“আগে আইনে ছিল ‘সশস্ত্র বাহিনীর’ কথা, এখন বলা হয়েছে ‘শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য’; এর মধ্যে রয়েছে তিন বাহিনী, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি এবং যেকোনো গোয়েন্দা সংস্থাসহ আনসার বাহিনী।”
Published : 25 Nov 2024, 05:05 PM
আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন ১৯৭৩ সংশোধন করায় এটি ‘আন্তর্জাতিক মানের’ হয়েছে বলে দাবি করছেন আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর প্রসিকিউটর বা রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীর দায়িত্ব পাওয়া গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামিম।
সোমবার ট্রাইব্যুনালে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এই দাবি করেন।
এসময় আরও কয়েকজন প্রসিকিউটর উপস্থিত ছিলেন।
গত জুলাই-আগস্টে সরকার পতন আন্দোলনে প্রাণহানির ঘটনাকে ‘গণহত্যা’ বিবেচনা করে ট্রাইব্যুনালে বিচারের উদ্যোগ নিয়েছে মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার, যে আদালতটি ২০১০ সালে আওয়ামী লীগ সরকার আমলে স্থাপন করা হয় মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য।
গণ আন্দোলনে সরকার পতনের পর ট্রাইব্যুনালে ব্যাপক রদবদল করা হয়েছে। বিচারক পাল্টানো হয়েছে, তদন্ত সংস্থাতেও এসেছে নতুন মুখ। সংশোধন করা হয়েছে আইনও।
'গণহত্যা': দলের বিচারের বিধান রাখেনি সরকার
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ান
প্রসিকিউটর তামিম দাবি করেন, ‘ন্যায়বিচারের’ স্বার্থে ‘আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে’ এই সংশোধনীগুলো করা হয়েছে।
“এই আইনে ‘ডিফেন্স কাউন্সেলের’ জন্য কোনো সেকশন ছিল না, এখন ডিফেন্স রাইটসের ব্যাপারে সেকশন করা হয়েছে। সেকশন ১৭ তে আগে আসামিরা ‘স্টেটমেন্ট’ দেওয়ার সুযোগ পেত, এখন আরও বিষদ আকারে তাদের কথাগুলো বলতে পারবেন।
“আগে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থেকে এ আইনের অপরাধ করলে তার বিচার করা যেত; এখন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কিংবা বিদেশে থেকেও এ আইনের অপরাধ করলে তার বিচার করা যাবে। আবার বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থেকে যদি কোনো বিদেশিও এ অপরাধ করে থাকে তার বিচার করা যাবে।”
আগে আইনে ‘নির্যাতন’, ‘অপহরণে’ ও ‘বন্দি’ ছিল; আন্তর্জাতিক আইনে এটা ‘জোরপূর্বক গুম’, এটাও সংযোজন করা হয়েছে বলেও জানান তামিম।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আরও তিন অভিযোগ
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠনে প্রজ্ঞাপন
আপিলের বিষয়ে তিনি বলেন, “এ ট্রাইব্যুনালের অন্তর্বর্তী আদেশের বিরুদ্ধে, যেমন আদালত অবমাননার ক্ষেত্রে কেউ চাইলে আপিল বিভাগে যেতে পারবে।”
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে মামলার বিষয়ে তিনি বলেন, “আগে আইনে ছিল ‘সশস্ত্র বাহিনীর’ কথা, এখন বলা হয়েছে ‘শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য’; এর মধ্যে রয়েছে তিন বাহিনী, সাথে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি এবং যে কোনো গোয়েন্দা সংস্থাসহ আনসার বাহিনীকেও এর সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে।”
