‘সারা বছর খাটাখাটনি করলেও অভাব শেষ হয় না’

গ্রামীণ পর্যায়ে দরিদ্রদের জন্য ভিজিডিসহ সরকারি সুবিধাগুলো স্বচ্ছল, রাজনীতক ও প্রভাবশালীরা নিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠে আসে প্রান্তিক শ্রমজীবীদের কথায়।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 Nov 2022, 09:38 PM
Updated : 26 Nov 2022, 09:38 PM

“আমি ক্ষেতমজুর হিসেবে ধানের মৌসুমে কৃষি কাজ করি। বাকি সময়ে মাছ ধরি, দিনমজুরি করি। বিলে মাছ ধরতে গেলে বলে- তারা (প্রভাবশালীরা) লিজ নিয়েছে। এমন করে খাস জমি, ভিজিডি কার্ড ও সরকারের সুবিধা তারাই নিয়ে নিচ্ছে। আমরা সারা বছর খাটাখাটনি করলেও অভাব শেষ হয় না,” বলছিলেন ক্ষেতমজুর লাল মিয়া।

শনিবার ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবে ‘ক্ষেতমজুর ও গ্রামীণ শ্রমজীবীদের জন্য জমাবিহীন পেনশন’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে নিজের দুর্দশার কথা তুলে ধরেন বগুড়ার এ শ্রমজীবী।

গ্রামীণ পর্যায়ে দরিদ্রদের জন্য ভিজিডিসহ সরকারি সুবিধাগুলো স্বচ্ছল, রাজনীতক ও প্রভাবশালীদের নিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠে আসে প্রান্তিক শ্রমজীবীদের কথায়।

সাতক্ষীরা থেকে আসা নিমাই তরফদার বললেন, “এক মাস ইরি ধান লাগানোর কাজ থাকে। বাকিটা সময় ইট ভাটায়, মাছের ঘেরে ২৫০ টাকায় হাজিরা দিয়ে কাজ করি। তাতে তো সংসার চলে না। সরকারের সুবিধা আমাদের জন্য না।”

বাংলাদেশ খেতমজুর ইউনিয়ন আয়োজিত এ গোলটেবিল বৈঠকে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক বিনায়ক সেন বলেন, “দরিদ্র পরিবারের মধ্যে এখন একাধিক সদস্যরা আয় করছেন। এজন্য অতি দরিদ্রর হার কমে এখন হচ্ছে শতকরা ৫ ভাগ। তবে মূল্যস্ফীতির বিবেচনায় ২০ হাজার টাকা আয়ের পরিবারও দরিদ্রসীমায় চলে যেতে পারে।”

প্রভাবশালীদের হাতেই সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধা চলে যাওয়ার কথা তুলে ধরলেন বরিশাল থেকে আসা আতাহার আলী মন্টু।

বর্গা জমি চাষ করেও বছর শেষে সংসারের সবার ভরণপোষণ মেটে না জানিয়ে তার অভিযোগ, “চেয়ারম্যান ১০০ করে টাকা নেয় ভিজিডি কার্ড দিতে, তাও দলীয় লোকই পায়। আমাদের মতো গরিবদের কেউ নাই। পেনশন ও রেশন দিলে চলতে পারতাম।”

সরকার দেশের সবাইকে পেনশনের আওতায় আনার উদ্যোগ নিয়েছে। এ সংক্রান্ত খসড়া আইনে বলা হয়েছে, সর্বজনীন পেনশন স্কিম অনুযায়ী নির্ধারিত চাঁদা নিয়মিত দেওয়ার শর্তে একজন ব্যক্তির ৬০ বছর পূর্তিতে আজীবন বা পেনশনে থাকাকালীন চাঁদাদাতার মৃত্যুজনিত কারণে তার নমিনিকে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত মাসিক হারে পেনশন দেওয়া হবে।

এতে ১৮ বছর বা এর বেশি বয়স থেকে ৫০ বছর বয়সী সব নাগরিক যুক্ত হতে পারবেন। বিশেষ শর্তে আওতায় থাকবেন পঞ্চাশোর্ধ্বরাও।

খাদ্য উৎপাদন করে যারা কৃষিকে সজীব রেখেছেন, তাদের জন্যও সরকারের কিছু করা প্রয়োজন মন্তব্য করে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, “সর্বজনীন পেনশন স্কিমে কন্ট্রিবিউটরি বিধান করা হয়েছে। এতে টাকা জমা দিয়ে পেনশন সুবিধা নিতে পারবে।

“কিন্তু ক্ষেতমজুরসহ গ্রামীণ শ্রমজীবী মানুষ তো টাকা দিতে পারবেন না। তাদের জন্য জমাবিহীন পেনশন সুবিধা দেওয়ার দাবি করছি।“

সভায় ধারণাপত্র উপস্থাপনে সংসদ সদস্য মুস্তফা লুৎফুল্লাহ বলেন, “গ্রামীণ শ্রমজীবীরা ভ্যান চালানো, ইটভাটা, ধানের চাতালসহ গ্রামীণ জীবনযাত্রায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করে থাকে। এই ভূমিহীনদের এক বড় অংশ, যারা শহরের এসে এ ধরনের অনানুষ্ঠানিক পেশায় যুক্ত হয়।

“গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ৬২ শতাংশই ভূমিহীন। মৌসুমী কাজ থেকে যে আয় তারা করেন, তা দিয়ে সারা বছর চলতে পারেন না। তাদের পক্ষে চাঁদা দেওয়া সম্ভব নয়।”

সভায় বক্তারা বলেন, শ্রমজীবীরা মৌসুমী কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ায় তাদের বাৎসরিক আয়ের কোনো নিশ্চয়তা নেই। ৬০ বছর বয়স অতিক্রম করলেই সবাই কর্মক্ষমহীন হয়ে যায়। গ্রামে গেলে দেখা যায়- এ বয়সেই অনেকেই বাধ্য হয়ে রিকশা চালান। সমস্যায় পড়লে তাদের সাহায্য চাইতে হয়।

আলোচনা অংশ নিয়ে অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেন, “ভূমিহীন ও প্রান্তিক পর্যায়ের শ্রমজীবী মানুষের জন্য সরকার বিশেষ রেশন ও পেনশনের ব্যবস্থা করতে পারে। তারাই গ্রামীণ অর্থনীতি এগিয়ে রাখছেন।”

আলোচনায় অংশ নেন অর্থনীতিবিদ মোস্তাফিজুর রহমান, বাংলাদেশ ক্ষেতমজুর সমিতির সভাপতি ফজলুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন রেজা, জাতীয় কৃষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম গোলাপ, বাংলাদেশ কৃষক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক জায়েদ ইকবাল খান, বাংলাদেশ খেতমজুর ইউনিয়নের নজরুল ইসলাম।

খেতমজুর ইউনিয়নের সভাপতি অধ্যাপক নজরুল হক নীলুর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠান সঞ্চালন করেন সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন রাজু।