Published : 12 Mar 2016, 03:52 PM
কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশ উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনসহ মানবসম্পদ উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করতে সক্ষম হয়েছে। নারীর আর্থ-সামাজিক অবস্থানের ক্ষেত্রে আমাদের সাফল্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়েছে। বিশেষত নারীর স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ক্ষেত্রের বিভিন্ন সূচক, যেমন: মাতৃমৃত্যুহার, জন্মহার, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় অংশগ্রহণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ ব্যাপক অগ্রগতি অর্জন করেছে।
শ্রমবাজারের প্রেক্ষিতেও নারীর অবস্থানের উল্লেখযোগ্য উন্নতি লক্ষ্য করা যায়। ২০০২-০৩ সালে শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ ২৬ শতাংশ ছিল। ২০১৩ সালে তা ৩৩.৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। যা কি না ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য অনেক দেশের চেয়ে বেশি। কিন্তু নারীর এই অর্জন অনেক ক্ষেত্রে প্রশ্নবিদ্ধ হয় যখন কাজের প্রকৃতি ও ধরন বিবেচনায় আসে এবং পুরুষের অবস্থানের সঙ্গে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করা হয়।
শ্রমশক্তি জরিপের দেওয়া পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে বলা চলে যে, গত কয়েক দশকে শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে বড় ধরনের অগ্রগতি হয়েছে। ১৯৯৯ সালে এ হার যেখানে ছিল মাত্র ২৫ শতাংশ, ২০১০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৬ শতাংশে। ২০১৩ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী এ হার ৩৩.৫ শতাংশে নেমে এলেও বাংলাদেশের রক্ষণশীল সমাজ ব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে এই পরিসংখ্যান প্রশংসার দাবি রাখে।
শ্রমবাজারে নারীর ক্রমবর্ধমান (প্রায়) অংশগ্রহণের পেছনে তৈরি পোশাক খাতের প্রবৃদ্ধি ও ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের ব্যাপক প্রসারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করা হয়। তৈরি পোশাক খাতে বর্তমানে প্রায় ২.৮ মিলিয়ন নারী নিয়োজিত। আর ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের একটি বড় অংশের গ্রহীতা নারী। কিন্তু পুরুষের তুলনায় নারীর শ্রমবাজারে অংশগ্রহণের হার এখনও খুবই কম। দুদশকে পুরুষের অংশগ্রহণের হার ছিল ৮০ শতাংশেরও বেশি। ২০১৩ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী এ হার ছিল ৮১.৭ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী ৪২.৫ মিলিয়ন পুরুষ শ্রমবাজারের সঙ্গে যুক্ত যেখানে নারীর সংখ্যা ১৮.২ মিলিয়ন। অর্থাৎ ১৫ বছর বা তার বেশি বয়সের ৩৬.১ মিলিয়ন নারী এখনও শ্রমবাজারের বাইরে অবস্থান করছেন।
[শ্রমশক্তি জরিপ, ২০১৩]
