“সেই চোরতন্ত্রে কারা কারা এই মহাচুরিতে জড়িত ছিল এটা বাংলাদেশের মানুষ জানতে চায়। তাদেরকে জানানোটা আমাদের একটা নৈতিক দায়িত্ব,” বলেন তিনি।
Published : 24 Dec 2024, 09:10 PM
ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের ‘দুর্নীতির’ তদন্তকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের তালিকার রেখেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
এরইমধ্যে এ নিয়ে কাজ শুরুর তথ্য তুলে ধরে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, “শেখ হাসিনার দুর্নীতির বিষয়টি নিয়ে আমাদের কাজগুলো শুরু হয়েছে। আরও বিস্তারিত কার্যক্রম জানতে পারবেন। এটা আমাদের টপ প্রায়োরিটি।”
মঙ্গলবার ফরেন সার্ভিস অ্যাকাডেমিতে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের পর প্রেস ব্রিফিংয়ে এক প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন তিনি।
বিফ্রিংয়ে শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে ’দুর্নীতির’ বিষয়ে কতটুকু তথ্য আপনারা জানতে পেরেছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে শফিকুল আলম বলেন, ''শেখ হাসিনার বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের একটি সামারি প্রতিবেদন গণমাধ্যমকে সরবরাহ করা হয়েছে। এটা নিয়ে আমাদের কাজগুলো শুরু হয়েছে।”
তিনি বলেন, ”উনি একটা চোরতন্ত্র এখানে জারি করেছিলেন। সেই চোরতন্ত্রে কারা কারা এই মহাচুরিতে জড়িত ছিল এটা বাংলাদেশের মানুষ জানতে চায়। তাদেরকে জানানোটা আমাদের একটা নৈতিক দায়িত্ব।''
প্রবল গণ আন্দোলনের মুখে ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা, তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, বোন শেখ রেহানা ও তার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে আগের সরকারের দুটি অগ্রাধিকার প্রকল্পে মোট ৮০ হাজার কোটি টাকার ‘দুর্নীতির’ অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক।
তাদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সরকারের বিশেষ অগ্রাধিকারের আট প্রকল্পে ২১ হাজার কোটি টাকার ‘দুর্নীতি’ এবং রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পে ৫৯ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান করবে কমিশন।
গত ১৭ ডিসেম্বর এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা জানানোর পরদিন এ দুই অভিযোগ অনুসন্ধানে দুদকের উপপরিচালক মো. সালাহউদ্দিনকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের একটি অনুসন্ধান দল গঠন করা হয়।
এরপর গত রোববার শেখ হাসিনা এবং তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিরুদ্ধে ৩০ কোটি ডলার পাচারের আরেকটি অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। এ অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য দল গঠনের বিষয়ে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলেনি দুদক।
অপরদিকে মঙ্গলবার আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বিশেষ অগ্রাধিকারের আট প্রকল্পে হাসিনাসহ অন্যদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানে নথি চেয়ে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরে চিঠি পাঠিয়েছে দুদক।
এমন প্রেক্ষাপটে প্রেস বিফ্রিংয়ে শেখ হাসিনার ’দুর্নীতি’ বিষয়ক প্রশ্নে প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, “উনি কী পরিমাণ চুরি করেছেন, সামনে সেটা অবশ্যই আপনারা জানতে পারবেন। কী পরিমাণ অর্থ বাংলাদেশ থেকে চলে গেছে, তার একটা ধারণা শ্বেতপত্র দিয়েছে। ১৬ বিলিয়ন ডলার প্রতি বছর পাচার হয়েছে। এটা বাংলাদেশের মানুষের টাকা।
”আর ব্যাংকগুলো কীভাবে ডাকাতি হয়েছে আপনারা তো দেখেছেন। আমরা গুরুত্বের সাথে এটা তদন্ত করছি। তার সময়ে যত ধরনের চুরি হয়েছে। লুণ্ঠনতন্ত্র, চোরতন্ত্র কীভাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন…। ইতোমধ্যে একটা রিপোর্ট এসেছে তার পিয়ন যেটা আগে উনি সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন ৪০০ কোটি টাকা। পরে আমরা দেখেছি সেখান ট্রানজেকশন হয়েছে ৬২৮ কোটি টাকা।''
’যত দ্রুত সম্ভব হাসিনার প্রত্যাবর্তন হবে’
বিফ্রিংয়ে শেখ হাসিনাকে কবে নাগাদ ফেরত আনা সম্ভব হবে, এমন প্রশ্নে প্রেস সচিব বলেন, ''আমাদের দিক থেকে লিগ্যাল প্রসেস খুব জোরেশোরে শুরু করছি। আইনের শাসন মানতে হলে তাকে তার সময়টা দিতে হবে। চাইলেও অনেক কিছু খুব দ্রুত আপনি করতে পারবেন না। বাংলাদেশের বিদ্যমান আইনি ব্যবস্থার মধ্যে যতটা দ্রুত সম্ভব সেই অনুযায়ী আমরা কাজ করছি।
”আমরা বার বার বলছি শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তন চাই। সেই অনুযায়ী পররাষ্ট্র উপদেষ্টা কথা বলেছেন। আশা করব যত দ্রুত সম্ভব তার প্রত্যাবর্তন হবে। শেখ হাসিনা বিচারের মুখোমুখি হবেন।''
