Published : 14 Feb 2024, 12:20 AM
নাগরিকদের প্রতিবাদের মুখে কলাবাগানের আলোচিত তেঁতুল তলা মাঠে থানা হয়নি। তবে সেটি শিশুদের খেলার জন্য কতটা উপযোগী, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
শিশু কিশোররা এখনও সেখানে যায়, কিন্তু সরকারি কোনো সংস্থা মাঠটি দেখভাল করে না। ময়লা আবর্জনা, পুলিশের নির্মাণ করা সীমানা প্রাচীর আর সরকারি সংস্থা ওয়াসার ফেলে যাওয়া নির্মাণ সামগ্রীর কারণে মাঠটি আসলে ভালো নেই।
২০২২ সালে মাঠ রক্ষার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া উদীচী কর্মী সৈয়দা রত্না ও তার ছেলে ইসা আব্দুল্লাহ প্রিয়াংশুর চাওয়া, সরকারি কোনো সংস্থা মাঠটিকে রক্ষণাবেক্ষণ করুক, সেখানে শিশু কিশোরদের সময় কাটানোর উপযোগী করে গড়ে তোলা হোক।
তবে মাঠের মালিকানায় থাকা পুলিশের এ নিয়ে কোনো চিন্তা ও উদ্যোগ নেই। সিটি করপোরেশন বলছে, জমিটি তাদের তত্ত্বাবধানে নেই বলে তাদেরও কিছু করার নেই।
২০২২ সালের শুরুতে এই মাঠে কলাবাগান থানার ভবন করার উদ্যোগ নেওয়ার পর বাধার প্রাচীর হয়ে দাঁড়ান সৈয়দা রত্না। ফেইসবুকে লাইভ করার সময় সন্তান সমেত তাকে ধরে নিয়ে আটকে রাখে পুলিশ।
নাগরিকদের তীব্র প্রতিক্রিয়ায় তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। কয়েক দিনের ক্ষোভ প্রতিবাদের মুখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। ঘোষণা দেন, সেখানে থানা ভবন হবে না, জমিটি যেভাবে আছে, থাকবে সেভাবেই।
এখন কী চিত্র সেখানে
পুলিশ পিছু হটার আগে মাঠের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে টানাটানির মধ্যেই শিশুদের খেলার সরঞ্জাম সরিয়ে এক রাতেই পুলিশ যে সীমানা প্রাচীর তুলেছিল, সেটি পুরোপুরি সরিয়ে নেওয়া হয়নি। প্রাচীরের ওপরের অংশের দেয়ালের একাংশ নেই। সেখানে এর ভিত্তি রয়ে গেছে। এই দেয়াল যেখানে তা টিকে আছে, তাও ভঙ্গুর। ফলে শিশুদের ছুটোছুটি সেখানে ঝুঁকিপূর্ণই বলা চলে।
মাস সাতেক আগে ঢাকা ওয়াসা এই মাঠে নির্মাণ সামগ্রী রেখে কলাবাগানে একটি পাম্পহাউজ সংস্কার করার পর সব সামগ্রী ভালোভাবে সরিয়ে নেওয়া হয়নি। মাটির স্তূপ, ইটের টুকরো এখনো পড়ে আছে এক পাশে।
শিশুরা ব্যথা পেতে পারে, এমন উপকরণ ছড়িয়ে আছে বলতে গেলে গোটা মাঠেই।
পান্থপথের কাছে মাঠটিতে গিয়ে দেখা গেল, ধূলায় ভরা জায়গাটিতে ৬-৭ জন কিশোর ব্যাট-বল নিয়ে খেলছে। তাতে রয়েছে তিনটি ব্যাডমিন্টন কোর্ট, যেখানে সন্ধ্যার পর খেলা হয়।
তবে পুরো মাঠেই পড়ে আছে খাবারের প্যাকেট আর ছোট ছোট নির্মাণ সামগ্রী। একপাশে দেখা গেল মাটির স্তূপ।
দুই বছর আগে পুলিশ যাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল, সেই ইসা আব্দুল্লাহ প্রিয়াংশুকে দেখা গেল ক্রিকেট খেলতে। এখন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষের ছাত্র।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বললেন, “বছর দুয়েক আগেও এই সময়ে মাঠে সব বয়সী ছেলে-মেয়েরা খেলতে ভিড় করত। কিন্তু এখন সে সংখ্যা কমে গেছে।”
সেখানে আসেন সৈয়দা রত্নাও। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “রাতে রাতেই দেয়াল উঠেছিল মাঠে। একরাতে তুলতে গিয়ে সেখানে পানিও দেওয়া হয়নি, ফলে পাকাপোক্ত হয়নি। তারপর প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা এলে কাজ বন্ধ করে চলে যান তারা।
“বাচ্চারা ধাক্কা দিয়ে অনেকখানি দেয়াল ভেঙে ফেলতে পেরেছে, কিছু অংশ এমনি এমনি পড়ে গেল। বাচ্চারা দেয়ালের উপর দিয়ে হাঁটে, বসে, দৌড়ায়। এর ফলে অনেক জায়গা নড়বড়ে হয়ে গেছে। যেটুকু দেয়াল আছে সেটুকুও যে কোনো সময় ভেঙে যেতে পারে বলে ভয়ে আছি। বাচ্চাদের জন্য এটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।”
রক্ষণাবেক্ষণ করবে কে?