শুধু শ্রমবাজারে অংশগ্রহণই নয়, কাজের ধরন ও প্রকৃতির বিচারেও নারীর অবস্থান অনেকটাই পেছনে। কাজে নিয়োজিত নারীর মাত্র ৩৭ শতাংশ মজুরি ও বেতনভিত্তিক (Wage Employment) কাজে জড়িত। ১২ শতাংশ নিয়োজিত রয়েছেন স্বনিয়োজিত কাজে (Self Employment)। অর্থাৎ অর্ধেকের বেশি নারী মজুরি বা আয়-বহির্ভূত কাজ করছেন। এরা মূলত পারিবারিক শ্রমিক যারা তাদের স্বামী বা শ্বশুরের জমি বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বিনা পারিশ্রমিকে নিয়োজিত।
সুতরাং তারা শ্রমবাজা্রের গণনায় এলেও এবং তাদের উৎপাদিত সামগ্রী জাতীয় আয়ের অন্তর্ভূক্ত হলেও, তাদের শ্রমের বিনিময়ে কোনো পারিশ্রমিক তারা পান না। তাদের কর্মপরিসর খানা ও তৎসংলগ্ন কৃষিজমি বা ব্যবসায় সীমাবদ্ধ। শ্রমশক্তি জরিপ, ২০১৩এর হিসাব অনুযায়ী ৮.৪ মিলিয়ন নারী (কাজে নিয়োজিত নারীর ৪১ শতাংশ) মজুরিবিহীন পারিবারিক শ্রম, যেমন: হাঁস-মুরগী ও গবাদি পশু পালন, বীজ বপন, হাল-চাষ, ফসল প্রক্রিয়াজাতকরণ, শাকসবজি উৎপাদন ইত্যাদি কাজে নিয়োজিত রয়েছেন যা তাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধিতে তেমন ভূমিকা রাখতে পারছে না।
অল্পসংখ্যক পুরুষ (কাজে নিয়োজিত পুরুষের ৫ শতাংশ) এসব কাজে জড়িত থাকলেও, নারীরাই মূলত পারিবারিক শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন। সাম্প্রতিক সময়ে নারীরা কৃষি উৎপাদনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করন এবং কৃষি-সংক্রান্ত প্রায় সবগুলো কাজেই সক্রিয় অংশগ্রহণ করছেন যার অনেকটাই দৃশ্যমান নয় কিংবা অর্থনৈতিকভাবে স্বীকৃত হয় না।
গবেষণায় দেখা গেছে যে, এ নারীদের অনেকেই প্রাথমিক বা তার চেয়ে বেশি শিক্ষাগত যোগ্যতার অধিকারী। পারিবারিক শ্রম তাই অনেক ক্ষেত্রেই নারীর মজুরিভিত্তিক শ্রমবাজারে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করছে। মজুরি-বহির্ভূত হবার কারণে টাকার অংকে এই শ্রমের অবদান বা মূল্যমান নির্ণয় করা সহজ নয়। তবে গবেষণায় দেখা গেছে যে, খানার স্বনিয়োজিত আয়ের (Self Employed Earning) প্রায় এক-চতুর্থাংশ পারিবারিক নারী শ্রমিকের অবদান যা কিনা খানার প্রধান পেয়ে থাকেন। পারিবারিক শ্রম তাই এক ধরনের আন্তঃখানা বৈষমের বিষয় হিসেবে মনে করা যেতে পারে।
তবে আশার কথা এই যে, সাম্প্রতিক সময়ে নারী, পুরুষ উভয় ক্ষেত্রেই পারিবারিক শ্রমিকের সংখ্যা কমেছে এবং ২০১৩ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী নারীর ক্ষেত্রে এই সংখ্যা হচ্ছে ৮.৪ মিলিয়ন যা ২০১০ শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী ছিল ৯.১ মিলিয়ন (পুরুষের ক্ষেত্রে যথাক্রমে ২.১ মিলিয়ন ও ২.৭ মিলিয়ন)।
মজুরি-বহির্ভুত কাজই শুধু নয়, মজুরিভিত্তিক শ্রমবাজারেও নারীরা পিছিয়ে রয়েছেন। ৯০.৩ শতাংশ নারী অনানুষ্ঠানিক খাতে (Informal Sector) নিয়োজিত যেখানে পুরুষের হার ৮৬.৩ শতাংশ। এ ধরনের অনানুষ্ঠানিক কাজ সাধারণত নিম্ন-উৎপাদক, অনিয়মিত (irregular), অসুস্থিত (unstable) ও স্বল্পমেয়াদী (short term)। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে যে, এ ধরনের কাজের মাধ্যমে সাময়িক জীবিকা নির্বাহ করা গেলেও তা শ্রমিককে অর্থনৈতিক সুরক্ষা বা প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিতে সক্ষম হয় না। নারীর অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও সামাজিক মর্যাদার নিরিখে অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থান তাই দীর্ঘমেয়াদে কাঙ্ক্ষিত ফল বয়ে আনতে পারে না।