শেখ হাসিনার অপরাধগুলোকে ‘ভয়াবহ’ হিসেবে বর্ণনা করে তিনি বলেন, “গত ১৫ বছরে বাংলাদেশে যে ধরনের অপরাধগুলো হয়েছে এটা তো চিন্তা করা যায় না। পুরো পৃথিবী হঠাৎ করে ঘুম থেকে উঠে দেখছেন তার ক্রাইমটা কী ছিল।”
শফিকুল আলমের ভাষ্য, ”প্রায় সাড়ে তিন হাজার লোক গুম হয়েছে। বিচারবহির্ভূত হত্যা হয়েছে কয়েক হাজার লোক। জুলাই আগস্টে মারা গেছেন প্রায় ১৫-শ জনের মত লোক। কত ভয়ানক একটা বিষয়। মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে। এটা আঁৎকে ওঠার মত।''
’সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশে বিতর্কিত সব ধারা বাদ’
এদিনের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে আলোচিত ও বিতর্কিত সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ ২০২৪ এর খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়ার কথা তুলে ধরেন প্রেস সচিব শফিুকল আলম।
এর আগে গত ৭ নভেম্বর আওয়ামী লীগ আমলে প্রণীত এ আইন বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়। ওই আইন বাতিল করে নতুন এই অধ্যাদেশ জারি করা হচ্ছে।
নতুন হতে যাওয়া সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশে আগের আইনের বিতর্কিত সব ধারা বাদ দেওয়ার কথা তুলে ধরে প্রেস সচিব শফিকুল বলেন, “এই আইন আমাদের গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে সুরক্ষা দেবে। নতুন আইনে কোনোভাবেই গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে সংকুচিত করবে না।”
তিনি বলেন, ''বিতর্কিত হওয়ার কারণে সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল করা হয়েছে। পতিত স্বৈরচার শেখ হাসিনা এটাকে ব্যবহার করেছিল ভিন্নমত দমন তথা মানুষের মুখ বন্ধ করার জন্য। দেশে ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি কেউ যেন তার মতামত স্বাধীনভাবে প্রকাশ করতে না পারে। সেটাকে পরিবর্তন করে সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ অনুমোদন দেয়া হয়েছে।''
নতুন আইনের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ''এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে আমরা সাইবার স্পেসকে সবার জন্য নিরাপদ করতে চাই। আপনারা জানেন সাইবার স্পেসে অনেক ধরনের অপরাধ হয়। অনেকে প্রতারিত হন। মা বোন ও শিশুরা অনেক ধরনের বুলিংয়ের শিকার হন। সাইবার স্পেসে সুরক্ষা দেওয়া সরকারের একটি দায়িত্ব। এবিষয়টি বিবেচনা করে আইনটি প্রণয়ন করা হয়েছে।''
সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কতটা নিশ্চিত হবে এমন প্রশ্নের জবাবে প্রেস সচিব বলেন, ''গত সাড়ে চার মাসে এই সরকারের চরিত্র আপনারা দেখেছেন। কোন ধরনের মত প্রকাশের স্বাধীনতা বা গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় সামান্যতম প্রভাবিত করেছি? আমার মনে হয় না এ বিষয়ে কোনো এভিডেন্স আছে।
”আপনারা নিশ্চিত থাকেন-সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশের মাধ্যমে সব মানুষের সাইবার স্পেসও যেমন সুরক্ষিত হবে, একই সাথে এটা আমাদের গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে সুরক্ষা দেবে। এটা কোনভাবেই গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে সংকুচিত করবে না। এই বিষয়ে নিশ্চিত থাকতে পারেন।''
অনেক সংবাদমাধ্যম অফিসে গিয়ে ’বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের তালিকা দিয়ে সাংবাদিকদের বাদ দেওয়া’ বিষয়ক এক প্রশ্নে শফিকুল বলেন, “আমি আমার সরকারের কথা বলতে পারি। বেসরকারি নাগরিক কে কী বলছেন সেটা আমরা বলতে পারি না। আমরা তো সমন্বয়কদের সরকার নই। এটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। আমি আমার সরকারের কথা বলছি। আমার সরকারের কেউ যদি এ ধরনের কিছু করে থাকে সেটা বলেন।
”সরকারের বাইরে কে কী করলো সেটা বিএনপি হোক, আওয়ামী লীগ হোক বা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র- যেই হোক তার দায় দায়িত্ব তো আমার নয়। এটা উনাদের প্রশ্নটা করেন।”
ফেইসবুক পোস্ট উপদেষ্টা মাহফুজের ’ব্যক্তিগত মতামত’
এক প্রশ্নের জবাবে উপ প্রেস সচিব অপূর্ব জাহাঙ্গীর বলেন, “উপদেষ্টা মাহফুজ আলম যে ফেইসবুক স্ট্যাটাস দিয়েছেন সেটা একদমই উনার ব্যক্তিগত মতামত। পরে কিন্তু তিনি সেটা মুছে ফেলে আরেকটি স্ট্যাটাস দিয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। সেখানে তার জবাব পাওয়া যাবে। এটা নিয়ে ভারত তার প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে। ভারত একটা স্বাধীন দেশ। আমরা বলছি এটা মাহফুজের ব্যক্তিগত মতামত।”
আরও পড়ুন
শেখ হাসিনার 'দুর্নীতি' অনুসন্ধানে নথি চেয়েছে দুদক
হাসিনা, রেহানা, জয়, টিউলিপের 'দুর্নীতি' অনুসন্ধানে দুদকের ৫ কর্মকর্তা
হাসিনা ও জয়ের বিরুদ্ধে ৩০ কোটি ডলার পাচারের অভিযোগ, অনুসন্ধান করব
শেখ হাসিনাকে ফেরানো: ঢাকার সামনে এখন কী
শেখ হাসিনাকে ফেরাতে ভারতকে চিঠি বাংলাদেশের
শেখ হাসিনাকে ফেরাতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি স্বরাষ্ট্রের