বাংলাদেশে ‘নারী’ শ্রমিক চিত্র

ফজলুল কবির মিন্টু
Published : 7 March 2018, 07:01 PM
Updated : 7 March 2018, 07:01 PM

১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ বিশ্ব নারী আন্দোলনের এক উজ্জ্বলতম দিন। কাজের সময় কমিয়ে দৈনিক ১২ ঘণ্টা করা, মানবিক ও উন্নত কর্ম পরিবেশ সৃষ্টি, নারী শ্রমিকের প্রতি সহিংসতা রোধ এবং মজুরিসহ নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য দূরীকরণ ও নির্যাতন-হয়রানী বন্ধের দাবিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে সূতা কলের নারী শ্রমিকেরা এই দিনে প্রথম রাজপথে নেমেছিল। কিন্তু শাসক গোষ্ঠি, নারী শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের এই যৌক্তিক আন্দোলনকে সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি। ফলে আন্দোলনকারীদের উপর নেমে এসেছিল নানা নির্যাতন ও অত্যাচার। অত্যাচারের মাত্রা এত তীব্র, অমানবিক ও পাশবিক ছিল যে, তা দেখে বিশ্বব্যাপি নিন্দার ঝড় উঠেছিল। আন্দোলনকারীরা উপলদ্ধি করতে সক্ষম হয়, লড়াই সংগ্রাম ছাড়া দাবি আদায় সহজ হবে না।

ব্যাপকভাবে আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে তোলার লক্ষে নারী শ্রমিকদের সংগঠিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। কিন্তু শাসক গোষ্ঠির রক্তচক্ষু ও কড়া নজরদারিকে এড়িয়ে নারী শ্রমিকদের সংগঠিত করার কাজটি ছিল অনেক কঠিন। তাই নানা বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে নারী শ্রমিকদের পুনরায় সংগঠিত করতে সময় লেগে যায় আরো প্রায় অর্ধ শত বৎসর। অর্থাৎ সুদীর্ঘ ৫০ বৎসর পর ১৯০৮ সালে নিউইয়র্ক শহরেই জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, মার্কসবাদী তাত্ত্বিক এবং 'নারী অধিকার' আন্দোলনের বিশিষ্ট নেত্রী ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে প্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তারও ২ বৎসর পর ১৯১০ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন।

উক্ত সম্মেলনে ১৭টি দেশের ১০০ জন নারী শ্রমিক নেত্রী যোগ দিয়েছিলেন। সম্মেলনের অন্যতম উদ্যোক্তা ক্লারা জেটকিন, নারী শ্রমিকদের সরাসরি প্রতিবাদ সংগ্রামের প্রথম দিন ১৮৫৭ সালের ৮ মার্চকে স্মরণ করে নারী জাগরণের অন্যতম দিন হিসাবে ঘোষণা দিয়ে, ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসাবে পালনের জন্য সম্মেলনে প্রস্তাব উত্থাপন করেন। পরবর্তীতে সম্মেলনে ব্যাপক আলাপ আলোচনা করে ঐক্যমতের ভিত্তিতে প্রতি বছর ৮ মার্চকে নারীর সম অধিকার দিবস হিসাবে পালনের জন্য উপস্থিত সকল নারী নেতৃবৃন্দ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। অতঃপর ১৯১১ সাল থেকে প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৮ মার্চ নারীর সম অধিকার দিবস দিবস হিসাবে পালিত হতে থাকে। পরবর্তীতে ১৯১৪ সাল থেকে এই কর্মসূচীর বিস্তৃতি ঘটতে থাকে এবং ১৯৮৪ সালে এই দিবসটি জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃতি লাভ করে।

