১৪ দলের শরিকদের ছেড়ে দেওয়া ছয়টি আসনের চারটিতেই স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া আওয়ামী লীগ নেতাদের অবস্থান শক্তিশালী। একটি আসনে জোটের প্রার্থীর পক্ষে থাকতে চান না আওয়ামী লীগ নেতারা।
Published : 19 Dec 2023, 12:33 AM
আওয়ামী লীগের কাছ থেকে ছাড় পেয়ে নৌকা নিয়ে ভোটের লড়াইয়ে নামতে যাওয়া রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনুরা নিজেদের নির্বাচনি এলাকায় খুব সুখকর অবস্থানে নেই।
শরিকদের যে ছয়টি আসন ছাড়া হয়েছে, তার মধ্যে পাঁচটিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া আওয়ামী লীগ নেতারা জোটের প্রার্থীদের চ্যালেঞ্জ করতে যাচ্ছেন।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের সমর্থন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই স্বতন্ত্র প্রার্থীর প্রতি। সে কারণে নৌকার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দিতা থেকে রেহাই মিললেও কোথাও জাসদ বনাম আওয়ামী লীগ, কোথাও ওয়ার্কার্স পার্টি বনাম আওয়ামী লীগ, কোথাও জেপি বনাম আওয়ামী লীগের লড়াইয়ের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছে।
২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচন থেকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট করার পর এই প্রথম শরিকরা এমন প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পড়ল।
শরিক দলের নেতাদেরকে আওয়ামী লীগ যেসব আসনে ছাড় দিয়েছে, তাদের মধ্যে পিরোজপুর-২ আসনে একক শক্তিতে আনোয়ার হোসেন মঞ্জুই কেবল বারবার জিতে আসতে পেরেছেন। তবে নির্বাচনি আসন পুনর্গঠিত হওয়ায় তিনি এবার পড়েছেন কঠিন চ্যালেঞ্জে।
বাকি নেতাদের মধ্যে কুষ্টিয়া সদর আসনে ইনু এবং রাজশাহী-২ আসনে ফজলে হোসেন বাদশা অতীতের নির্বাচনে এককভাবে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভোট পেয়েছিলেন। মেনন ১৯৯১ সালে এককভাবে জিতলেও এর পরে কখনো প্রতিদ্বন্দ্বিতাতেই আসতে পারেননি। ফলে আওয়ামী লীগের সমর্থন না পেলে নির্বাচনি বৈতরণী পার হওয়া তাদের কঠিন হবে।
২০০৮ সাল থেকে আওয়ামী লীগের জোটের অংশ হয়ে তারা সহজে সংসদে আসতে পেরেছেন। এই তিন নেতার পাশাপাশি প্রয়াত মইনউদ্দীন খান বাদল, শিরীন আখতার, রেজাউল করিম তানসেন ও মুস্তফা লুৎফুল্লাহ নিজেদেরকে ভাগ্যবান ভাবতে পারেন। কারণ, একক শক্তিতে এরা কখনো ভালো ভোট পাননি।
এদের মধ্যে দুটি নির্বাচনে শিরীন ও লুৎফুল্লাহকে ছাড় দিলেও এবার তাদেরকে সমর্থন দেয়নি আওয়ামী লীগ। সাতক্ষীরা-১ আসনে লুৎফুল্লাহ বরং আরও বেশি হতাশ। কারণ, তাকে প্রথমে ছাড় দেওয়ার কথা জানানো হয়েছিল।
গত ৪ ডিসেম্বর থেকে ধারাবাহিক আলোচনার পর ১৪ ডিসেম্বর ১৪ দলের শরিকদেরকে সাতটি আসন দেওয়ার কথা জানায় আওয়ামী লীগ। শরিকরা আরও বেশি আসন দাবি করে। তবে কিন্তু মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিনে আওয়ামী লীগ শরিকদেরকে আসন দেয় ছয়টি।
শরিক দলগুলোর মধ্যে হাসানুল হক ইনু তার অসন্তোষ গোপন রাখেননি। আওয়ামী লীগকে উদ্দেশ করে তিনি বলেছেন, “বিপদে ঐক্য, বিপদ কেটে গেছে মনে করে আত্মপ্রসাদে ভুগে ঐক্যকে অবহেলা করা আত্মঘাতী।”
