দুপুর গড়িয়ে বিকাল পর্যন্ত একের পর এক পরিচিত মুখের আগমনে পুরো আড্ডা রূপ নেয় মিলনমেলায়।
Published : 14 Apr 2024, 09:54 PM
আশি পেরুনো চিত্রশিল্পী মনিরুল ইসলাম যখন ছবির স্মৃতি বলছিলেন, মনে হচ্ছিল এখনও যেন টগবগে তরুণ; হরেক রকম খাবার থেকে বেছে নেওয়ার আগে আনোয়ারা সৈয়দ হক একটু যেন ভেবেও নিলেন। রামেন্দু মজুমদার ডাবের জলে চুমুক দিতে দিতে জমিয়ে তুললেন আড্ডা।
এমনই আড্ডা, গল্পে আর উচ্ছ্বাসে বাঙালির চিরায়ত উৎসব নববর্ষ উদযাপন করল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। আর তাতে সঙ্গী হলেন শিল্প-সাহিত্য থেকে শুরু করে রাজনীতি, কূটনীতি আর শিল্প-বাণিজ্যসহ বিভিন্ন অঙ্গনের মহারথীরা।
রোববার ঢাকার পুরাতন ডিওএইচএসে এই ঘরোয়া আয়োজন শুরু হয় দুপুরে বেলা। বিকাল পর্যন্ত একের পর এক পরিচিত মুখের আগমনে পুরো আড্ডা রূপ নেয় মিলনমেলায়।
বর্ষবরণের এ আয়োজনে দীর্ঘদিন পর অনেকের সঙ্গে দেখা হওয়ায় তা নতুন বছরের শুভেচ্ছা বিনিময়ে থেমে থাকেনি। একে অপরের খোঁজখবর নেওয়ার পাশাপাশি মেতেছিলেন স্মৃতিচারণে, খোশগল্পে।
শিল্পী, সাহিত্যিক, অভিনেতা ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে প্রশাসনের সাবেক কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদসহ নানান পেশার অতিথিরা পড়ন্ত বিকালেও মুখরিত করে রেখেছিলেন অনুষ্ঠানস্থল।
অতিথিদের স্বাগত জানানো আর সহকর্মীদের নিয়ে তাদের আপ্যায়নে ছিলেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদী।
বাংলা নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর এ আয়োজনে আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান শিল্পী মনিরুল ইসলাম ও কথা সাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হকরা যেমন ছিলেন, তেমনি অপেক্ষাকৃত কম বয়সী শিল্পী মোহাম্মদ ইকবাল ও চিত্রশিল্পী রশীদ আমিন আর লেখক-অনুবাদক আন্দালিব রাশদীরাও শামিল হন।
স্পেন প্রবাসী ৮১ বছর বয়সী চিত্রশিল্পী মনিরুল ইসলাম আড্ডা আর গল্পের ফাঁকে ফাঁকে অনুষ্ঠানস্থলে টাঙানো বিভিন্ন ছবি ঘুরে ঘুরে দেখে সেগুলোর বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেন। বর্ষীয়ান এ শিল্পীকে কাছে পেয়ে উচ্ছ্বসিত অনেকেই তার সঙ্গে ছবি তোলেন, ছবি নিয়ে তার স্মৃতিকথা শোনেন।
গুলশানে নিজেদের আয়োজনে বৈশাখ উদযাপন থেকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে আসেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম।
স্ত্রী রোখসানা খন্দকারকে সঙ্গে নিয়ে নববর্ষ উদযাপনে আসেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য, সাবেক মন্ত্রী আব্দুল মঈন খান।
অভিনেতা, নাট্য সংগঠক রামেন্দু মজুমদার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক, নাট্যকার সামিনা লুৎফা নিত্রা, নাট্য নির্দেশক মোহাম্মদ আলী হায়দার, অভিনয়শিল্পী সংঘের সভাপতি আহসান হাবিব নাসিমও ছিলেন আয়োজনে।
কূটনীতিকদের মধ্যে ঢাকায় দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত পার্ক ইয়ং-সিক, স্পেনের রাষ্ট্রদূত গাব্রিয়েল সিসতাগা, ভারতীয় হাই কমিশনের মিনিস্টার (কনসুল্যার ও শিক্ষা) রাজেশ কুমার অগ্নিহোত্রী, ঢাকায় রাশিয়ান হাউজের পরিচালক পাভেল এ. ডিভয়চেনকভ যোগ দেন বাঙালির চিরায়ত এ উদযাপনে।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য একে আজাদ চৌধুরী, আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেনও ছিলেন বৈশাখী পরবে।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) সাবেক নির্বাহী চেয়ারম্যান, প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সাবেক সচিব কাজী মো. আমিনুল ইসলাম অনুষ্ঠানে অংশ নেন।
মেয়েকে নিয়ে অনুষ্ঠানে এসেছিলেন বীর মুক্তিযাদ্ধা মো. মনিরুজ্জামান চৌধুরী। যখন তার পদোন্নতি পেয়ে সচিব হওয়ার কথা, তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর কবর জিয়রাত করার কারণে।