বিশ্ব এগিয়ে চলছে। তার সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলছে আমাদের প্রিয় স্বদেশ। নারী শিক্ষার প্রসারে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হলেও কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ সেভাবে বাড়েনি, ব্যতিক্রম কেবল পোশাক শিল্পখাত। এই শিল্পে এখনো ৮০% কর্মজীবীই নারী। আবার ৮০% নারী শ্রমিকের ৭৫% নারীই হেল্পার কিংবা অপারেটর গ্রেডে চাকুরী করে। সুপারভাইজার, ফ্লোর ইনচার্জ অথবা ব্যবস্থাপনা পর্যায়ের কোন পদে চাকুরীজীবী নারী শ্রমিকের সংখ্যা ৫% এর বেশি হবেনা। কম মজুরি প্রদান, টার্গেটের কথা বলে অতিরিক্ত সময় কাজ করানো। টার্গেট পূরণ না হলে অতিরিক্ত সময় কাজ করার জন্য ওভারটাইম ভাতা প্রদান না করা, শ্রম আইনে নিষেধ থাকা সত্ত্বেও রাত ১০ টার পর নারী শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করানো এবং সুপারভাইজার বা ফ্লোর ইনচার্জদের অশালীন ব্যবহার এই সেক্টরের নিয়মিত চিত্র। এক্সপোর্ট শিডিউলের কথা বলে শ্রমিকদেরকে সাপ্তাহিক ছুটি, নৈমিত্তিক ছুটি কিংবা পীড়া ছুটি থেকে বঞ্চিত করা হয়। মাতৃত্বকালীন ছুটির ক্ষেত্রেও রয়েছে নানা অনিয়ম। নারী শ্রমিকের গর্ভধারন বিষয়ে কর্তৃপক্ষ অবহিত হওয়ার সাথে সাথে অধিকাংশ গর্ভবতি নারী শ্রমিকেরা চাকুরী হারায়।

সম্প্রতি চট্টগ্রামে কিছু কিছু পোষাক শিল্প কারখানায় মাতৃত্বকালীন ছুটির আবেদনের সাথে কাবিননামা জমা দেওয়ার শর্তও যুক্ত করা হয়েছে। ব্র্যান্ড বায়ারের কাজ করে এমন কিছু কমপ্লায়েন্ট কারখানায় মাতৃত্বকালীন ছুটি পাওয়া গেলেও অধিকাংশ কারখানায় নবজাতক শিশু লালন পালনের জন্য মান সম্মত কোন ডে কেয়ার সেন্টার নাই। ফলে সন্তান জন্মদানের পর সন্তান লালন পালন নিয়েও নারী শ্রমিকদের সংকটের অন্ত নাই। নারী শ্রমিকের সংখ্যা বেশী হওয়ার কারনেই এই শিল্পের শ্রমিকেরা অন্য শিল্পের শ্রমিকদের তুলনায় সবচেয়ে বেশী সংকটপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করে।

বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ বাজারে বর্তমানে আরো একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খাত হচ্ছে বেসরকারি স্বাস্থ্য সেবা খাত। শহর, বন্দর, গ্রামে, গঞ্জে সব জায়গায় গড়ে উঠেছে বেসরকারী হসপিটাল, ক্লিনিক ও প্যাথলজিক্যাল সেন্টার। এই খাতেও পুরুষের তুলনায় নারী শ্রমিকের সংখ্যা বেশী। শ্রম আইনের ৫ নং ধারায় নিয়োগ পত্র ও পরিচয় পত্র দেয়ার কথা উল্লেখ থাকলেও এই খাতের ৯০% এর বেশি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগপত্র ও পরিচয় দেয়া হয়না। ফলে নিয়োগকর্তা এবং শ্রমিকের মধ্যে কোন ধরনের সংকট হলে তখন ভুক্তভোগী শ্রমিকের পক্ষে নিয়োগ কর্তাকে চিহ্নিত করা কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়। অধিকাংশ শ্রমিকের প্রারম্ভিক মজুরী সাড়ে তিন হাজার থেকে চার হাজার টাকা। যা দিয়ে তাদের মাসের খরচ চলেনা। তাই এই খাতের অধিকাংশ শ্রমিক দুই প্রতিষ্ঠানে অথবা একই প্রতিষ্ঠানে দুই শিফটে চাকুরী করে, কেবল মাত্র সাপ্তাহিক ছুটি ছাড়া শ্রম আইনে বর্ণিত বাকী ছুটিগুলোর কোন বালাই নেই। তবে বৎসর শেষে ১৮-২০ দিনের অর্জিত ছুটির টাকা পরিশোধ করা হয়। কথায় কথায় ডিউটি অফ বা চাকুরীচ্যুতি এখানে নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। বিভিন্ন স্থানে নারী শ্রমিকদের যৌন হয়রানীর অভিযোগও আশংকাজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এছাড়া নির্মাণ শিল্প ও কৃষিতে নারী পুরুষের মজুরী বৈষম্য পরিলক্ষিত হয়। অভিযোগ রয়েছে সমান সময় নিয়ে একই ধরনের কাজ করা সত্ত্বেও পুরুষের সমান দক্ষতা সম্পন্ন নারী শ্রমিকেরা পুরুষের তুলনায় কম মজু্রী পায়। অর্থাৎ কর্মক্ষেত্রের প্রতিটি সেক্টরে যেন নারী পুরুষ বিভাজন রয়েই গেছে।