এছাড়া শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৩এর তথ্য অনুযায়ী দেখা গেছে যে, বেতনভুক কাজে নিয়োজিত নারীর মাত্র ৬৩.২৭ শতাংশ স্থায়ী বা নিয়মিত বেতনভুক্ত (Permanent Wage Employment)। সুতরাং বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে মজুরিভিত্তিক কাজের ক্ষেত্রেও নারীরা অপেক্ষাকৃত অনুন্নত ও পশ্চাদপদ কাজগুলোর মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
কাজের প্রকৃতি বিচারে দেখা গেছে যে, কাজে নিয়োজিত নারীর ৪৪.৫ শতাংশ কৃষি ও তদসংলগ্ন কাজে জড়িত, যেখানে পুরুষের ক্ষেত্রে এই হার ৩৩.৬ শতাংশ (শ্রমশক্তি জরিপ, ২০১৩)। অপরপক্ষে, সেবা ও বিক্রয়-সংক্রান্ত কাজে (Service and Sales Work) রয়েছেন কাজে নিয়োজিত নারীর মাত্র ৮.৭ শতাংশ।
সুতরাং প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে বলা চলে যে, শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ মূলত মজুরি-বহির্ভূত বা স্বল্প মজুরির ও নিম্ন উৎপাদক কৃষি বা ক্ষুদ্র শিল্প কাজে সীমাবদ্ধ। তবে ক্র্যাফট ও সংশ্লিষ্ট বাণিজ্যিক কাজে (Craft and Related Trades) নিয়োজিত রয়েছেন ২৩.৭ শতাংশ নারী যাদের বেশিরভাগই হচ্ছেন পোশাক খাতে নিয়োজিত শ্রমিক। তৈরি পোশাক কিংবা নির্মাণকাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের ক্ষেত্রে, নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই নিম্ন মজুরি, ঝুঁকিপূর্ণ কাজের পরিবেশ ইত্যাদি বিষয়গুলোর কারণে কাজে অংশগ্রহণের পাশাপাশি শ্রম-নিরাপত্তার প্রশ্নটিও বিশেষ বিবেচনায় আনা প্রয়োজন।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে উচ্চ মজুরির কাজে নারী-পুরুষ উভয়ের অংশগ্রহণ কম। তবে নারীর বেলায় অনেক ক্ষেত্রেই আরও কম। ২০১৩ সালের তথ্য অনুযায়ী পরিচালক পদে মাত্র ৭৭ হাজার নারী কর্মরত আর পেশাজীবী পদে রয়েছেন মাত্র ৯ লাখ চার হাজার নারী। বিএসসি ও ২০১২এর শ্রেণিবিন্যাস (BSCO 2012 Classification) অনুযায়ী, উচ্চ ও মধ্যম পর্যায়ের ব্যবস্থাপনায় (Senior and Mid Level Management) অর্থাৎ শ্রেণি ১১: নীতি-প্রণেতা ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা (Legislators and Senior Officials) ও শ্রেণি ১২: প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক (Administrative and Commercial Manager) পদের মাত্র ১২.৮ শতাংশ পদে নারী অধিষ্ঠিত। সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও ব্যবস্থাপনার গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে নারীর প্রতিনিধিত্ব তাই খুব নগণ্য।
উচ্চপদস্থ পদে ও দক্ষ কাজে নারীর অংশগ্রহণ কম হবার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে, তুলনামূলকভাবে কমসংখ্যক নারীর উচ্চশিক্ষা গ্রহণ। তাই কাজে নিয়োজিত নারীর ৩৪.৭ শতাংশের প্রাথমিক শিক্ষা থাকলেও মাত্র ৩.৯ শতাংশ নারী তৃতীয় পর্যায়ের শিক্ষায় (Tertiary Education) শিক্ষিত, যেখানে পুরুষের হার ৭.০ শতাংশ।
