সামাজিক নিরাপত্তায় বরাদ্দ ‘অপ্রতুল’

বর্তমান বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ দ্রব্যমূল্যের পরিস্থিতি বিবেচনায় সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ ও আওতা বাড়ানোর তাগিদ থাকলেও তা না হওয়ায় এ খাতের বরাদ্দকে ‘অপ্রতুল’ বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 June 2022, 07:42 PM
Updated : 9 June 2022, 07:42 PM

প্রস্তাবিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের চেয়ে ছয় হাজার কোটি টাকা বাড়লেও মোট বাজেট ও জিডিপির তুলনায় এর হার গুরুত্ব কমেছে।

বৃহস্পতিবার আগামী ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী খাতে মোট এক লাখ ১৩ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ৬ হাজার কোটি টাকা বা ৫ শতাংশ বেশি।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাজেটের অংশীদারিত্ব বিবেচনায় প্রস্তাবিত বাজেটে আগের অর্থবছরের তুলনায় সামাজিক নিরাপত্তা খাতের বরাদ্দ কিছুটা গুরুত্ব হারিয়েছে।

অর্থমন্ত্রী সংসদে আগামী অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার যে বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করেন, সেখানে সামাজিক সুরক্ষা খাতের জন্য রয়েছে এক লাখ ১৩ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা। এ বরাদ্দ মূল বাজেটের ১৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ এবং জিডিপির ২ দশমিক ৫৫ শতাংশ।

চলতি ২০২১-২০২২ অর্থবছরে সামাজিক সুরক্ষা খাতে এক লাখ ৭ হাজার ৬১৪ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল, যা ছিল মোট বাজেটের ১৭ দশমিক ৮২ শতাংশ এবং জিডিপির ৩ দশমিক ১১ শতাংশ।

প্রস্তাবিত বাজেটে ‘ফ্যামিলি কার্ড’ চালুর উদ্যোগকে সামাজিক সুরক্ষায় অর্ন্তভূক্ত করা হয়েছে। এ কর্মসূচির আওতায় এক কোটি মানুষ স্বল্পমূল্যে নিত্যপণ্য বিতরণ করা হচ্ছে। এছাড়া ওএমএস, ভিজিএফ, ভিজিডি, কাবিখাসহ খাদ্য নিরাপত্তা খাত, সামাজিক কল্যাণ খাত, মানব সম্পদ উন্নয়ন, কাবিখা ও অন্যান্য কর্মসৃজন প্রকল্প খাতে বরাদ্দ আগের বছরের তুলনায় বাড়ানো হয়েছে।

তবে চলমান মূল্যস্ফীতি, দরিদ্র্য মানুষের সংখ্যা বাড়ানো ও বেকারত্ব বাড়ার প্রেক্ষাপটে সামাজিক নিরাপত্তার বরাদ্দ ও কর্মসূচিকে ‘অপ্রতুল’ বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকনোমিক মডেলিং সানেমের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান প্রস্তাবিত বরাদ্দকে দ্বিগুণ করার পক্ষে মত দিয়েছেন।

জাতীয় সংসদে বৃহস্পতিবার ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল। ছবি: পিআইডি

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিগুলো বর্তমান পরিস্থিতির চাহিদার আলোকে হয়নি। এর পাশাপাশি স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা বরাবরের মতই অবহেলিত রয়ে গেছে। সামাজিক সুরক্ষা খাতে হয়ত বরাদ্দ বেড়েছে। কিন্তু জিডিপির অনুপাতে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ কমেছে, স্বাস্থ্যখাতেও কিছুটা কমেছে। মূল্যস্ফীতি ও জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ার কারণে ঝুঁকিতে থাকা মানুষের যদি সঠিক মূল্যয়ন না করা হয় তাহলে সামাজিক সুরক্ষা কতটা দেওয়া উচিত সেটাও ঠিক করা যাবে না।

“সামাজিক সুরক্ষা তো দ্বিগুণ করা দরকার,” মন্তব্য করেন তিনি।

বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন এবারও সামাজিক সহায়তা কর্মসূচি বাস্তবায়ন খুব চ্যালেঞ্জিং মন্তব্য বলে মনে করেন।