রাজশাহীতে ফজলে হোসেন বাদশা আগে স্বস্তিতে থাকলেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া আওয়ামী লীগ নেতা হাই কোর্ট থেকে প্রার্থিতা ফিরে পাওয়ায় পরিস্থিতি কী হয়, তা বলা কঠিন। কারণ সেখানে আওয়ামী লীগ প্রকাশ্যেই তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।
আলোচনায় না থেকেও লক্ষ্মীপুর-৪ আসন পেয়ে যাওয়া জাসদের মোশাররফ হোসেনও আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীর চ্যালেঞ্জে পড়তে যাচ্ছেন।
সেই দিক দিয়ে বগুড়া-৪ আসনে জাসদের রেজাউল করিম তানসেন ফুরফুরে মেজাজে আছেন।
একক শক্তিতে জাসদের সেখানে লড়াই করার মত শক্তি না থাকলেও তানসেন দুইবার সংসদে গেছেন। আওয়ামী লীগের সমর্থনে আরও দুটি নির্বাচনে নৌকা নিয়ে লড়াই করেছেন।
আসন নিয়ে টানাটানির পর কী অবস্থায় মেনন
২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচন থেকে মেনন নৌকা নিয়ে পাস করে এসেছেন ঢাকা-৮ আসনে। এবার সেখানে আওয়ামী লীগ প্রার্থী দেওয়ার পর মেনন চলে যান নিজের এলাকা বরিশালে।
কোথায় নির্বাচন করবেন- সেটি শুরু থেকেই ছিল অনিশ্চিত। তাই তিনি মনোনয়নপত্র জমা দেন বরিশাল-২ ও বরিশাল-৩ আসনে।
গত ১৪ ডিসেম্বর মেননকে প্রথমে বরিশাল-৩ আসন দেওয়ার কথা জানানো হয়। গত নির্বাচনে সেখানে ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা শেখ মো. টিপু সুলতানকে হারিয়ে জেতেন জাতীয় পার্টির গোলাম কিবরিয়া টিপু।
জাতীয় পার্টির নেতা ছাড়তে রাজি হবেন কি না, এই আলোচনার মধ্যে মেনন পান বরিশাল-২।
১৯৯১ সালে এখান থেকে মেনন ৩৬ হাজার ৩১১ ভোট পেয়ে জিতেছিলেন। কিন্তু ১৯৯৬ সালে জয় পান জাতীয় পার্টির গোলাম ফারুক অভি। মেনন ছিলেন না মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতাতেই।
আওয়ামী লীগ এই আসনে মনোনয়ন দিয়েছিল সাবেক সংসদ সদস্য তালুকদার মো. ইউনুসকে। তাকে সরে যেতে হচ্ছে।
বানারীপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ইমাম হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ইউনুসকে মনোনয়ন দেওয়ায় নেতাকর্মীরা উৎফুল্ল ছিল। প্রার্থী পরিবর্তন করায় কারো মধ্যে নির্বাচনি আমেজ নেই।”
ইউনুস সমর্থকদের ভোটে ফেরানোই কেবল নয়, ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনে এক লাখ ৫১১ ভোট পেয়ে জয় পাওয়া আওয়ামী লীগ নেতা মনিরুল ইসলামকে মোকাবিলা করতে হবে মেননকে।
মনিরুল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে যে কেউ অংশ নিতে পারবে। তাই আমি অংশ নিচ্ছি।”
আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক কমিটির সদস্য ও শের-ই বাংলা একে ফজুলল হকের নাতি একে ফাইয়াজুল হক রাজুও আছেন ভোটের লড়াইয়ে। তিনি বলেন, “নৌকা প্রতীকে প্রার্থী দেওয়া হলেও শেখ হাসিনা বলেছেন, যে কেউ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবে। তিনি (মেনন) জিতে আসলে কোনো সমস্যা নেই। তবে আমি আশাবাদী ভোটাররা সুচিন্তিত মতামত দিয়ে আমাকে বিজয়ী করবে।”
উজিরপুর ওয়ার্কার্স পাটির সভাপতি ফারাহীন বালীর ভরসা কিন্তু আওয়ামী লীগই। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “উজিরপুর-বানারীপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ ঐক্যবদ্ধ। তারা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ এমপির নির্দেশে নৌকার প্রার্থীর বিজয়ে কাজ করবে।”
উপজেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ সিকদার বাচ্চু মেননের পাশেই আছেন। তিনি বলেন, “শরিকরা তো আমাদের অংশ। তাদের নৌকা দিয়েছেন শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধভাবে তাকে বিজয়ী করতে কাজ করবে। বিচ্ছিন্ন দুই একটি ঘটনা হয়ত থাকবে। সেগুলো নিয়ে কাজ করা হচ্ছে।”
বানারীপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আক্তার হোসেন মোল্লা বলেন, “তালুকদার মো. ইউনুসকে পাল্টে যাকে (মেনন) প্রার্থী করা হয়েছে, নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা অতটা নেই। নেতাকর্মীদের মাঝে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। সেটা কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করতে হবে।”
উজিরপুরের ভোটার মাসুম আহমেদ বলেন, “১৯৯১ সালে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন মেনন। কিন্তু পরে তিনি পারেননি।”
আরেক ভোটার শাকিল মাহমুদ বলেন, “আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মেননের পক্ষে কতটুকু কাজ করবে সন্দেহ আছে।”
মেনন সাংবাদিকদের বলেন, “আমি বরিশালেরই সন্তান। এলাকার সঙ্গে আমার সম্পর্ক সব সময় ছিল। আমি আশা করি উজিরপুর-বানারীপাড়াবাসীসহ গোটা বরিশালের মানুষ আমাকে সহযোগিতা করবেন।”
ইনু বনাম আওয়ামী লীগ
আওয়ামী লীগ গত ২৬ নভেম্বর প্রার্থী ঘোষণার পর কুষ্টিয়া-২ আসনে জাসদের ইনু ছিলেন ফুরফুরে। কারণ, আওয়ামী লীগ তার আসনে মনোনয়নই দেয়নি।
কিন্তু স্থানীয় আওয়ামী লীগের বলতে গেলে সবাই ইনু বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে একজোট। ফলে ইনু নৌকা পেলেও আসনটিতে আওয়ামী লীগ ও জাসদের সরাসরি লড়াই হতে যাচ্ছে।
গত কয়েক বছর ধরেই কুষ্টিয়ায় জাসদ ও আওয়ামী লীগের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলে আসছে। স্থানীয় বিভিন্ন নির্বাচনে দুই পক্ষ একে অপরকে মোকাবিলা করেছে। একাধিকবার সংঘাত-সংঘর্ষও হয়েছে।
আগের তিনটি জাতীয় নির্বাচনের আগেও ইনুকে মেনে নিতে চাননি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের একাংশ। এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী উন্মুক্ত করে দেওয়ার পর নির্বাচনের হাওয়া ঘুরে গেছে।
মিরপুর উপজেলার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান কামারুল আরেফিন স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগ পুরোপুরিই তার পক্ষে। অন্যদিকে ইনুর দেখা যাচ্ছে কেবল জাসদের নেতাকর্মীদের।
কামারুল ঘোষণা দিয়েছেন, “জাসদের পক্ষে আর ভাড়া খাটবে না আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা।”
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “জাসদ নেতা নৌকা নিয়ে নির্বাচন করবেন, আমিও জনতার নেতা হয়ে মাঠে থাকব।”
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফের নিজের এলাকা কুষ্টিয়া-২ হলেও তিনি চতুর্থবারের মতো কুষ্টিয়া-৩ আসন থেকে ভোট করছেন।
ইনুর সঙ্গে হানিফের দ্বন্দ্ব কুষ্টিয়ায় বহুল চর্চিত এক বিষয়। এবারের নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা জাসদ নেতাকে খোঁচা দিয়েছেন।
কুষ্টিয়ায় এক সমাবেশে তিনি বলেছেন, “স্বতন্ত্র প্রার্থীরা থাকলে সঠিক নেতৃত্ব নির্বাচিত হবে, যারা জনবিচ্ছিন্ন তারা স্বতন্ত্র প্রার্থীকে ভয় পাচ্ছেন।”