নারীর ক্ষেত্রে শ্রমবাজারে অবদান ও অবস্থানের বিষয়ে আমাদেরকে কিন্তু শুধু পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলেই চলবে না। কারণ নারীর শ্রমের একটি বিশাল অংশই শ্রমবাজারের পরিসংখ্যানের বাইরে থেকে যায়। বিভিন্ন গবেষণা ও পারিপার্শ্বিক উদাহরণ থেকে দেখা যায় যে, নারী তার দিনের একটি উল্লেখ্যযোগ্য সময় গৃহস্থালি কাজে ব্যয় করে থাকেন যার সামাজিক স্বীকৃতি বা অর্থনৈতিক মূল্যায়ন হয় না। রান্না, কাপড় কাচা, ঘরদোর পরিস্কার, শিশু ও বয়স্কদের যত্ন, বাড়ির ছেলেমেয়েদের পড়ালেখায় সাহায্য, রান্নার জন্য জ্বালানি ও পানি আনয়ন ইত্যাদি কাজ শ্রমবাজারের গণনায় অন্তর্ভূক্ত হয় না, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড (Economic Activity) হিসেবেও পরিগণিত হয় না। জাতীয় আয়ের হিসাবেও তা আসে না।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অতি সম্প্রতি মজুরিবিহীন এসব কাজের মূল্যায়নের ব্যাপারে গবেষণা শুরু হয়েছে। এ-সংক্রান্ত গবেষণার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্তের অভাব এবং বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সময় ব্যয়-জরিপ ২০১২ (Time Use Survey 2012) এখন পর্যন্ত জাতীয় পর্যায়ের একমাত্র তথ্যসূত্র যার মাধ্যমে নারীর গৃহস্থালি কাজে ব্যায়িত সময় সম্পর্কে জানা সম্ভব। সময়-ব্যয় জরিপ ২০১২ অনুযায়ী একজন নারী যিনি কর্মজীবী নন তিনি গৃহস্থালি কাজে প্রতিদিন ৬.২ ঘন্টা ব্যয় করেন। অপরপক্ষে একজন কর্মজীবী নারীর জন্য এই সংখ্যা ৩.৬ ঘণ্টা।
পরবর্তীতে অন্যান্য গবেষণাও নারীর গৃহস্থালি কাজে ব্যয়িত সময় সম্পর্কে একই ধরনের উপাত্ত পাওয়া গেছে যাতে দেখা যায় যে, একজন নারী গৃহস্থালি কাজে দিনের সিংহভাগ সময় ব্যয় করেন। কিন্তু পারিবারিক শ্রমের মতো এসব কাজ মজুরির বিনিময়ে সংঘটিত না হবার কারণে অনেক ক্ষেত্রেই অদৃশ্য শ্রম হিসেবে সব ধরনের গণনার বাইরেই থেকে যায় এবং স্বীকৃতি থেকেও বঞ্চিত হয়। অথচ এসব কাজ যদি মজুরির বিনিময়ে করা হত তবে তার জন্য পরিবার/খানাকে তার ব্যয়ভার বহন করতে হত যার ফলে পরিবারের ব্যয়ও বেড়ে যেত। নারীর মজুরি-বহির্ভূত শ্রম তাই পরিবারের সঞ্চয় ও ভোগের ক্ষেত্রেও পরোক্ষ অবদান রেখে যাচ্ছে।
তবে মজুরি-বহির্ভূত শ্রমের ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে, পারিবারিক শ্রম শ্রমবাজারে অন্তর্ভুক্ত হলেও গৃহস্থালি কাজ হয় না– যদিও ঊভয় কাজই মজুরিবিহীন। গৃহস্থালি কাজের মাধ্যমে নারী উৎপাদক দ্রব্য প্রস্তুতে নিয়োজিত থাকলেও জাতীয় আয়ে তাদের এই মূল্য সংযোজন অন্তর্ভূক্ত হয় না যদিও বিভিন্ন গবেষণায় এর মূল্যমান জাতীয় আয়ের একটি বড় অংশ হিসেবে দেখা গেছে। এসব গৃহস্থালি কাজ ও প্রজনন-সংক্রান্ত দায়িত্বের কারণে অনেক ক্ষেত্রেই নারী আনুষ্ঠানিক বাজারকেন্দ্রিক কার্যক্রমের বাইরে থাকতে বাধ্য হন যা তাদের অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অর্জনে প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করছে।
