একসঙ্গে দুই দলের জমায়েত গত এক বছরে বহুবার দেখেছে ঢাকাবাসী। তবে দুই দলই শক্তি দেখানোর চেষ্টা করায় জনমনে রয়েছে উৎকণ্ঠা।
Published : 28 Oct 2023, 09:12 AM
প্রধান দুই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের পাল্টাপাল্টি সমাবেশের দিনে রাজধানীতে সকাল হয়েছে উৎকণ্ঠা নিয়ে।
শনিবার সকাল থেকে রাজপথে নগর পরিবহনের বাস চোখে পড়েনি খুব একটা। রিকশা ও অটোরিকশা থাকলেও ব্যক্তিগত গাড়িও সেভাবে বের হয়নি।
যানবাহনের আশায় বিভিন্ন মোড়ে অপেক্ষা করতে দেখা গেছে নিরুপায় মানুষকে। নগরীর গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোতে দেখা গেছে পুলিশের সতর্ক অবস্থান ।
পরিবহন শ্রমিকরা বলছেন, একই দিনে রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মসূচি ঘিরে গোলযোগের শঙ্কায় রাস্তায় বাস নেমেছে কম। কিছু গাড়ি বের হলেও পথে যাত্রী পাচ্ছে না তেমন।
সরকারের পদত্যাগ এবং নির্দলীয় সরকারের এক দফা দাবিতে দুপুরে নয়া পল্টনে মহাসমাবেশ করবে বিএনপি। রাতে বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নিয়ে ছিলেন। সকালে বিভিন্ন এলাকা থেকেও নেতাকর্মীদের মিছিল নিয়ে নয়া পল্টনের দিকে যেতে দেখা গেছে।
বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা ৩৭টি দলও সমাবেশ করবে ঢাকায়। বিজয়নগর, প্রেসক্লাব, কারওয়ানবাজার, আরামবাগ, পুরানা পল্টনসহ বিভিন্ন এলাকায় চলবে এসব কর্মসূচি।
যুগপৎ আন্দোলনে না থাকলেও নেতাকর্মীদের মুক্তি ও কেয়ারটেকার সরকারের দাবিতে মতিঝিলে মহাসমাবেশের ঘোষণা দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। তবে পুলিশ তাদের অনুমতি দেয়নি। সকাল থেকে শাপলা চত্বরের কাছে রাস্তায় দেওয়া ব্যারিকেড দিয়ে রেখেছে পুলিশ।
বিএনপির কর্মসূচির পাল্টায় দুপুরে শান্তি ও উন্নয়ন সমাবেশ করবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ ফটকে সেই প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে আগের রাত থেকেই।
একসঙ্গে দুই দলের জমায়েত গত এক বছরে বহুবার দেখেছে ঢাকাবাসী। তবে দুই দলই শক্তি দেখানোর চেষ্টা করায় শনিবার সকালে উৎকণ্ঠা নিয়েই গন্তব্যে বের হন নগরবাসী।
শনিবার সকালে ঢাকার মুগদা থেকে মহাখালী পর্যন্ত রাস্তা ঘুরে বিআরটিসির দুটি বাস ছাড়া নগর পরিবহনের কোনো বাস দেখা যায়নি।
মগবাজারে যাওয়ার জন্য মিরপুর ১০ নম্বর বাসস্ট্যান্ডে অপেক্ষায় ছিলেন জুয়েল মাহমুদ। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আয়াত পরিবহনের বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছি। অন্য সময় দশ মিনিট পরপর বাস আসে, কিন্তু প্রায় ৪০ মিনিট হয়ে গেল বাস পাচ্ছি না।”
সকালে মিরপুর থেকে সায়দাবাদ, আজিমপুর এবং সদরঘাটের দিকে যাচ্ছিল কয়েকটি বাস। একটি বাসের চালকের সহকারী পারভেজ হাসান বলেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কর্মসূচির কারণে রাস্তায় গাড়ি কম।
