শিল্পী মুর্তজা বশীরের সংগ্রহশালা আলোয় আনলেন মেয়েরা

সংগ্রহশালায় রয়েছে শিল্পীর আঁকা একশর বেশি আত্মপ্রতিকৃতি, তার সংগ্রহ করা পাঁচ শতাধিক চাবির রিং, দুর্লভ মুদ্রা, ডাক টিকেট, পুঁথি, ভাস্কর্য, চিত্রকর্ম।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 August 2022, 05:20 AM
Updated : 18 August 2022, 05:20 AM

মুর্তজা বশীরকে যারা জানতে চান, তাদের জন্য এ শিল্পীর বিচিত্র সংগ্রহশালার একাংশ উন্মুক্ত করলেন তার দুই মেয়ে মুনীরা বশীর ও মুনিজা বশীর।

ঢাকার মণিপুরিপাড়ার যে বাসায় মুর্তজা বশীর থাকতেন, সেই ফ্ল্যাটটিকে সংরক্ষণ করা হয়েছে স্মৃতি জাদুঘর হিসেবে। বুধবার শিল্পীর ৯০তম জন্মবার্ষিকীতে তার ব্যক্তিগত সংগ্রহ আর বিভিন্ন শিল্পকর্মের প্রদর্শনী করা হয় সেখানে। শিল্পীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু আর স্বজনদের নিয়ে আয়োজন করা হয় প্রীতি সম্মেলন।

এই সংগ্রহশালায় স্থান পেয়েছে শিল্পীর আঁকা একশর বেশি আত্মপ্রতিকৃতি, তার সংগ্রহ করা পাঁচ শতাধিক চাবির রিং, দুর্লভ মুদ্রা, ডাক টিকেট, পুঁথি, ভাস্কর্য, চিত্রকর্ম আর শিল্পীর ব্যবহৃত আসবাবপত্র।

প্রদর্শনীর পাশাপাশি শিল্পী মুর্তজা বশীরকে নিয়ে নির্মিত তথ্যচিত্র এবং ভিডিও সাক্ষাৎকার দেখানো হয় ঘরোয়া এ আয়োজনে।

মুনীজা বশীর বলেন, “এই ফ্ল্যাটে বাবা থাকতেন। বাবা মারা যাওয়ার পর ফ্ল্যাটে বাবার যত সংগ্রহ ছিল, সেগুলো যত্ন করে রেখেছি। এই প্রীতি সম্মেলনে বাবার সংগ্রহের মাত্র ১০ ভাগ প্রদর্শন করতে পেরেছি।

“বাবার প্রচুর সংগ্রহ রয়েছে। সরকারের উচিত নতুন প্রজন্মের জন্য বাবার স্মৃতিচিহ্ন এবং শিল্পকর্ম সংরক্ষণ করা।”

শিল্পীর আরেক মেয়ে মুনীরা বশীর বললেন, এই সংগ্রহশালা এখনও সবার জন্য উন্মুক্ত করা হয়নি। তবে কেউ মুর্তজা বশীরকে নিয়ে গবেষণা করতে চাইলে তাকে স্বাগত জানানো হবে।

বাংলার জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র কনিষ্ঠ সন্তান মুর্তজা বশীরের জন্ম ১৯৩২ সালের ১ ৭ অগাস্ট। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ২০২০ সালের ১৫ অগাস্ট তিনি চিরবিদায় নেন।

মুনীরা বশীর বলেন, “বনানী কবরস্থানে শায়িত আছেন বাবা, দুই বছর হয়ে গেছে। এখন ওই কবরে অন্য কোনো মরদেহ দাফন করা হতে পারে। কিন্তু আমরা চাই, বাবার কবরটি যেন স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ করা হয়।”

সেজন্য বনানী কবরস্থান কর্তৃপক্ষের সাথে আলাপও করেছেন মেয়েরা। কিন্তু কবরটি স্থায়ীভাবে কিনতে হলে প্রায় এক কোটি টাকা লাগবে বলে জানালেন মুনীরা।

তিনি বলেন, “এত টাকা তো আমরা দিতে পারব না। দুই মাস আগে সিটি কর্পোরেশনের কাছে আবেদন করেছি। তারা আমাদের মৌখিক আশ্বাস দিয়ে বলেছেন, ‘উনি গুণী ব্যক্তি। তার কবর সংরক্ষণ করা আমাদের দায়িত্ব। আপনারা চিন্তা করবেন না’।”

এখন রাষ্ট্র এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেবে বলে আশা করছেন মুর্তজা বশীরের মেয়ে।

তিনি বলেন, “মুর্তজা বশীর দেশের সম্পদ। তাকে নতুন প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজটিও সকলকেই করতে হবে।”

প্রীতি সম্মেলনে এসেছিলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা গীতি আরা সাফিয়া চৌধুরী, প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান, আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুন, বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরীসহ অনেকে।