ইনু ও মেননসহ শরিক দলের নেতারা আওয়ামী লীগের কাছে তাদের আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের তুলে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।
কেন এই দাবি, এই প্রশ্নে জাসদ নেতা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নিজেদের আসনে স্বতন্ত্র না সরালেও সমস্যা নেই। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা আওয়ামী লীগের সমালোচনা করবে না। কিন্তু তারা আমাদের দলের সমালোচনা করবে। আমাদেরকেও জবাব দিতে হবে। এই সমালোচনা জোটের ঐক্যে ফাটল ধরাতে পারে।”
তবে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা সরছে না, এই বাস্তবতা এখন মেনে নিয়েছেন তিনি। বলেছেন, “খেয়াল রাখতে হবে, নির্বাচনি পরিবেশটা যেন শান্তিপূর্ণ ও সহাবস্থানমূলক হয়। কেউ যেন কোনো শিষ্টাচারবহির্ভূত কথা না বলি।”
আওয়ামী লীগের সমর্থন ছাড়াও ইনু একেবারে দুর্বল নন। দেশের যে আসনে জাসদ ভোট ধরে রাখতে পেরেছে, তার একটি এটি।
১৯৭৯ সালের নির্বাচনে এখানে জাসদ নেতা মারফত আলী পান ২৮ হাজার ৮৯৫ ভোট। ২০০১ সালে ইনু এককভাবে পান ৩৮ হাজার ৮৭৭ ভোট।
২০০৮ সালে নৌকা নিয়ে তিনি ভোট পান ১ লাখ ৬৫ হাজারের বেশি।
সাবেক ব্যক্তিগত কর্মকর্তার চ্যালেঞ্জে মঞ্জু
আনোয়ার হোসেন মঞ্জু জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে প্রথম সংসদ সদস্য হন পিরোজপুর-১ আসন থেকে। পরের প্রতিটি নির্বাচনে তিনি পিরোজপুর-২ থেকে জেতেন অবলীলায়। ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালে তিনি জাতীয় পার্টির এবং ২০০১ সালে জেতেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে।
গত তিনটি নির্বাচনে জোটের শরিকরা আওয়ামী লীগের নৌকা নিয়ে নির্বাচন করলেও মঞ্জু তার দলের প্রতীক বাইসাইকেল নিয়েই লড়াই করেন। তবে এবার তিনি নৌকায় চড়েছেন লড়াইয়ের বাস্তবতা দেখে।
আওয়ামী লীগের প্রার্থী কানাই লাল বিশ্বাস সরে গেলেও সাবেক ব্যক্তিগত কর্মকর্তা জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. মহিউদ্দীন মহারাজ কঠিন চ্যালেঞ্জে ফেলেছেন মঞ্জুকে।
মঞ্জুর নিজের এলাকা ভাণ্ডারিয়া পৌর নির্বাচনে কিছুদিন আগে জেপি প্রার্থী হেরেছেন বড় ব্যবধানে।
এক সময়ে উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়নের নির্বাচনে জেপির জয় ছিল অবধারিত। তবে স্থানীয় নেতাদের বেশিরভাগ পক্ষ ত্যাগ করে মহারাজের কাছে ভিড়েছেন।
মঞ্জুর জন্য পরিস্থিতি কঠিন করে তুলেছে আসন পুনর্গঠন। ভাণ্ডারিয়া-কাউখালী-ইন্দুরকানী মঞ্জুর নিয়ন্ত্রণেই ছিল। তবে কাউখালী ও ইন্দুরকানী বাদ পড়ে যুক্ত হয়েছে নেছারাবাদ (সাবেক স্বরূপকাঠি) উপজেলা। এখানে মঞ্জু কাজ করেননি আগে।
তিনটি উপজেলা আওয়ামী লীগের সব ইউনিট মহারাজের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। সব উপজেলা চেয়ারম্যান, পৌরসভার মেয়র ও ইউনিয়ন পরিষদের প্রায় সব চেয়ারম্যান এমনকি সদস্যরাও তার পক্ষে।
ভাণ্ডারিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মিরাজুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা জাতীয় নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে অবস্থান নিয়েছি। আমরা চাই সুষ্ঠু ও সুন্দর পরিবেশে নির্বাচনটা হোক।”
বাদশার জন্য কী অপেক্ষা করে আছে?
