“এখানে বারো রকমের জিনিস, বারো রকমের মসলা দিয়ে আমরা এটা তৈরি করি। এর মধ্যে রয়েছে মুরগি, ডিম, ডাল, ঘি, খাসির কলিজা, খাসির মগজ, খাসির কাবাব, সুতি কাবাব, খাসির পা থাকে।”
ইফতার নিতে আসা আজিমপুরের আলাউদ্দিন বলেন, “আমাদের ইফতারে বেশিরভাগ সময় ‘বড় বাপের পোলা খায়’ আইটেমে থাকে। এটি খেতে দারুণ লাগে। তা ছাড়া এটা যেমন ঐতিহ্যবাহী, আমাদের পরিবারের ঐতিহ্যও হয়ে গেছে।”
এবার দাম কেমন
চকবাজারের ইফতারের দোকানগুলো ঘুরে দেখা যায়, গরুর সুতি কাবাব ১২০০ টাকা কেজি, খাসির সুতি কাবাব ১৫০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজি শাহী ছোলা ৩২০ টাকা, ঘুগনি ১৬০ টাকা, চিকেন আচারী ১৩০ টাকা, কাশ্মীরি বিফ আচারী ১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। চিকেন রোল ৫০ টাকা, হালিমের বাটি ১০০ থেকে ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
প্রায় ৫০ পদের ইফতারির মধ্যে প্রতি পিস অন্থন ৩০ টাকা, চিকেন সাসলিক ৪০ টাকা, হালিম প্রতি কেজি ৬০০ টাকা, বটি কাবাব ১৩০ টাকা, শাহী জিলাপি প্রতি কেজি ৩০০ টাকা, কোয়েল পাখির রোস্ট ৮০ টাকা, কবুতর রোস্ট ৮০ টাকা, খাসির লেগ রোস্ট ৮০০ টাকা, চিকেন বটি কাবাব ১৫০ টাকা, কাশ্মীরি বটি কাবাব ১৫০ টাকা, চিকেন কাটলেট ৪০ টাকা, আস্ত মুরগির রোস্ট ৪৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
চকবাজারের ইফতারের দাম যাই হোক, ক্রেতাদের অনেকের কাছে বিষয়টি ‘গৌণ’।
শান্তিনগরের সুমাইয়া ইসলাম বলেন, “অন্যান্য বছরের তুলনায় দামের তেমন পার্থক্য নাই, তবে দামটা এখানকার ইফতারের সঙ্গে মুখ্য না। নানা স্বাদের ইফতারি এখানে পাওয়া যায়। যেটা আপনি ঢাকার অন্য কোথাও পাবেন না, বলতে পারেন এখানকার ইফতার ইউনিক।”
দাম নিয়ে বিক্রেতাদের কেউ কেউ বলছেন, এবার তেল-মসলা ও মাংসের দাম চড়ার কারণে ইফতারের দাম একটু বেশি। তবে গতবারের চেয়ে বিস্তর ফারাকও তৈরি হয়নি বলে দাবি করছেন তারা।
বিক্রেতা মন্টু মিয়া বলেন, “ঢাকার শেষ প্রান্ত থেকেও এখানে লোকজন আসে ইফতার নিতে। ক্রেতারা বেশি দামাদামি করে না, বেশিরভাগই কোনটা কতগুলো লাগবে সেটা বলে। প্যাকেট করে দাম বলি, দিয়ে দেয়।”
দাম বেড়েছে কিনা, জানতে চাইলে তিনি বলেন, “যতই বলেন, আমাদের ব্যবসায়ীদের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা আছে। কেউ দাম একটু বেশি রাখলে ক্রেতারা অন্যদিকে চলে যায়। দাম এবার আমরা বাড়াইনি খুব একটা। অল্প কিছু বেড়েছে। তবে সেটা তেমন না।”
আরেক বিক্রেতা বাবলু মিয়া বলেন, “এবার তেলের পাশাপাশি মসলা ও মাংসের দাম বেশি। তাই চাইলেও দাম কমাতে পারছি না। তবে দাম গত বছর থেকে কিছুটা বেশি রেখেছি।”
বিক্রেতা হারুন অর রশিদ বলেন, “এবার ইফতারের দাম গত বছরের মতই। নিত্যপ্রয়োজনীয় মসলা, তেল ও মাংসের দাম বেশি। ইফতারের দাম না বাড়িয়ে উপায় নেই।
“৫৫ বছর ধরে এখানে ব্যবসা করছি। আমার আগে বাবা, দাদা করত। অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার ভিড় একটু কম। তারপরও হাঁটার মত জায়গা নেই। কারণ এটি ঐতিহ্যবাহী ইফতার বাজার। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ এখানে আসে। একসঙ্গে এত ইফতার আর কোথাও পাওয়া যায় না।”
রাজধানীর সুত্রাপুর থেকে ছেলেকে নিয়ে সোমবার চকবাজারের ইফতার নিতে আসেন বাদল মিয়া। তিনি বলেন, “প্রতি বছর কয়েকবার চকবাজারের আসি। এবার ছেলে বলেছে, ‘বড় বাপের পোলায় খায়, ঠোঙা ভইরা লইয়া যায়’ কিনতে হবে। তাই তাকে নিয়ে এসেছি।
“এখানকার ইফতারের একটা ঐতিহ্য আছে। তাছাড়া এখানে যে আইটেম একসঙ্গে পাওয়া যায়, তা অন্য কোথাও পাওয়া যায় না।”
পুরনো খবর-
'বড় বাপের পোলায় খায়': বাপ কে? পোলা কে?
'বড় বাপের পোলায় খায়'র 'আসল' স্বাদ চকবাজারে