তার ভাষায়, “এই বরাদ্দ কিন্তু অনেক বড় ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকার। গত বছরের তুলনায় মাত্র ৫ শতাংশ বাড়লেও আকারটা কিন্তু বিরাট।

“এই বরাদ্দ সুফল পেতে হলে এটা যাতে সুবিধাভোগীদের কাছে দুর্নীতিমুক্ত উপায়ে এবং সময় মতো পৌঁছানো একটা চ্যালেঞ্জ। অতীতে ছিল এই চ্যালেঞ্জ, বর্তমানেও আছে।”

তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডি বলেছে, “সামাজিক সুরক্ষা খাতে এবার অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে কম। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বজেটের চেয়েও কমানো হয়েছে। অথচ মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত যারা, উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির জন্য যেগুলো সহায়ক; তাদের জন্য করা হয়নি।”

বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, ২০২১-২০২২ অর্থবছর থেকে জনপ্রতি মাসিক ৫০০ টাকা হারে ৫৭ লাখ ভাতাভোগীর জন্য বয়স্ক ভাতা খাতে ৩ হাজার ৪৪৪ কোটি ৫৪ লাখ টাকা বরাদ্দ প্রদান করা হচ্ছে যা চলমান থাকবে। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে ২০ লাখ ৮ হাজার প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে মাসিক ৭৫০ টাকা হারে ভাতা প্রদান করা হয়েছে। উপকারভোগীর সংখ্যা আগামী ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে ৩ লাখ ৫৭ হাজার বৃদ্ধি করে ২০ লাখ ৮০ হাজারের স্থলে ২৩ লাখ ৬৫ হাজারে উন্নীত করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এ সময় মাসিক ভাতার হার ৭৫০ টাকা থেকে ৮৫০ টাকা করা হবে।

“২০২২-২০২৩ অর্থবছরে প্রতিবন্ধী ভাতা বাবদ ২ হাজার ৪২৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাব করছি। ভাতা কর্মসূচির বাইরেও সরকার প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতিবন্ধী শিক্ষা উপবৃত্তি চালু করেছে, ২০২১-২০২২ অর্থবছরে যার উপকারভোগীর সংখ্যা ছিল ১ লাখ এবং বার্ষিক বরাদ্দ ছিল ৯৫ কোটি ৬৪ লাখ টাকা।”

সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতাভুক্ত বয়স্ক ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা ও প্রতিবন্ধী উপবৃত্তি কার্যক্রমে এবং দারিদ্র্য নিরসন কর্মসূচির আওতায় পল্লী ও শহর সমাজসেবা কার্যক্রম, এসিডদগ্ধ ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের পুনর্বাসনে শতকরা ৫০ ভাগ নারী এবং বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা দুঃস্থ মহিলা ভাতা এবং পল্লী মাতৃকেন্দ্র কার্যক্রমে শতকরা ১০০ ভাগ নারী অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

‘মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচি’ নামের একটি কর্মসূচিতে ২০২১-২০২২ অর্থবছরের উপকারভোগীর সংখ্যা ১০ লাখ ৪৫ হাজার থেকে ২ লাখ ৯ হাজার বাড়িয়ে আগামী ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে মোট ১২ লাখ ৫৪ হাজারে উন্নীত করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী।। এ খাতে ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে মোট বরাদ্দ ১ হাজার ২৪৩ কোটি টাকা।

ফ্যামিলি কার্ড কর্মসূচি

বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত ও বিশ্বব্যাপী সরবরাহ শৃঙ্খলা ব্যাহত হওয়া জনিত কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে দেশব্যাপী দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে স্বল্পমূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বিতরণে আমরা ‘ফ্যামিলি কার্ড’ কর্মসূচি চালু করেছি। এ কর্মসূচির আওতায় এক কোটি পরিবারের তালিকা চূড়ান্ত করা হয়েছে।

“এর অধীনে করোনাকালে নগদ অর্থ সহায়তা বাবদ ২,৫০০ টাকা করে পেয়েছেন, যেসব পরিবারসহ মোট এক কোটি পরিবার টিসিবির ‘ফ্যামিলি কার্ড’ সহায়তা পাচ্ছেন। সরকারি এ উদ্যোগের ফলে দেশের প্রায় পাঁচ কোটি স্বল্প-আয়ের মানুষ সরাসরি উপকৃত হবে।“