কোন কোন ধারার কারণে এটিকে আন্তর্জাতিক মানের বলা হচ্ছে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “সেকশন ২, ৪, ১২, ১৭, ২০, এই ধারাগুলোর কারণে।
“সেকশন ১২ তে ডিফেন্স কাউন্সেলকে অধিকার দেওয়া হয়েছে, সেকশন ১৭ তে অভিযুক্তদের অধিকার দেওয়া হয়েছে। সেকশন ৯ এ শুনানির ব্যাপারে আসামিদের আগে তিন সপ্তাহ সময় দেওয়া হত, এখন ছয় সপ্তাহ সময় দেওয়া হয়েছে।
“আগে অনুমতি নিয়ে সীমিত নথি দিতে পারত, এখন ডিফেন্স চাইলে অনুমতি নিয়ে যে কোনো সময় নথিপত্র জমা দিতে পারবে।”
অভিযোগ গঠন শুনানি প্রসঙ্গে তামিম বলেন, “আগে অভিযোগ শুনানির সময় সাক্ষীদের নাম দিতে হত, এখন ডিফেন্স চাইলে বিচারের যে কোনো সময় সাক্ষীর নাম দিতে পারবে।“
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধনের অধ্যাদেশ জারি
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম
১৯৭১ সালের মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় করা মামলাগুলো নিয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, “এই সংশোধনী ২০০৯ সাল থেকে কার্যকর বলে ধরা হবে।”
আরেক প্রসিকিউটর বি এম সুলতান মাহমুদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, কয়েকটি ধারায় সংশোধন, প্রতিস্থাপন ও সংযোজন করা হয়েছে।
# ধারা ১ -এ আগে এখতিয়ার ছিল শুধু বাংলাদেশে। এখন এখতিয়ার বাংলাদেশের বাইরেও রয়েছে।
# ধারা ২ এর ‘ক্লজ এএ’ এর বদলে নতুন রূপে ‘শৃঙ্খলা বাহিনী’ বলতে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী, পুলিশ র্যাব, বিজিবি, কোস্ট গার্ড আনসার বা আইনের দ্বারা সৃষ্ট অন্য কোনো ফোর্সকে বুঝাবে।
# ধারা ৩(২) এর ‘ক্লজ এ’ তে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বলতে নতুন কিছু যোগ হয়েছে; যেমন- কোনো জনগোষ্ঠীকে জোরপূর্বক স্থানান্তর, যৌন নিপীড়ন, জোরপূর্বক গুম, মানবপাচার, যৌন দাসত্ব, যৌনব্যবসায় নামতে বাধ্য করা, জোরপূর্বক সন্তানধারণ ও জোরপূর্বক নির্বীজন বা খোঁজাকরণ।
# গণহত্যার অর্থ থেকে ‘রাজনৈতিক গোষ্ঠী’ বাদ গেছে। এই ধারার ২ এর (জি) তে ‘উসকানি’ শব্দটি যুক্ত হয়েছে।
# ধারা ৪ এ ‘অপরাধের দায়’ এর বিস্তৃত ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
# নতুন ধারা ৯এ যুক্ত করা হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল ইচ্ছা করলে অডিও ভিজ্যুয়াল শুনানির ব্যবস্থা করতে পারবেন।
# নতুন ধারা ১০বি যুক্ত হয়েছে। সেখানে বিদেশি পর্যবেক্ষকদের থাকার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
# ধারা ১১ এর নতুন উপধারা ৭ ও ৮ সৃষ্টি করা হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে অনিবার্য পরিস্থিতিতে ট্রাইব্যুনাল সন্তুষ্ট হলে ক্ষতিগ্রস্ত এবং সাক্ষীদের ভার্চুয়াল হেয়ারিং নিতে পারবেন।
# ধারা ১৯(১) এর পরিবর্তে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা হয়েছে। সেখানে অডিও, ভিডিও, ডিভিডি, সিসিটিভি, হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যার অথবা অন্য কোনো ডিজিটাল ডিভাইস সম্পর্কে বলা হয়েছে, যেগুলো ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করা যাবে।
# ধারা ২১ অন্তর্বর্তী আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবে শুধু ট্রাইব্যুনাল অবমাননার শাস্তির বিরুদ্ধে। আপিল বিভাগে আবেদন আটকে থাকলে ট্রাইব্যুনাল মামলা চালিয়ে যাবে, সে কথাও বলা হয়েছে।