“বেশিরভাগ গাড়ি গ্যারেজ কইরা রাখছে। দুই দলের প্রোগ্রামের কারণে কোনো ঝামেলা হতে পারে এই ভয়ে। আর রাস্তায় প্যাসেঞ্জারও নাই।”
মিরপুর এক নম্বর গোল চত্বর এলাকায় বাসের সংখ্যা খুব কম দেখা গেছে। সনি সিনেমা হলের সামনে ডেমরা থেকে গাবতলীগামী অছিম পরিবহনের একটি বাসে ঘুরিয়ে দিতে দেখা যায়।
বাসটির চালক শামীম আহমেদ বলেন, “যাত্রী কম, এছাড়া কর্মসূচিতে যাওয়ার জন্য আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা গাড়ি আটকাচ্ছেন। বাড্ডাতে আমাদের তিনটা গাড়ি আটকে দিছে। এছাড়া অন্য পরিবহনের গাড়িও আছে।
“ওইখানে সারাদিন খাটাইব তেলের টাকাও দেয় না। এমনি গাড়ি চালানোর চেয়ে বসাইয়া রাখাই ভালো। এখন গ্যারেজে চলে যামু।”
টেকনিক্যাল মোড়ে বাসের অপেক্ষা ছিলেন অনেক যাত্রী। একটি বাস আসা মাত্রই যাত্রীরা হুড়মুড়িয়ে ওঠার চেষ্টা করেন।
আসাদগেট যাওয়ার জন্য বাসের অপেক্ষায় থাকা শাফায়েত হোসাইন নামে এক কলেজ শিক্ষার্থী বলেন, “আধা ঘণ্টা ধরে বাসের অপেক্ষায় আছি। বাস আসেই না, খুব কম। অনেকক্ষণ ধরে দাড়ায় আছি।”
মিরপুর থেকে আজিমপুর রুটের মিরপুর লিংক পরিবহনের ২৫টির মত পরিবহন কোম্পানির বাস চলাচল করলেও শনিবার পাঁচ-ছয়টি বাস চলছে বলে জানান লাইনম্যান জামিল।
তার ভাষ্য, “গ্যাঞ্জাম হওয়ার ভয় আছে, এজন্য মানুষের রাস্তায় আসে নাই। যাত্রী না পাইলে গাড়ি চালায় লাভ কী?”
মিরপুরের কালশী, ইসিবি চত্বর, বানানী, কাকলী ও মহাখালী এলাকায় অনেক মানুষকে গাড়ির জন্য অপেক্ষায় থাকতে দেখা যায়। অনেক সময় পর পর দুয়েকটি বাস আসার পর তাতে ওঠার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন বেসরকারি অফিসগামী লোকজন।
সকাল থেকে সড়কে গণপরিবহন কম থাকলেও কিছু ব্যক্তিগত গাড়ির পাশাপাশি অটোরিক্সা চলছে। মোটরসাইকেলে রাইড শেয়ার করেন এমন অনেকেও বাইক নিয়ে রাস্তায় রয়েছেন। তবে সড়কে বাস কম চলায় তারা অনেক বেশি ভাড়া চাচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন যাত্রীরা।
মহাখালীর একটি গাড়ি মেরামতের কারখানায় কাজ করেন সুমন মিয়া। অন্যদিন মোটরসাইকেলে করে ইসিবি চত্বর থেকে মহাখালীতে ১৫০ টাকায় যেতে পারলেও শনিবার ২৫০ টাকার কমে কেউ যেতে চাইছেন না বলে জানালেন।
সুমন বলেন, “সড়কে তো গাড়িই নেই। অনেক সময় পর পর বাস পাওয়া গেলেও ভিড়ের কারণে ওঠা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে বেশি টাকা খরচ করেই কারখানায় যেতে হবে।”
কয়েকটি পরিবহনের বাস বনানী এলাকার সড়কে সারি করে পার্ক করে রাখা হয়েছে। এসব বাসে চালক ও তাদের সহকারীদের দেখা যায়নি। সড়কে যানবাহন কম থাকায় বিভিন্ন পয়েন্ট ট্রাফিক পুলিশদের অসল সময় কাটাতে দেখা যায়।
কল্যাণপুর ও গাবতলী এলাকার সড়কে গণপরিবহন নেই বললেই চলে। এসব এলাকায় মানুষের চলাচলও কম রয়েছে। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতি দেখা গেছে।