মুনীরা বশীর বলেন, “এই আয়োজনটি একেবারে অনানুষ্ঠানিক। এখানে আমাদের পরিবারের স্বজনদের পাশাপাশি মুর্তজা বশীরের কাছের মানুষ এবং শুভাকাঙ্ক্ষীদের আমন্ত্রণ জানিয়েছি।”

মুর্তজা বশীরকে নিয়ে একটি ট্রাস্টও গঠন করেছে তার পরিবার। এখনও উদ্বোধন না হলেও এ ট্রাস্ট থেকে প্রতি বছর ১৫-১৭ অগাস্ট তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠান করার পরিকল্পনার কথা বললেন মুনীরা।

আর মুনীজা জানালেন, প্রতি বছর তার বাবার নামে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার পেইন্টিং বিভাগের চারজন শিক্ষার্থীকে বৃত্তি দেওয়া হচ্ছে।

“বাবার একটি উপন্যাসের নাম ‘আলট্রামেরিন’। বৃত্তিটার নামকরণও করা হয়েছে ‘আলট্রামেরিন’। গত বছর থেকে বৃত্তি দেওয়া শুরু হয়েছে। প্রতি বছর এটা দেওয়া হবে।”

মুর্তজা বশীরের শিক্ষা জীবন শুরু হয় ঢাকার নবকুমার ইনস্টিটিউশনে, এরপর তিনি শিক্ষাগ্রহণ করেছেন বগুড়ার করোনেশন ইনস্টিটিউশন, ঢাকা গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অব আর্টস (এখন যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ) ও কলকাতা আশুতোষ মিউজিয়ামে।

এছাড়া ইতালির ফ্লোরেন্স একাডেমি দেল্লে বেল্লে আরতিতে চিত্রকলা ও ফ্রেস্কো বিষয়ে এবং পরে প্যারিসের ইকোলে ন্যাশিওনাল সুপিরিয়র দ্য বোজার্ট এবং আকাদেমি গোয়েৎসে মোজাইক ও ছাপচিত্রে অধ্যয়ন করেন তিনি।

১৯৫৫ সালে ঢাকার নবাবপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ড্রইং শিক্ষক হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু। ১৯৭৩ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে সহকারী অধ্যাপক পদে যোগ দেন। ১৯৯৮ সালে অবসরে যান অধ্যাপক হিসেবে।

বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে, প্রতিবাদে মুর্তজা বশীর ছিলেন অগ্রভাগে। সেজন্য তাকে কারাগারেও যেতে হয়েছে।

‘দেয়াল’, ‘শহীদ শিরোনাম’, ‘কালেমা তাইয়্যেবা’, ‘পাখা’ শিল্পী মুর্তজা বশীরের আঁকা উল্লেখযোগ্য সিরিজ। তিনি ‘বিমূর্ত বাস্তবতা’ নামে একটি শিল্পধারার প্রবর্তক। এছাড়া ফিগারেটিভ কাজে পূর্ব পশ্চিমের মেলবন্ধনে তিনি স্বকীয়তার স্বাক্ষর রেখেছেন।

চিত্রকলায় অবদানের জন্য ২০১৯ সালে স্বাধীনতা পদক, ১৯৮০ সালে একুশে পদক, ১৯৭৫ সালে শিল্পকলা একাডেমি পদক পেয়েছেন মুর্তজা বশীর।

শুধু চিত্রশিল্পের সাধনায় তিনি তৃপ্ত হননি, সিনেমার চিত্রনাট্য লিখেছেন, শিল্প নির্দেশনা দিয়েছেন। লিখেছেন কবিতা, গল্প, গবেষণা প্রবন্ধ।

তার মেয়ে মুনীরা বশীর বলেন, “বাবা সব সময় তার কাজের মধ্য দিয়ে মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকতে চাইতেন। তিনি বলতেন, ‘আমি ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ছেলে হিসাবে নয়, বরং সবাই যেন বলে মুর্তজা বশীরের বাবা ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ।’

“শেষ দিকে অবশ্য বাবা নিজেই আমাদের বলতেন, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ছেলে হিসাবেই তিনি গর্ববোধ করেন।”

মুর্তজা বশীরের ছেলে মেহরাজ বশীর বিদেশে থাকার কারণে প্রীতি সম্মেলনে উপস্থিত হতে পারেননি।

মুনীরা বশীর বলেন, “আমার ভাই বিদেশে রয়েছে। পরিবারের সবাই মিলে আলাপ করে শিগগিরই মুর্তজা বশীর ট্রাস্টের কিছু পরিকল্পনা জানাব। আপাতত এটুকু বলা যায়, প্রতি বছর মুর্তজা বশীর উৎসব আয়োজন করা হবে।”