সচিব পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) কর্তৃপক্ষের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করা সুলতানা আফরোজ ও সাবেক যুগ্ম সচিব শামস আল মুজাদ্দেদ দম্পতিও আসেন বৈশাখের এ আয়োজনে।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক নজিব আহমেদ বর্ষবরণের উৎসবে এসেছিলেন।
আয়োজনে এসেছিলেন সম্প্রীতি বাংলাদেশের আহ্বায়ক অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় ও অভিনেত্রী জয়শ্রী কর জয়া দম্পতি; যোগ দেন সংগঠনের সদস্য সচিব অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব ও ডা. নুজহাত চৌধুরী দম্পতিও।
একুশে পদকজয়ী আবৃত্তিশিল্পী ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, জাতীয় কবিতা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক কবি তারিক সুজাত, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক মিনার মনসুর যোগ দেন নববর্ষ উদযাপনে।
দৈনিক ইত্তেফাক ও অনন্যা’র সম্পাদক তাসমিমা হোসেন, দৈনিক যুগান্তরের উপ-সম্পাদক এহসানুল হক বাবু, আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুনও ছিলেন আয়োজনে।
ফুল নিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের আয়োজনে শুভেচ্ছা জানাতে আসেন ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান ও অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ডিবি) হারুন অর রশীদ।
গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা আনন্দ জামান ও কাজী ফারজানা শারমীন যোগ দেন অনুষ্ঠানে।
উৎসবে এসেছিলেন নৌবাহিনীর সাবেক প্রধান, অবসরপ্রাপ্ত অ্যাডমিরাল আবু মোজাফফর মহিউদ্দিন মোহাম্মদ আওরঙ্গজেব চৌধুরী এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের প্রসূতি ও স্ত্রী রোগ বিভাগের অধ্যাপক ডা. আফরোজা গণি দম্পতিও।
স্পেন, থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ায় বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত শাহেদ আখতার এবং বিমসটেকের সাবেক মহাসচিব, রাষ্ট্রদূত এম শহীদুল ইসলামও ছিলেন বৈশাখের অনুষ্ঠানে।
নবম শ্রেণি পড়ুয়া মেয়েকে নিয়ে এসেছিলেন আইনজীবী তুরিন আফরোজ। আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ গবেষক-লেখক সালেক খোকন ও কবি তুষার দাস।
বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি জিকরুল আহসান শাওন ও উপদেষ্টা মশহুরুল আমিনও এসেছিলেন।
অনুষ্ঠানে মুখরোচক সব বাঙালি খাবারে অতিথিদের আপ্যায়ন করা হয়। বেলা ১টার দিকে অতিথিরা আসতে শুরু করলে তাপদাহের এ সময়ে কাঁচা আম ও তেঁতুলের শরবৎ, ডাবের পানি দিয়ে শুরু হয় আপ্যায়ন পর্ব।
বাতাসা, নাড়ু, মুড়কির মত খাবার যেমন ছিল, সিঙ্গারা, ডালপুরি আর চটপটির মত মুখরোচক খাবারও স্থান পায় আপ্যায়নে।
মূল খাবারে চিংড়ি করলা, লইট্যা শুঁটকি ভুনা, বেগুন দিয়ে রূপচাঁদা শুঁটকি ভুনা, ছুরি শুঁটকি, সালাদ, মাছের চচ্চড়ির সঙ্গে ছিল ইলিশের কয়েক পদ। সরষে ইলিশ, স্মোকড ইলিশ, ইলিশ ভাজা, ইলিশ মাছের মাথার সঙ্গে কচুর লতি আর সুস্বাদু এ মাছের ডিম ভুনা ছিল সেই তালিকায়।
নানান পদের ভর্তার মধ্যে বেগুন ভর্তা, আলু ভর্তা, টমেটো ভর্তা, ডিম ভর্তা, ডাল ভর্তা, কালোজিরা ভর্তা ও চিংড়ি ভর্তার মধ্যে থেকে বেছে নেওয়ার সুযোগ ছিল।
মাংসের পদে ছিল আচারি গরু, খাসির রেজালা ও মুরগি ভুনা। লাল চালের ভাত, সাদা চালের ভাত আর ভুনা খিচুড়ির সঙ্গে যুক্ত ছিল নগরে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের অনুষঙ্গ হয়ে ওঠা পান্তা ভাতও।
দুপুরের খাবার শেষে ঘরে তৈরি পায়েসের সঙ্গে টক কিংবা মিষ্টি দই, বরিশালের শশীর রসগোল্লা, সিরাজগঞ্জের পানতোয়া, সাভারের স্পঞ্জ রসগোল্লা, টাঙ্গাইলের চমচম আর যশোরের ক্ষীর সন্দেশে মিষ্টিমুখ করা হয় সবাইকে।