এক দিকে ভুগিয়েছে ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকদের আন্দোলন, অন্যদিকে প্যাডেলচালিত রিকশাচালকরাও সুযোগ বুঝে বাড়িয়ে দিয়েছেন ভাড়া।
Published : 22 Nov 2024, 12:42 AM
অন্য সাধারণ দিনের মত বৃহস্পতিবারও যাত্রাবাড়ী মোড় থেকে মতিঝিলে যাওয়ার রিকশা পেতে অনেকটা বেগ পেতে হয় শিক্ষার্থী নুসরাত জাহানকে।
মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী নুসরাত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সব সময় ৮০-১০০ টাকা ভাড়াতেই পাওয়া যায় রিকশা। কখনো ব্যাটারি রিকশা নিই, আবার সময় থাকলে প্যাডেল রিকশা নিই। যাকে পাওয়া যায়-সেটাতেই যাই। আজ প্যাডেল রিকশা দেড়শ টাকা চচ্ছে। শেষমেষ ১৩০ টাকায় একজন রাজি হলেন।’’
নুসরাতের মত অনেক শিক্ষার্থী এবং অফিসগামী যাত্রীদের প্রতিদিনের সকালের বাহন রিকশা। কিন্তু বৃহস্পতিবার তাদের যেমন বাড়তি ভাড়া গুনতে হয়েছে, তেমনি রিকশা পেতেও পোহাতে হয়েছে ভোগান্তি। কারণ ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধে আদালতের আদেশ এবং রিকশাচালকদের আন্দোলন।
স্কুল পড়ুয়া ১২ বছরের ছেলেকে নিয়ে ভিড় ঠেলে বাসে উঠতে ঝামেলা হয় বলে রিকশাকেই নিরাপদ মনে করেন গৃহিনী আমেনা খাতুন। সায়েদাবাদ থেকে রিকশা নিয়ে মানিকনগর হয়ে মতিঝিলে যান ৭০-৮০ টাকায়। কখনো ৬০ টাকাতেও রিকশা পাওয়া যায়।
কিন্তু বৃহস্পতিবার বেশি ভাড়া গুনতে হয়েছে জানিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আজকে একটু ভাড়া বেশি। পড়ে শুনলাম ব্যাটারি চালিত রিকশা বন্ধ। ব্যাটারি রিকশা বন্ধ হওয়ায় নিরাপদ মনে করছি। একদিন বড় ধরনের দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে গেছিলাম। তারপর তওবা করেছি।’’
সেই থেকে সন্তান ও নিজের নিরাপত্তার জন্য প্যাডেল চালিত রিকশায় চলাচল করেন আমেনা খাতুন।
ঢাকায় ব্যাটারি চালিত রিকশা চলাচল বন্ধ করতে উচ্চ আদালতের নির্দেশের পর বুধবার থেকেই আন্দোলনে নেমেছেন চালকরা। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে সেই আন্দোলনের বিস্তৃতি আরো বাড়ে, বিভিন্ন জায়গায় তাদের সড়ক অবরোধে বাড়ে যানজটের বিড়ম্বনা।
বুধবার মহাখালী ও মিরপুর ১০ নম্বরে কিছু চালক প্রতিবাদে নামলে পুলিশ ও সেনাবাহিনী তাদের সরিয়ে দিয়েছিল। বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই মহাখালী, সায়দাবাদ, যাত্রাবাড়ীসহ বিভিন্ন এলাকায় রিকশা চালকদের অবরোধ শুরু হয়।
মহাখালী এলাকায় সবচেয়ে বড় জটলা করে ট্রেন চলাচলও বন্ধ করে দেয় বিক্ষোভকারীরা। আন্দোলনকারীরা চলে গেলে বিকাল ৪টার পর স্বাভাবিক হয় ঢাকার ট্রেন চলাচল।
মহাসড়কের কয়েক জায়গা বন্ধ করলে পুরো রাজধানী জুড়ে তীব্র যানজট তৈরি হয়। ঢাকায় প্রবেশ করতে দুর্ভোগের মধ্যে পড়ে রোগী পরিবহনকারী অ্যাম্বুলেন্সও।
অফিসগামী ও বিভিন্ন প্রয়োজনে চলাচলকারী যাত্রীদের কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। দিনের পরিকল্পনা বাদ দিতে হয় অনেকের। অবশ্য ব্যাটারিচালিত রিকশা নিয়ে যাত্রীদের আছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
আদালতের এ সিদ্ধান্তকে ‘ইতিবাচক’ হিসেবে বর্ণনা করে ব্যাংকার আসিফ মাহমুদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তাদের তো কোনো ট্রেনিং নেই। ফাঁকা রাস্তায়ও হর্ন দিতে দিতে যায়। গতি কখন বাড়ে, কখন কমে বুঝা মুশকিল। মেইন রোডে তাদের বন্ধ রাখতে হবে।”