প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত জানানোর সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের বলেছিলেন, তেঁতুলতলা মাঠ আগের মতই থাকবে; বাচ্চারা এখানে খেলবে। তবে এটি পুলিশের সম্পত্তি, রক্ষণাবেক্ষণও করবে পুলিশ।
ইসা আব্দুল্লাহ প্রিয়াংশু বলেন, আন্দোলনের সময় জনপ্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে মাঠ ঠিকঠাক করে দেবার প্রতিশ্রুতি এসেছিল। তবে কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
তিনি বলেন, “আগের এমপির সঙ্গে আম্মুর কথা হয়েছিল তখন বলেছিলেন উনারা আসবেন, মিটিং করবেন, মাঠ পরিষ্কার করবেন। এটা কেউ করে নাই।”
মাঠে বসে খেলা উপভোগ করা কিংবা অবসর যাপনের জন্য বসানো হয়েছে কিছু বেঞ্চ। সেগুলোর ব্যবস্থাও নিজেরা করেছেন বলে জানান প্রিয়াংশু।
“আমরা নিজেদের মত করে টাকা তুলে এগুলো করেছি। এরকমভাবে পুরো মাঠটা সুন্দর হলে ভালো হয়।”
মাঠে এত ময়লা কেন, এই প্রশ্নে এই তরুণ বলেন, “৬-৭ মাস আগে মাঠটির পাশেই সংস্কার করা হয় ওয়াসার পাম্প। তখন তাদের কাজের জন্য দুই-তিন মাস মাঠ বন্ধ ছিল।
“মেশিন, বালু দিয়ে পুরা মাঠ ভরা ছিল। ওরা পরে পরিষ্কার করেছে, কিন্তু ঠিকভাবে যে করেছে তা না। ইটের কণা ঢুকে মাঠটা পুরা নষ্ট হয়ে গেছে। এরকম চললে সবাই ময়লা ফেলতে চাইবে।”
সৈয়দা রত্নাও বলেন, দেখভালের জন্য গত দুই বছরে কোনো সরকারি সংস্থা বা নির্বাচিত কোনো জনপ্রতিনিধি আসেননি এখানে।
“বাচ্চারা খেলে, যখন পারে নিজেরা পরিষ্কার করে। ম্যাচ আয়োজন করার সময় আরেকটু পরিষ্কার করে।”
নাগরিক উদ্যোগ নামে একটি সংগঠনের প্রধান জাকির হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সে সময় মাঠটি সংস্কারের দাবি জানানো হয়েছিল তাদের পক্ষ থেকে।
“এটা তো এখনো হয়নি। সৌন্দর্যবর্ধন করা উচিত। এটা তো রাষ্ট্রের সম্পত্তি, আমাদের করপোরেশনের যে লোকজন আছে তাদের উদ্যোগেই করতে হবে।
“জায়গাটি সিটি করপোরেশনের না হলে আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে গিয়ে উনার নির্দেশনার পয়েন্টটা ধরে করপোরেশনের আওতায় নিয়ে যাবার অনুরোধ করব।”
তবে রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে পাল্টাপাল্টি জবাব এল পুলিশ আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে।
কলাবাগান থানার ওসি মফিজুল আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রক্ষণাবেক্ষণের তো কিছু নেই। বেদখল তো হচ্ছে না। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, বাচ্চাদের খেলার পরিবেশ তৈরি করা এসব তো সিটি করপোরেশন করবে।”
দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা আবু নাসের বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তেঁতুলতলা মাঠ তাদের এখতিয়ারাধীন না হওয়ায় এটি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পুলিশের।
“কারণ পুলিশের নিজস্ব স্থাপনা, নিজস্ব মাঠ পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের না। আমাদের দায়িত্ব শুধু আমাদের এখতিয়ারভুক্ত সম্পদ আর পাবলিক স্পেসের।”
মাঠ নাকি থানা ভবন- এ নিয়ে যখন বিরোধ, সে সময় ২০২২ সালের ২৬ এপ্রিল ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের মালিকানায় ছিল জমিটি।
২৭ কোটি ৫৪ লাখ ৪১ হাজার ৭১০ টাকা পরিশোধের পর ওই বছরের ২৭ মার্চ জমিটি পুলিশের অনুকূলে নামজারি হয়।