রাজশাহী-২ (সদর) আসনে ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা এবার শুরু থেকেই ছিলেন সংশয়ে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সিটি মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন সরাসরি দলীয় প্রার্থী দেওয়ার জন্য চাপ দিয়ে আসছিলেন।
শেষমেশ বাদশাকেই চতুর্থবারের মত প্রতীক দেয় আওয়ামী লীগ। সরে যেতে হয় মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ আলী কামালকে।
আসনটিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি শফিকুর রহমান বাদশার মনোনয়নপত্র বাতিল হয়ে যাওয়ায় কিছুটা ভারমুক্ত ছিলেন বাদশা। কিন্তু শফিকুর সোমবার হাই কোর্ট থেকে প্রার্থিতা ফিরে পাওয়ায় ফের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়লেন ওয়ার্কার্স পার্টির বাদশা।
মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার বলেছেন, “দলীয় হাই কমান্ডের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হবে। আমরা দলের নির্দেশের বাইরে যাব না।”
তবে উচ্চ আদালত থেকে প্রার্থিতা ফিরে পাওয়া শফিকুর বলছেন, মহানগর আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা তার সঙ্গেই থাকবেন।
আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে বাদশার দূরত্ব এতটাই বেশি যে, বাদশা প্রার্থিতা ফিরে না পেলে জাসদের আব্দুল্লাহ আল মাসুদ শিবলী বা জাতীয় পার্টির সাইফুল ইসলাম স্বপনকেও সমর্থন দেওয়ার কথা বলছেন অনেকে।
মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সম্পাদক আহসানুল হক পিন্টু বলেন, “গত তিনটি নির্বাচনে বাদশাকে আমরা ভোট দিয়ে জিতিয়ে সংসদ সদস্য করেছিলাম। কিন্তু তিনি আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বিন্দুমাত্র মূল্যায়ন করেননি। এত সহজে তার ওপর ক্ষোভ প্রশমন হবে বলে মনে হয় না।”
বাদশা অবশ্য বলেন, “আওয়ামী লীগের কারও মান-অভিমান থাকলে তা আলোচনার মধ্যে দিয়ে ঠিক হয়ে যাবে। কোথাও সমস্যা হলে আমরা কথা বলব।”
১৯৭৫ সালের পট পরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগের দুর্বল এলাকাগুলোর একটি ছিল রাজশাহী সদর। ১৯৯১ সালে দলের প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতাতেও আসতে পারেননি। সেই নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী হিসেবে বাদশা ৩৪ হাজার ২৬৭ ভোট পেয়ে তৃতীয় হন।
২০১১ সালে তিনি ওয়ার্কার্স পার্টির প্রার্থী হিসেবে এককভাবে ১১ হাজার ৪৯০ ভোট পান।
১৯৯৬ সালে লিটনকে আওয়ামী লীগকে প্রার্থী করার পর আওয়ামী লীগের ভোট লাফ দেয়। তিনি পান ৭৫ হাজারের বেশি ভোট। ২০০১ সালে ভোট আরও বেড়ে ছাড়ায় ৯৬ হাজার।
আসনটিতে ১৯৭৩ সালের পর প্রথম নৌকা জয় পায় বাদশার হাত ধরে ২০০৮ সালে। আওয়ামী লীগ পাশে দাঁড়ানোর পর তিনি ভোট পান ১ লাখ ১৬ হাজারের বেশি। গত নির্বাচনে বাদশার নৌকায় পড়ে ১ লাখ ১৫ হাজারের কিছু বেশি ভোট।
গত জুনে রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে লিটন পান ১ লাখ ৬০ হাজার ভোট।
হঠাৎ আলোচনায় লক্ষ্মীপুরের মোশাররফ
আওয়ামী লীগ তার শরিকদের যেসব আসন ছেড়েছে, তার মধ্যে লক্ষ্মীপুর-৪ (রামগতি ও কমলনগর) কে চমক হিসেবেই দেখা হচ্ছে।
গত দুটি নির্বাচনে আসনটি দেওয়া হয় বিকল্প ধারার আবদুল মান্নানকে। তবে এবার তার মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে আর দলটিকে সমর্থনও দেয়নি আওয়ামী লীগ।
১৪ দলের শরিকদেরকে গতবার ছাড় দেওয়া ১০টি আসনে এবার নিজেদের প্রার্থী দেওয়ার মধ্যে এ আসনটি দেওয়া হয় জাসদের মোশাররফ হোসেনকে।