তবে এই রিকশাচালকদের রুটিরুজির কথাও যে ভাবতে হবে, সে কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “অনেকেই রিকশা কিনে চালাচ্ছেন। রিকশা না চালালে তারা খাবেন কী? তাই মফস্বল ও ঢাকার কম গুরুপূর্ণ গলি সড়কে তাদের চলতে দেওয়া যেতে পারে।’’
ব্যাটারিচালিত রিকশা ঢাকার অলিগলিতে চলাচল করছে বহুদিন ধরেই। জুলাই-অগাস্টের আন্দোলনের সময় থেকে মূল সড়কেও চলাচল বেড়েছে।
অভিযোগ আছে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে সমঝোতা করে এলাকাভিত্তিক বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা ব্যাটারি চালিত রিকশা চলাচল নিয়ন্ত্রণ করেন।
সড়ক বন্ধ থাকায় গণ পরিবহণ সংকটে পড়েন বাসাবো এলাকার ফরিদুল আলম। জরুরি কাজে মতিঝিল যেতে নিয়মিত বাহন লেগুনা না পেয়ে প্যাডেল রিকশায় যাওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এইটা কোনো কথা? আগে জানলে তো বাসা থেকে বের হতাম না। অবৈধ জিনিস বন্ধ করা হবে এটাই তো স্বাভাবিক। তারা প্রতিবাদ কেন করবে, রিকশা মালিকরা তো আদালতে যেতে পারেন। তাদের তো অনেক টাকা।’’
ঢাকা শহরের সিংহভাগ রিকশার মালিকানা থাকে বিভিন্ন গ্যারাজ ব্যবসায়ীদের। দৈনিক ১৫০ টাকা থেকে ২৫০ টাকায় এসব রিকশা ভাড়া দেন তারা।
সেই গ্যারাজ মালিকদের উদ্দেশে ফরিদুল আলম বলেন, “জনগণকে জিম্মি করে রাস্তা বন্ধ করা উচিত হবে না। আমাদের মত মানুষের কষ্ট কেন বুঝবে না? তারা তো আন্দোলন করে কোনো সমাধান পাবে না।”
কুমিল্লা দাউদকান্দি থেকে গাড়ি চালিয়ে ঢাকার প্রবেশমুখে চিটাগাং রোড মোড়ে পৌঁছে দীর্ঘ যানজটের কবলে পড়েন রনি সরকার।
চিটাগাং রোড মোড় থেকে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের কাজলা পয়েন্ট পর্যন্ত প্রায় ৬ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে ৪৫ মিনিট সময় লেগেছে জানিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “বিরক্ত হয়ে গাড়ি থেকে বের হয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়েছিলাম। এই রুটে মাঝে মাঝেই জ্যাম হয়।’’
কাজলা এসে তিনি জানতে পারেন, ব্যাটারিচালিত রিকশা চালকদের আন্দোলনে ঢাকার প্রবেশপথে দীর্ঘ এই যানজট।
ঢাকায় প্রবেশ পথে যানজটে গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকলেও ঢাকা থেকে বের হওয়ার দিকটি ছিল ফাঁকা। টোল প্লাজা পার হয়ে গাড়িগুলো দ্রুত গতিতে চলাচল করতে পেরেছে।
দীর্ঘ এই যানজটের কবলে পড়ে লক্ষ্মীপুর থেকে রোগী নিয়ে আসা একটি অ্যাম্বুলেন্স। সারা পথ কোনো মতে আগে যাওয়ার সুযোগ করে নিতে পারলেও একমুখী সড়ক কাজলা পয়েন্টে এসে বাহনটি আটকে যায়।
স্থানীয় এক তরুণের পরামর্শে পরে সড়কের ডিভাইডার সরিয়ে অ্যাম্বুলেন্স নেমে যায় পাশের সড়কে। ফ্লাইওভার ব্যবহার বাদ দিয়ে নিচের সড়ক দিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দিকে চলে যায়।
ব্যাটারি চালিত রিকশা মূল সড়কে না থাকায় প্যাডেলচালিত রিকশা দাপিয়ে বেড়িয়েছে পুরো শহর। অনেকে ভাড়াও বাড়িয়ে নিয়েছেন। ৩০ টাকার দূরত্বে ভাড়া নিয়েছেন কমপক্ষে ৫০ টাকা। স্বল্প দূরত্বে যেতেও রাজি হননি অনেক চালক।
মতিঝিল থেকে টিকাটুলি মোড় পর্যন্ত দূরত্ব যেতে স্বাভাবিক সময়ের ভাড়া ৩০ টাকা। স্বল্প এ দূরত্বে বেশি ভাড়া দিয়েও কোনো রিকশা না পেয়ে হেঁটেই চলে যান মতিঝিল কাজে আসা আসলামুল হক।
বেলা ১২টায় রিকশা নিয়ে বেরিয়ে বেলা ৩টার মধ্যে ৪০০ টাকা আয় করতে পেরেছেন প্যাডেলচালিত রিকশা চালক আইয়ুব আলী। তিনি জানালেন, স্বাভাবিক সময়ে ওই সময়ে তার আয় হত ২০০ থেকে ২৫০ টাকা।