টেকনিক্যাল মোড়ে রিকশা চালক শফিকুল ইসলাম বললেন, “দুই একটা লম্বা খ্যাপ মারব আশা করছিলাম। কিন্তু রাস্তায় মানুষ নাই।”
এসব এলাকার অধিকাংশ দোকানপাটও বন্ধ দেখা যায়। যানবাহন কম থাকায় দুর্ভোগে পড়েছেন জরুরি প্রয়োজনে বাইরে বের হওয়া মানুষ। বিশেষ করে নারী ও শিশুরা।
ধানমণ্ডির পপুলার হাসপাতালে যেতে মানিকগঞ্জ থেকে এক বছর বয়সী শিশুকে নিয়ে এসেছেন দুই নারী। আমিনবাজার ব্রিজের আগেই বাস ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে। পরে হেঁটে সেতু পার হয়ে গাবতলিতে অটোরিকশা চালকের সঙ্গে ভাড়া নিয়ে দরদাম করছিলেন তারা।
তাদের একজন বলেন, “এই রোদের মধ্যে বাচ্চারে নিয়া হাঁইটা আসলাম। এইভাবে যাওয়া সম্ভব না। সিএনজিওয়ালা সাড়ে তিনশ টাকা ভাড়া চায়। তিনশ টাকায় যাইতে রাজি হইছে।”
গাবতলী দিয়ে আধা ঘণ্টায় ৩/৪টি দূরপাল্লার বাস প্রবেশ করতে দেখা গেছে। তবে এসব বাসের বেশিরভাগ আসন ফাঁকা ছিল। মানিকগঞ্জ থেকে আসা কয়েকজন যাত্রী জানালেন, আমিন বাজারে তাদেরকে বাস থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে।
মালিবাগ মোড় থেকে কাকারাইলের দিকে যেতে যেতে দেখা যায় রাস্তায় রিকশাই বেশি। নগর পরিবহন প্রায় নেই।
মোমিন মিয়া নামের এক রিকশা চালক বললেন, “আজকে বিএনপির মহাসমাবেশ, কাস্টমার নাই। সকলে হাইট্টা হাইট্টা যায়। কি করমু? বইসা আছি।”
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রশ্নের জবাবে শুক্রবার রাতে বলেছিলেন, “গাড়ি চালানোর জন্য আমাদের নির্দেশ আছে, তবে যদি কোনো জ্বালাওপোড়াও ভাঙচুর না করে। কাল তিন গ্রুপের মিটিং, স্বাভাবিকভাবেই একটু আতঙ্ক বিরাজ করছে।”
‘মহাসমাবেশকে’ কেন্দ্র করে দলের নেতা-কর্মীদের গণহারে গ্রেপ্তারের অভিযোগ এনেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, “যদি সরকার এবং রুলিং পার্টি যদি কোনো রকমের বাড়াবাড়ি করে, অত্যাচার নির্যাতন করে তার দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে।”
অনদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের যে কোনো মূল্যে ‘মাঠ দখলে রাখার’ ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন।
বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা ঠেকাতে ‘নানা ধরনের ষড়যন্ত্র’ হচ্ছে মন্তব্য করে শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “আমরা মরতে হলে মরব, তবুও মাঠ ছাড়ব না। এটা বাংলাদেশের আরেক মুক্তিযুদ্ধ। এটাতে জিততে পারব যদি ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারি।
“আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বেঁচে থাকতে উন্নয়নের অগ্রযাত্রা ব্যাহত করতে দেব না, এটা আমাদের প্রতিজ্ঞা। বাংলাদেশ নিয়ে কোনো ষড়যন্ত্র সফল হতে দেব না।"
বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর পাশাপাশি আওয়ামী লীগকে ২০টি শর্তে এদিন সমাবেশ করার অনুমতি দিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ।
