“উদাহরণ দিয়ে যদি বলি, কালকে যদি খোদা নাখাস্তা রাষ্ট্রপতি মারা যান বা অসুস্থ হয়ে পড়েন, তাহলে রাষ্ট্র পরিচালনা করবে কে!”
Published : 03 Sep 2024, 01:01 AM
ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনে সরকার পতনের ২৭ দিনের মাথায় নজিরবিহীন এক পরিস্থিতির মধ্যে জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর পদত্যাগ কিছু সাংবিধানিক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
সংসদীয় গণতন্ত্রের নিয়মে স্পিকার হলেন রাষ্ট্রের তৃতীয় সর্বোচ্চ পদাধিকারী। সংসদ ভেঙে দিলেও তার পদ যায় না। পদত্যাগ করলেও নতুন স্পিকার দায়িত্ব না নেওয়া পর্যন্ত তিনি পদে আছেন বলে ধরে নিতে হয়।
পরবর্তী সংসদের সদস্যদের শপথ পড়ানোর ভার তার ওপরই বর্তায়। এমনকি রাষ্ট্রপতির অবর্তমানে স্পিকারকেই রাষ্ট্রপ্রধানের ভার নিতে হয়।
এখন, সেই স্পিকার যখন পদত্যাগ করলেন, কোনো সাংবিধানিক শূন্যতা কী তৈরি হল?
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না বলছেন, “এক ধরনের শূন্যতাতো তৈরি হয়েছেই। কেন পদত্যাগ করলেন, এটা গ্রহণই বা কেন করলেন। আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।
“উদাহরণ দিয়ে যদি বলি, কালকে যদি খোদা নাখাস্তা রাষ্ট্রপতি মারা যান বা অসুস্থ হয়ে পড়েন, তাহলে রাষ্ট্র পরিচালনা করবে কে!”
বিগত সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৫ অগাস্ট গণ আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়লে আওয়ামী লীগের টানা ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। পরদিন সংসদ ভেঙে দেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন।
সরকার পতনের পর আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের প্রায় সবাই আত্মগোপনে চলে যান। সাবেক মন্ত্রী-এমপিদের কেউ কেউ গ্রেপ্তার হন। তবে শিরীন শারমিন চৌধুরী আর প্রকাশ্যে আসেননি। ৮ অগাস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের শপথ অনুষ্ঠানেও তিনি যাননি।
পরবর্তী নির্বাচন কবে হবে, তার কোনো সময়সূচি অন্তর্বর্তী সরকার দেয়নি। এরমধ্যেই সোমবার স্পিকারের পদত্যাগের খবর আসে।
বঙ্গভবন থেকে বলা হয়, স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের কাছে পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছেন। পরে সরকারের তরফ থেকে প্রজ্ঞাপন জারি কর বলা হয়, তার পদত্যাগপত্রটি রাষ্ট্রপতি গ্রহণ করেছেন। সোমবার থেকেই তার পদত্যাগ কার্যকর হয়েছে।
সংবিধানের ৭৪ (২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে–
স্পিকারের পদ পাঁচ কারণে শূন্য হতে পারে, যদি
(ক) তিনি সংসদ-সদস্য না থাকেন;
(খ) তিনি মন্ত্রী-পদ গ্রহণ করেন;
(গ) তার অপসারণ দাবি করে সংসদে আনা কোনো প্রস্তাব সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে পাস হয়।
(ঘ) তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে স্বাক্ষরযুক্ত পত্রযোগে পদত্যাগ করেন;
(ঙ) কোনো সাধারণ নির্বাচনের পর অন্য কোনো সদস্য তার কার্যভার গ্রহণ করেন।
গত ৬ অগাস্ট রাষ্ট্রপতি যখন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ ভেঙে দিলেন, স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর এমপি পদও শূন্য হয়ে গেছে। তাহলে ৭৪ (২) অনুচ্ছেদের ‘ক’ দফা অনুযায়ী তখনই কি তার স্পিকার পদ শূন্য হয়ে গিয়েছিল?
জেড আই খান পান্না বলছেন, এক্ষেত্রে তেমন কিছু ঘটেনি।
“পার্লামেন্ট না বসা পর্যন্ত তিনি স্পিকার আছেন। আমাদের কনস্টিটিউশনটা রিটেন। আনরিটেনের কনস্টিটিউশনের কিছু অংশ থাকে রিটেন। আবার রিটেন কনস্টিটিউশনের কিছু বিষয় থাকে কনভেনশন। সেটা হচ্ছে, পরবর্তী পার্লামেন্ট না হওয়া পর্যন্ত স্পিকার থাকবেন।”
১৯৯১ সালে রাষ্ট্রপতিশাসিত এরশাদ সরকারের স্পিকারের কাছ থেকে সংসদীয় সরকারের স্পিকারের দায়িত্ব গ্রহণের উদাহরণ টেনে এই আইনজীবী বলেন, “এই যে, নব্বইয়ে এত বড় আন্দোলন হয়েছে, স্পিকারের বাসার ধারেকাছেও কেউ যায় নাই। পুলিশও যায় নাই, কেউ যায় নাই, গার্ড সবাই ছিল। আমি ঠিক বিষয়টা বুঝলাম না। কেন করলেন?”
