তারা ‘ঘরে যেমন, বাইরেও তেমন’

“জমি-জমা নাই, তাই বরিশাল থেকে ঢাকায় আইয়া পড়ছি। দিন দিন সবকিছুর দাম বাড়তেছে, কিন্তু আমরা তো বাড়তি দামে বিক্রি করতে পারি না।”

সাবিকুন্নাহার লিপিসাবিকুন্নাহার লিপিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 March 2023, 07:42 AM
Updated : 8 March 2023, 07:42 AM

ঢাকার একটি কলেজে রাঁধুনীর কাজ করেন নাজমা বেগম, কলেজপড়ুয়া ছেলের পড়ালেখার খরচ আর নিত্যপণ্যের চড়া মূল্যের বাজারে স্বামীর স্বল্প আয়ের সঙ্গে বাড়তি কিছু যোগ করতেই ঘর সামলানোর পাশাপাশি বাইরে শ্রম দেন তিনি।

তার স্বামীও একই কলেজের কর্মচারী, কিন্তু তার স্বল্প বেতনে টানাপোড়েনের সংসার সামলাতে আগে মেহেদি বিক্রি করা এই নারী কাজ জোগাড় করেন স্বামীর কর্মস্থলেই।

নাজমা বলেন, “একজনের টাকা দিয়ে তো তিনজন মানুষ চলা যায় না। আগে মেহেদি বিক্রি করতাম, এখন রাঁধুনীর কাজ করি। ছেলেকে ডিগ্রিতে পড়াশোনা করাচ্ছি।”

নাজমার মত সংসারের হাল ধরা হালিমা আক্তার ১৬ বছর ধরে পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কের সামনে স্বামীর সঙ্গে চা-পান বিক্রি করছেন। শুরুতে বিভিন্ন বাসায় কাজ করে অনেক কষ্টে টাকা জমিয়ে টং দোকানের ব্যবস্থা করেছিলেন।

হালিমার ভাষ্য, “জমি-জমা নাই। তাই বরিশাল থেকে ঢাকায় আইয়া পড়ছি। পরিশ্রম হয়…দিন দিন সবকিছুর দাম বাড়তেছে, কিন্তু আমরা তো বাড়তি দামে বিক্রি করতে পারি না।”

হালিমা তার পাঁচ সন্তানের চারজনকে পড়াচ্ছেন বরিশালে। স্বামী ও এক ছেলেকে নিয়ে থাকছেন ঢাকায়। নিজেদের কষ্ট হলেও ছেলেমেয়েরা যেন পড়ালেখা করে সাবলম্বী হতে পারে সেই প্রত্যাশার কথা জানান তিনি।

সংসার চালাতে গিয়ে একদিকে ঘরের কাজ সামলানো, অপরদিকে বাড়তি আয়ের জন্য পুরুষের পাশাপাশি এসব নারীরা বাইরে কাজ করতে গিয়ে বিশ্রামের সুযোগটুকুও পাচ্ছেন না বলে মনে করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফাওজিয়া মোসলেম।

নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যে দিয়ে এসব নারীদের অনেক বেশি শ্রম দিতে হয় জানিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শ্রমজীবী নারীদের গৃহকর্ম সম্পাদনের ক্ষেত্রেও সমস্যা আছে। চাকরিতেও নিরাপত্তা নেই। শ্রম বেশি দিতে হয়। বাহিরে যেমন করতে হয়, তেমন ঘরটাও সামলাতে হয়। কোনো বিশ্রামের সুযোগ নেই।”

শ্রমজীবী নারীদের জীবনমান উন্নয়নের তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, “সকল শ্রমকে প্রতিষ্ঠানিকতার আওতায় নিয়ে আসতে হবে, চাকরি নীতিমালার মধ্যে রাখতে হবে। ন্যূনতম বেতন বৃদ্ধি, মাতৃত্বকালীন ছুটি ও বাচ্চাদের রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।”

চাঁদপুরের বড় স্টেশন এলাকায় বড় হয়েছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচ্ছন্নতা কর্মী পুতুল রানি। তবে বিয়ের পর ২৩ বছর ধরে ঢাকাতেই থাকছেন তিনি। বংশালের বাংলাদেশ মাঠ এলাকার এই নারী তার দুই ছেলেকে পড়িয়েছেন মাধ্যমিক পর্যন্ত, এক মেয়েকে পড়াচ্ছেন পোগোজ ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “খুব সকালে কাজে আসতে হয়, সাথে বাসাও সামলাতে হয় একা হাতে।”

আট বছর ধরে মিরপুরের অলি-গলিতে শাক বিক্রি করেন জাহানুর বেগম। নদী ভাঙ্গনে সব হারিয়ে তিন দশক আগে চাঁদপুর থেকে ঢাকায় আসেন তিনি।