গত ২৬ নভেম্বর মনোনয়ন পাওয়া ফরিদুন্নাহার লাইলী সরে গেলেও জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি সাবেক সংসদ সদস্য মো. আবদুল্লাহ স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মাঠে রয়েছেন। তার পক্ষে আছেন দুই উপজেলার বেশিরভাগ আওয়ামী লীগ নেতা ও জনপ্রতিনিধি।
রামগতি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল ওয়াহেদ মুরাদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি আবদুল্লাহর জন্য কাজ করছি। তিনি যোগ্য প্রার্থী।”
ফলে জাসদ ও আওয়ামী লীগের সরাসরি লড়াই এখানেও দেখা যেতে পারে।
মোশারফ হোসেন ৬০ এর দশকে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধে রামগতি-হাতিয়া-ভোলাসহ দ্বীপাঞ্চলে মুজিব বাহিনীর অন্যতম কমান্ডার, এখন জাসদের সহসভাপতি।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি নিজের স্বার্থে কিছুই করিনি, কখনো অন্যায়কে প্রশ্রয় দিইনি। জয়ী হয়ে রামগতি-কমলনগরে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড স্থানীয়দের সঙ্গে নিয়ে করতে চাই।”
কমলনগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. নিজাম উদ্দিন ও রামগতি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল ওয়াহেদ জানান, তারা নৌকার পক্ষেই থাকবেন।
আসনটিতে এক সময় জাসদের অবস্থান ছিল শক্তিশালী। বর্তমানে জেএসডি নেতা আ স ম আবদুর রব ১৯৯১ সালে জাসদের হয়ে ২৫ হাজার ৬৩১ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় হন। ২৬১ ভোট বেশি পেয়ে জেতেন বিএনপির আবদুর রব চৌধুরী।
১৯৯৬ সালে তিনি ৩৭ হাজার ২৮২ ভোট পেয়ে জেতেন। ২০০১ সালে ৪৩ হাজার ৪৫৩ ভোট পেয়েও হের যান আড়াই হাজার ব্যবধানে। তবে ২০০৮ সালে ভোট কমে হয়ে যায় ২১ হাজার ৭৫১।
আসনটিতে ১৯৯১ সালের পর ধীরে ধীরে এগিয়েছে আওয়ামী লীগ। ১৯৯১ সালে তৃতীয়ও হতে পারেনি দলটি। ধীরে ধীরে বাড়িয়ে ২০০৮ সালে ভোট পায় ৬০ হাজারের বেশি। গত নির্বাচনে নৌকা নিয়ে বিকল্পধারার আবদুল মান্নান পান ১ লাখ ৮৩ হাজার ৯০৬ ভোট।
‘ভাগ্যবান’ তানসেন এবার পার পারবেন?
বগুড়া-৪ আসনটি ২০০৮ সাল থেকেই জাসদ নেতা এ কে এম রেজাউল করিম তানসেনকে দিয়ে আসছে আওয়ামী লীগ। সেখানে জাসদের বলার মতো সমর্থন কখনো ছিল না।
২০০১ সালে আসনটিতে ২ হাজার ৭৭৮ ভোট পেয়ে তৃতীয় হয় জাতীয় পার্টি। অর্থাৎ জাসদের ভোট ছিল এর চেয়ে কম।
তবে ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের সমর্থন পাওয়ার পর জাসদ নেতা রেজাউল করিম তানসেন পান ৭৫ হাজার ৫৮৮ ভোট।
২০১৪ সালে বিএনপি ভোটে না আসার নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমর্থনে তিনি সংসদে আসেন ১৯ হাজার ৯২৩ ভোট পেয়ে। লড়াই হয় জাতীয় পার্টির নুরুল আমিন বাচ্চুর সঙ্গে, যিনি পান ৮ হাজার ৫১৭ ভোট।
গত ফেব্রুয়ারির উপনির্বাচনে কনটেন্ট ক্রিয়েটর আশরাফুল হোসেন আলম ওরফ হিরো আলমকে হারাতে ঘাম ঝরাতে হয় তানসেনকে।
হিরোর পক্ষে ছিলেন ১৯ হাজার ৫৭১ জন ভোটার। তানসেনের পক্ষে রায় দেন ২০ হাজার ৪০৫ জন। জয়ের ব্যবধান ছিল ৮৩৪।
গত নির্বাচনে বিএনপির মোশাররফ হোসেন জেতেন ১ লাখ ২৮ হাজার ৫৮৫ ভোট পেয়ে। তানসেন নৌকা নিয়ে পান ৮৬ হাজার ৪৮ ভোট।
আসনটিতে আওয়ামী লীগের কোনো নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হননি। তবে বিএনপির হয়ে চার বার জেতা জিয়াউল হক মোল্লা স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ায় তানসেনের জন্য এবার সমীকরণটি কঠিন হয়েছে।
[প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের বরিশাল প্রতিনিধি সাইদ মেমন, কুষ্টিয়া প্রতিনিধি হাসান আলী, রাজশাহী প্রতিনিধি বদরুল হাসান লিটন, পিরোজপুর প্রতিনিধি হাসিবুল হাসান, লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি সাইফুল ইসলাম স্বপন ও বগুড়া প্রতিনিধি জিয়া শাহীন।]