জেড আই খান পান্না বলেন, “তার পদত্যাগের ফলে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নাই। এবং এ ধরনের শূন্যতার দৃষ্টান্ত এই প্রথম। সম্ভবত, উপমহাদেশে এই প্রথম।”
এখন এই শূন্যতা পূরণের উপায় কী? এর কোনো উত্তর আপাতত আইন বিশেষজ্ঞ পান্নার কাছে নেই।
তিনি বলছেন, “রাষ্ট্রের কর্ণধার যারা, রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে যারা আছেন, তাদের কাছে হয়ত উপায় আছে। গেজেটও যদি হয়ে যায়, মেটাবে কীভাবে? নিশ্চয় তাদের কোনো পরিকল্পনা আছে, আমরা সেটা ভবিষ্যতে দেখতে পাব।”
সংবিধানের ৭৪(৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, স্পিকারের পদ শূন্য হলে বা তিনি দায়িত্বপালনে অসমর্থ বলে সংসদ নির্ধারণ করলে তার সব দায়িত্ব পালন করবেন ডেপুটি স্পিকার।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদে ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক (টুকু) গত ১৫ আগস্ট গ্রেপ্তার হয়েছেন। একটি হত্যা মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে পুলিশ রিমান্ডেও পাঠিয়েছে আদালত।
সংবিধানের ৭৪(৩) অনুচ্ছেদ বলছে, ডেপুটি স্পিকারের পদও যদি শূন্য হয়, তাহলে সংসদের কার্যপ্রণালী-বিধি-অনুযায়ী কোনো সংসদ-সদস্য তা পালন করবেন। কিন্তু এখন তো সংসদই ভেঙে দেওয়া হয়েছে।
৭৪(৬) অনুচ্ছেদ বলা হয়েছে, এই অনুচ্ছেদের (২) দফার বিধানাবলি সত্ত্বেও ক্ষেত্রমত স্পিকার বা ডেপুটি স্পিকার তার উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত স্বীয় পদে বহাল রয়েছেন বলিয়া গণ্য হবে।
অবশ্য প্রধানমন্ত্রীও তার উত্তরাধিকার কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করে যাবেন বলে সংবিধানে ৫৭(৩) অনুচ্ছেদে বলা আছে।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক বোরহান উদ্দিন খান বলেন, “যতক্ষণ পর্যন্ত নতুন স্পিকার দায়িত্ব গ্রহণ না করবেন, ততক্ষণ ডেপুটি স্পিকার দায়িত্ব পালন করবেন। তিনি জেলে আছেন ঠিক, কিন্তু তিনিতো কেবল অভিযুক্ত এখনও।
“উনি জেলে থাকলেতো সমস্যা নাই। পরবর্তী স্পিকার যিনি আসবেন, তার কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করবেন।”
সংবিধানের ৫৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হলে কিংবা অনুপস্থিতি, অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে রাষ্ট্রপতি দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হলে ক্ষেত্রমত রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত কিংবা রাষ্ট্রপতি পুনরায় স্বীয় কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত স্পিকার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন।
স্পিকার পদত্যাগ করেছেন, তা গৃহিতও হয়েছে; ডেপুটি স্পিকার জেলে। এমন পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতির অনুপস্থিতিতে কে দায়িত্ব পালন করবেন?
অধ্যাপক বোরহান উদ্দিন বলেন, “এই মুহূর্তে শূন্যতা নাই। রাষ্ট্রপতি যখন থাকবেন না, তখন শূন্যতা আসবে।
“শূন্যতা তৈরি হলে সেক্ষেত্রে সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের মতামত চাইতে হবে। যেভাবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের সময় তাদের মতামত নেওয়া হয়েছিল।”
২০০৯ সালে সংরক্ষিত নারী আসনের সদস্য হিসাবে জাতীয় সংসদে আসেন শিরীন শারমিন। তাকে দেওয়া হয় মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব।
নবম সংসদের শেষ দিকে রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের মৃত্যুর পর সেই জায়গায় আসেন তখনকার স্পিকার আবদুল হামিদ। এরপর ২০১৩ সালে ৩০ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রথম নারী স্পিকার নির্বাচিত হন শিরীন শারমিন। তারপর থেকে তিন মেয়াদে তিনিই টানা স্পিকারের চেয়ারে ছিলেন।
বিগত সরকারের অনেক মন্ত্রী-এমপির মত স্পিকারের বিরুদ্ধেও অন্তত একটি মামলা হয়েছে। রংপুরে গয়নার কারিগর মুসলিম উদ্দিন গুলিতে নিহতের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় ২৭ অগাস্ট একটি মামলা হয়েছে, সেখানে শিরীন শারমিন চৌধুরীও আসামি।
আওয়ামী লীগের হোমরা চোমরা কয়েকজনসহ কয়েকশ মানুষ ৫ অগাস্ট সরকার পতনের পর প্রাণভয়ে সেনাবাহিনীর কাছে আশ্রয় নিয়েছিল। তাদের মধ্যে কয়েকজনকে পরে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে অনেকে নিজে থেকে চলে যান।
এখনও অন্তত দুজন এবং তাদের পরিবার সেনা হেফাজতে রয়েছে বলে এর আগে নিশ্চিত করেছিল আইএসপিআর। তাদের মধ্যে একজন শিরীন শারমিন চৌধুরী বলে গুঞ্জন রয়েছেন। তবে সেনাবাহিনীর তরফ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের নাম প্রকাশ করা হয়নি।