এখনো ‘দখলের ভয়’
মাঠ নিয়ে যেসব ঘটনা ঘটেছে, সেসব পেরিয়ে যাওয়ার দুই বছর পরও বাচ্চাদের মধ্যে ভয় থেকে যাওয়ার কথা জানালেন মাঠ রক্ষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া মা ছেলে।
থানা নির্মাণের সময় মাঠে আসা শিশুদের কান ধরে উঠবস করানোর ভিডিও সে সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর থেকে তাদের মাঠে আসা কমে গেছে বলে জানান প্রিয়াংশু।
তিনি বলেন, “আমরা প্রায়ই অনুষ্ঠান করি; আসতে বলি তাদের। এরপরও তারা আসতে চায় না।”
সৈয়দা রত্না বলেন, “দিন কয়েক আগে এখানে একটা পুলিশের গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছিল। এমনিতে পুলিশের গাড়ি পাস করলে বাচ্চারা ভয় পায় না, কিন্তু মাঠের সামনে আসলেই আতঙ্কিত হয়ে পড়ে তারা।
“শুধু পুলিশ কেন, যে কোনো প্রভাবশালী কেউও দখল করতে পারে এমন ভয় এখনো আমাদেরও আছে।”
সরকারি কোনো সংস্থা মাঠটা শিশুদের খেলার উপযোগী করে গড়ে তুললে এই ‘ভয়’ কেটে যাবে বলে ধারণা তার।
“তখন ওরাও বুঝবে, হ্যাঁ মাঠটা আমাদের। সম্পূর্ণ অধিকার যে আমাদের এটা এখনও ওরা ভাবতে পারছে না,” বলেন তিনি।
রত্নার সেই প্রতিবাদ
জমিটি ঠিক খেলার মাঠ হওয়ার মতো যথেষ্ট বড় নয়। তবে ঘিঞ্জি সেই এলাকায় এক বিঘার মতো জায়গাটিই বছরের পর বছর ধরে স্থানীয় শিশু কিশোরদের সময় কাটানোর জায়াগা হয়ে উঠেছিল।
২০২২ সালের এপ্রিল মাসে ওই মাঠে কলাবাগান থানার ভবন তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়। স্থানীয় বাসিন্দা ও সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচীর কর্মী সৈয়দা রত্না প্রতিবাদ জানান। তার নেতৃত্বে স্থানীয় একদল ওই মাঠটি রক্ষার আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিল।
২৪ এপ্রিল পুলিশ মাঠের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সীমানাপ্রাচীর তোলার কাজ শুরু করে। রত্না তার ছেলে প্রিয়াংশুকে নিয়ে ফেইসবুক লাইভে আসেন। তাকে বাধা দেয় পুলিশ। একপর্যায় মা-ছেলেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় থানায়।
এ খবরটি গণমাধ্যমে এলে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। ১৩ ঘণ্টা পর রাত সোয়া ১২টার দিকে দুইজনকে মুচলেকা দিয়ে ছাড়ে পুলিশ। কিন্তু সমালোচনা থামেনি, বরং আরো বাড়ে।
পরের দিন পরিবেশবাদী ও বিভিন্ন নাগরিক সংগঠন রত্নার পাশে দাঁড়ায়। চাপের মুখে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেন, সেখানে মাঠ হবে না থানা হবে, সেটি আলোচনা করে সিদ্ধান্ত হবে।
পরের দিন ঢাকা মহানগর পুলিশ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলে, ‘খেলার জন্য কলাবাগান মাঠ আছে।’
তবে ২৮ এপ্রিল সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তেঁতুল তলা মাঠ যেভাবে আছে, যেভাবেই থাকবে। আর জায়গাটি রক্ষণাবেক্ষণ করবে পুলিশ। এটিই প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত।
আরও পড়ুন
মাঠ রক্ষার আন্দোলনকারীকে আটকে রেখে দেয়াল তুলছে পুলিশ
কলাবাগানের মাঠ রক্ষার আন্দোলনকারী রত্নাকে ১৩ ঘণ্টা পর ছাড়ল পুলিশ
তেঁতুল তলা কখনও মাঠ ছিল না, এখন পুলিশের সম্পত্তি: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
তেঁতুলতলা মাঠে থানার ভবন হবে না, খেলার জন্যই থাকছে
প্রধানমন্ত্রীর কানে আগে গেলে এতদূর গড়াত না: রত্না