এ বিষয়ে তর্কের অবকাশ নেই যে, নারীর সার্বিক ক্ষমতায়নের জন্য শ্রমবাজারে নারীর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ বৃদ্ধির বিকল্প নেই। তবে শুধু অংশগ্রহণই নয়, প্রশাসন, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও ব্যবস্থাপনার গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে অর্থাৎ উচ্চ উৎপাদক ও তুলনামূলকভাবে উচ্চ আয়ের কাজে নারীর প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর জন্য দরকার উচ্চশিক্ষা বা তৃতীয় পর্যায়ের শিক্ষায় নারীর অধিক হারে অংশগ্রহণ।
জাতীয় পর্যায়ে, সপ্তম পঞ্চ-বার্ষিক পরিকল্পনায় প্রস্তাবিত ৮ শতাংশ জাতীয় উৎপাদনের (Gross Domestic Product) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগের জন্য দরকার শ্রমবাজারে অধিক হারে দক্ষ ও উচ্চ উৎপাদক জনশক্তির অংশগ্রহণ। বিশ্ব ব্যাংকের গবেষণায় দেখা গেছে যে, শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ যদি ৮২ শতাংশে উন্নীত করা যায় তবে তা জাতীয় উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি বাড়ায় ১.৮ শতাংশ পয়েন্ট। তবে পুরুষের পাশাপাশি মূলধারার শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ উৎসাহিত করতে প্রয়োজন সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের সুসংগঠিত উদ্যোগ।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে, সন্তান প্রতিপালন ও গৃহস্থালি কাজের কারণে অনেক নারী মূলধারার মজুরিযুক্ত কাজে অংশ নিতে পারছেন না। এ ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কর্মস্থলে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপনের মতো পদক্ষেপ শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এছাড়া কর্মজীবী নারীদের জন্য স্বল্প খরচে আবাসন ও নিরাপদ যানবাহনের ব্যবস্থা নারীকে ঘরের বাইরের কাজে অংশ নিতে উৎসাহিত করবে।
তবে বাল্যবিয়ের মতো বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে নারীর জন্য শিক্ষা ও শ্রমবাজারে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেবার জন্য সরকারি পর্যায়ে কঠোর হস্তক্ষেপের বিকল্প নেই। অপরপক্ষে নারীর গৃহস্থালি কাজের ভার লাঘব করে নারীকে শ্রমবাজারে আনার ক্ষেত্রে ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নের মতো অর্থনৈতিক কর্মসূচিগুলো যেমন গুরুত্বপূর্ণ, নারীর মজুরি-বহির্ভুত শ্রম সম্পর্কে জাতীয় পর্যায়ে নিয়মিত জরিপ ও তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের মাধ্যমে অর্থনীতিতে নারীর অস্বীকৃত অবদান সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি তেমনি জরুরি। শেষোক্ত বিষয়ের ক্ষেত্রে সংবাদ মাধ্যমের সক্রিয় ভূমিকার বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে।
পরিশেষে বলা চলে যে, শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও ব্যবস্থাপনার গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে নারীর প্রতিনিধিত্বশীলতার জন্য নারী-বান্ধব নীতি নির্ধারণ ও প্রয়োগের পাশাপাশি প্রয়োজন জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার পরিবর্তন।