দুই যুগ আগে দুর্ঘটনায় স্বামী হারানো এই নারী বলেন, “ছোট মেয়েকে নিয়েই বাসা-বাড়িতে কাজ করতে যাইতাম। এখন সাভার, বৃন্দাবন থেকে শাক এনে বিক্রি করি। রেশন কার্ড করতে কমিশনারের কাছে গত কুরবানির ইদের আগে ছবি, আইডি কার্ড জমা দিছি।”

বুধবার সারা বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক বাণীতে শ্রমক্ষেত্রে দেশের নারী-পুরুষের সম-অংশগ্রহণের কথা তুলে ধরেছেন।

সরকারপ্রধান বলেন, আওয়ামী লীগ ২০০৯ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পেয়ে প্রতিটি কাজে নারী-পুরুষের সম-অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। স্বাধীনতার ৫১ বছরে বাংলাদেশের অন্যতম অর্জন হচ্ছে, লিঙ্গবৈষম্য কমিয়ে নারীর ক্ষমতায়নের পথে এগিয়ে থাকার উল্লেখযোগ্য সাফল্য লাভ।

“নারীর দারিদ্র্য বিমোচনে সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের আওতায় বাস্তবায়িত হচ্ছে ভিজিডি কর্মসূচি, দরিদ্র মায়ের জন্য মাতৃত্বকালীন ভাতা প্রদান কর্মসূচি, কর্মজীবী ল্যাকটেটিং মাদার সহায়তা কর্মসূচি, মহিলাদের আত্ম-কর্মসংস্থানের জন্য কর্মমুখী প্রশিক্ষণ এবং ক্ষুদ্রঋণসহ বিভিন্ন ধরনের প্রকল্প।”

নারী উন্নয়নে সরকারের নানা পদক্ষেপ নিলেও সমাজে সমতা প্রতিষ্ঠার জন্য শ্রমজীবী নারীদের প্রতি আরও গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক।

তার কথায়, “সব শ্রেণির নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, উপরের শ্রেণির নারীর অধিকার কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা অস্বীকার করা যাবে না।

“তবে সমাজের প্রায় ৫০ ভাগ নারী, তার মধ্যে অধিকংশই গরীব, তাদের সমতা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পিছিয়ে থাকা এমন শ্রেণির যারা কাজ করে, তারা অনেক কষ্টের মধ্যে থাকে। সেখানে সমতা তো প্রশ্নই উঠে না।”

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘জনশুমারি ও গৃহগণনা’২২’ প্রতিবেদনের তথ্য যাচাই-বাছাই করে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএস এর প্রতিবেদন প্রকাশের অনুষ্ঠানে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেন, “নারী-পুরুষ মিলিয়ে বাংলাদেশের চূড়ান্ত জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ ২৮ হাজার ৯১১ জন।’’

গত ৬ ফেব্রুয়ারির ওই অনুষ্ঠানে নারী-পুরুষের অনুপাত প্রকাশ করেনি বিবিএস ও বিআইডিএস। তবে গতবছর ২৭ জুলাই জনশুমারি ও গৃহগণনার যে প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছিল, সেখানে পুরুষের সংখ্যা দেখানো হয়েছিল ৮ কোটি ১৭ লাখ ১২ হাজার ৮২৪, নারীর সংখ্যা ৮ কোটি ৩৩ লাখ ৪৭ হাজার ২০৬ জন।

বিবিএসের সর্বশেষ প্রকাশিত শ্রম জরিপের তথ্য বলছে, দেশে মোট ৬ কোটি ৩৫ লাখ কর্মক্ষম জনশক্তি রয়েছে। এরমধ্যে ২ কোটি রয়েছে নারী শ্রমিক।

এ নারী শ্রমিকের মধ্যে ১ কোটি ৮৬ লাখ নারী কর্মে নিয়োজিত। এর মধ্যে ১ কোটি ১১ লাখ কৃষিতে, ৩১ লাখ নারী শিল্পে এবং সেবা খাতে ৪৪ লাখ নারী কাজ করেন।

আরও পড়ুন-

Also Read: 'সমতাই' লক্ষ্য এবারের নারী দিবসে

Also Read: মহামারীতে বেড়েছে কর্মহীন মানুষ

Also Read: ভিক্ষাবৃত্তি বেড়েছে ঢাকায়, হাত পাতছেন শ্রমজীবীরাও

Also Read: ‘সারা বছর খাটাখাটনি করলেও অভাব শেষ হয় না’

Also Read: সামাজিক নিরাপত্তায় বরাদ্দ ‘অপ্রতুল’

Also Read: শ্রমবাজারে নারীর অবস্থান: বাংলাদেশ প্রেক্ষিত

Also Read: বাংলাদেশে ‘নারী’ শ্রমিক চিত্র