অথচ আইএলও কনভেনশন ১০০ এবং বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ (সংশোধিত ২০১৩) এর ৩৪৫ ধারা অনুসারে একই প্রকৃতি, একই মান বা মূল্যের কাজের মজুরী নির্ধারনের সময় নারী ও পুরুষ সকলের জন্য সমান মজুরী নীতি অনুসরন করতে হবে।অর্থাৎ কেবল মাত্র নারী ও পুরুষ ভেদে মজুরী বৈষম্য হলে সেটা আইনের সুস্পষ্ট লংঘন হবে।

আদিম গোষ্ঠী সমাজ বাদে প্রতিটি সমাজই শ্রেণীবিভক্ত সমাজ । যেমন ক্রীতদাস ও প্রভু, সামন্ত ও কৃষক, পুঁজিপতি ও শ্রমিক। উল্লেখ্য যে, উৎপাদন যন্ত্র ও সম্পদের মালিকানার কারনে মুষ্টিমেয় গুটিকয়েক মানুষ হয়েছে সমাজের অধিপতি কিন্তু অপরাপর বাকী অংশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মানুষগুলো তথা শ্রমিক শ্রেণী বরাবরই থেকেছে আধিপত্যহীন, শোষিত, বঞ্চিত ও নিপীড়িত। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না, সমাজ বিকাশের প্রতিটি স্তরে শ্রমিক সমাজ পুঁজিপতি তথা ধনিক শ্রেণি দ্বারা শোষিত ও নিপীড়িত হচ্ছে। আর শ্রমিক শ্রেণিকে যদি নারী-পুরুষে বিভাজন করা যায় তখন নারীর উপর যেন শোষণ নিপীড়ন আরো তীব্রতর হয়। তখন পুরুষ শ্রমিকও নারী শ্রমিকের প্রতিপক্ষ হিসাবে দাঁড়িয়ে যায়। মানব সভ্যতার শিখরে দাঁড়িয়ে আজ বলতে দ্বিধা নেই, যে প্রেক্ষাপটের কারনে ১৮৫৭ সালে নিউইয়র্কের নারী শ্রমিকেরা রাজপথে নেমেছিল একবিংশ শতাব্দীতে এসেও আমরা দেখতে পায় কর্মক্ষেত্রে নারীর অবস্থার তেমন কোন দৃশ্যমান পরিবর্তন হয়নি।এমনকি সমাজের প্রতি ক্ষেত্রে নারীর অবদান দৃশ্যমান হলেও নারীর আর্থ সামাজিক অবস্থান ও নারীর প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি।

দেশের মোট জনশক্তির প্রায় অর্ধেক নারী। আবার নারী শ্রমিকের সিংহভাগ অংশ কৃষি কাজের সাথে যুক্ত থেকে খাদ্য ঘাটতি পূরণ ও কৃষি নির্ভর অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছে। নারী শ্রমিক নির্ভর পোশাক শিল্প খাত আজ বাংলাদেশের প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতেও নারীর অবদান সর্বজন স্বীকৃত। অনেক নারী শ্রমিক পরিবার পরিজন ছেড়ে প্রবাসে গিয়ে বৈদেশিক মুদ্রাও আয় করছে।জিডিপির একটা বড় উৎস আসছে নারীর আয় থেকে। নারীর এই অর্জন কোন সহজ পথে আসেনি।শত অবজ্ঞা ও প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করেই নারী সামনের দিকে এগিয়ে চলছে। তাই নারী শ্রমিকদের শোষণ, নির্যাতন, হয়রানী, সহিংসতা ও বৈষম্য থেকে মুক্ত করাই আজকের আন্তর্জাতিক নারী দিবসের অন্যতম চ্যালেঞ্জ।