শর্তগুলো হল-
১. এই অনুমতিপত্র স্থান ব্যবহারের অনুমতি নয়, স্থান ব্যবহারের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট থেকে অনুমোদন নিতে হবে।
২. স্থান ব্যবহারের অনুমতিপত্রে উল্লেখিত শর্তাবলী যথাযথভাবে পালন করতে হবে।
৩. অনুমোদিত স্থানের মধ্যেই সমাবেশ এর যাবতীয় কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখতে হবে।
৪. বেলা ১২টার আগে কোনক্রমেই জনসমাগম করা যাবে না।
৫. নিরাপত্তার জন্য নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পর্যাপ্ত সংখ্যক স্বেচ্ছাসেবক (দৃশ্যমান আইডি কার্ডসহ) নিয়োগ করতে হবে।
৬. নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সমাবেশে আগতদের হ্যান্ড হেল্ড মেটাল ডিটেক্টরের মাধ্যমে (ভদ্রোচিতভাবে) চেকিং এর ব্যবস্থা করতে হবে।
৭. অনুমোদিত স্থানের বাইরে কোথাও লোক সমবেত হতে পারবে না।
৮. আজান, নামাজ ও অন্যান্য ধর্মীয় সংবেদনশীল সময়ে মাইক/শব্দযন্ত্র ব্যবহার করা যাবে না।
৯. ধর্মীয় অনুভূতির উপর আঘাত আসতে পারে এমন কোনো বিষয়ে ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শন, বক্তব্য প্রদান বা প্রচার করা যাবে না।
১০. অনুমোদিত সময়ের মধ্যে (বেলা ২টা থেকে ৫টা) সমাবেশের সার্বিক কার্যক্রম অবশ্যই শেষ করতে হবে।
১১. সমাবেশ সমাপ্তির পর যাওয়ার সময় রাস্তায় কোথাও কোনো সংক্ষিপ্ত সমাবেশ বা অবস্থান করা যাবে না।
১২. আদালতে সাজাপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তি সমাবেশে বক্তব্য দিতে পারবে না বা তার কোনো বক্তব্য সমাবেশে প্রচার করা যাবে না।
১৩. রাস্তার বাম লেন ন্যূনতম ব্যবহার করে সমাবেশ করতে হবে এবং অন্য লেনসমূহ কোনক্রমেই ব্যবহার করা যাবে না।
১৪. আইন-শৃঙ্খলা পরিপন্থী ও জননিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় এমন কার্যকলাপ করা যাবে না।
১৫. রাষ্ট্রবিরোধী কোনো কার্যকলাপ ও বক্তব্য প্রদান করা যাবে না।
১৬. উসকানিমূলক কোনো বক্তব্য প্রদান বা প্রচারপত্র বিলি করা যাবে না।
১৭. সমাবেশে ব্যানারের আড়ালে কোন ধরনের লাঠি-সোঁটা বা রড সদৃশ কোনো বস্তু ব্যবহার করা যাবে না।
১৮. আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ও কোন বিরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে আয়োজনকারী কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবেন।
১৯. উল্লিখিত শর্তাবলী যথাযথভাবে পালন না করলে তাৎক্ষণিকভাবে এই অনুমতির আদেশ বাতিল বলে গণ্য হবে।
২০. জনস্বার্থে কর্তৃপক্ষ কোনো কারণ দর্শানো ছাড়াই এ অনুমতি আদেশ বাতিল করার ক্ষমতা সংরক্ষণ করে।
শনিবার বেলা ২টায় নয়া পল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে বিএনপির মহাসমাবেশ শুরু হবে, যেখান থেকে তাদের আন্দোলনের ‘মহাযাত্রা’ শুরু হওয়ার কথা।