বাঙালির সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে কিংবদন্তিতুল্য, গবেষকদের চোখে বিস্ময় জাগানিয়া ব্যক্তিত্ব সন্জীদা খাতুনকে একক কোনো বৈশিষ্ট্যে বাঁধতে পারেননি কেউ।
Published : 26 Mar 2025, 01:05 AM
বাঙালি সাংস্কৃতিক আন্দোলনে আলোকবর্তিকা হয়ে এক জীবন কাটিয়ে ওপারে পাড়ি জমিয়েছেন সন্জীদা খাতুন; বিদ্যায়তনিক পাঠ আর চর্চার সঙ্গে গবেষণার যোগ ঘটিয়ে নিজের অবস্থানে যিনি হয়ে উঠেছিলেন মহীরুহ।
বাঙালির সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে কিংবদন্তিতুল্য, গবেষকদের চোখে বিস্ময় জাগানিয়া ব্যক্তিত্ব সন্জীদা খাতুনকে একক কোনো বৈশিষ্ট্যে বাঁধতে পারেননি কেউই; একাধারে শিল্পী, লেখক, গবেষক, সংগঠক, সংগীতজ্ঞ ও শিক্ষক হিসেবে তিনি নিজের দক্ষতার পরিচয় রেখে গেছেন।
ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৯১ বছর বয়সে মঙ্গলবার বিকাল ৩টায় জীবনের এই বিপুল যাত্রা সাঙ্গ করেন সন্জীদা খাতুন।
মৃত্যুর খবর দিয়ে তার ছেলে পার্থ তানভীর নভেদ বলেন, “সন্জীদা খাতুন মুক্তি নিয়েছেন। বুধবার বেলা সাড়ে ১২টায় ছায়ানটে তার শেষ দেখা মিলবে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা ও জাতীয় অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেনের মেয়ে সন্জীদা খাতুনের জন্ম ১৯৩৩ সালের ৪ এপ্রিল।
জীবনের ৯২ বছর পূর্ণ করার মাত্র দশ দিন আগে ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও সভাপতি বিদায় নিলেন। সন্জীদা খাতুন এমন এক সময়ে চলে গেলেন, যখন বাঙালির চিরায়ত উৎসব হয়ে ওঠা পহেলা বৈশাখের বাকি আর মাত্র তিন সপ্তাহ। রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ উৎসবে আর কখনো তাকে দেখা যাবে না।
সন্জীদা খাতুন পড়েছেন ঢাকার কামরুন্নেসা স্কুল, ইডেন কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং শান্তি নিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর করে ১৯৭৮ সালে সেখান থেকেই পিএইচডি করেন। দীর্ঘদিন অধ্যাপনার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ থেকে তিনি অবসর নেন।
সন্জীদা খাতুনের লেখার একটি বড় অংশ জুড়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ব্যাপক পরিসরে জনমানসে কবিগুরুকে পৌঁছে দেওয়ার কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে তার।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় শুদ্ধ সংগীতের চর্চার পাশাপাশি বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন সন্জীদা খাতুন, তখন সহযোদ্ধাদের কাছে তিনি পরিচিত ছিলেন ‘মিনু আপা’ নামে।
একুশে পদক, বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার, রবীন্দ্র স্মৃতি পুরস্কারে (পশ্চিমবঙ্গ, ভারত) ভূষিত সন্জীদা ১৬টি বই লিখেছেন।
‘সাংস্কৃতিক মুক্তিসংগ্রাম’ বইটি তার মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, বাঙালির সাংস্কৃতিক সংগ্রামের প্রামাণ্য ইতিবৃত্ত এবং মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক তার একান্ত ভাবনাগুচ্ছ ধারণ করেছে।
দুই খণ্ডের ‘আমার রবীন্দ্রনাথ’ ধারণ করেছে সন্জীদা খাতুনের রবীন্দ্রযাপন, বাঙালি জীবন, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে রবীন্দ্রনাথের অবদান, রবীন্দ্রকবিতা, রবীন্দ্রসংগীত এবং রবীন্দ্রভাবনার দশ দিগন্ত নিয়ে নানা স্বাদের রচনা৷ একই সঙ্গে শান্তিনিকেতন, শিলাইদহ, পতিসরসহ বিভিন্ন রবীন্দ্রতীর্থ নিয়ে লেখকের স্মৃতি ও অবলোকনও স্থান পেয়েছে ‘আমার রবীন্দ্রনাথ’ এ।
সন্জীদা খাতুন রচিত বইয়ের মধ্যে আরো রয়েছে ‘রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভাবসম্পদ’, ‘রবীন্দ্রনাথের হাতে হাত রেখে’, ‘রবীন্দ্রনাথ: তাঁর আকাশ ভরা কোলে’, ‘রবীন্দ্রনাথ: বিবিধ সন্ধান’, ‘তোমারি ঝরনাতলার নির্জনে’, ‘রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য’, ‘রবীন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্রনাথ’, ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত: মননে লালনে’, ‘রবীন্দ্র-বিশ্বাসে মানব-অভ্যুদয়’।
রবীন্দ্র বিষয়ক তার সম্পাদিত বইয়ের মধ্যে আছে ‘রইল তাঁহার বাণী: রইল ভরা সুরে’, ‘গীতবিতান: তথ্য ও ভাবসন্ধান’, ‘সার্ধশততম জন্মবর্ষে রবীন্দ্রনাথ’।
মুকুল ফৌজ আর ভাষা আন্দোলনের ‘মিনু আপা’
ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে যখন বাড়িতে বসে আছেন সন্জীদা খাতুন, তখন মুকুল ফৌজের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ইচ্ছা জাগল তার। বাবা কাজী মোতাহার হোসেনের অনুমতি নিয়ে যোগ দিলেন তাতে।
মুকুল ফৌজে গিয়ে ‘দরদী বোন’ হয়ে গেলেন। বিকালে প্যারেড ‘ব্রতচারী’ দেখতেন। আবদুল লতিফের গানের ক্লাসে যেতেন আগ্রহ নিয়ে। পটুয়া কামরুল হাসানের কাছেও শিখেছেন।
১৯৫১ সালে বাংলায় স্নাতকে (সম্মান) ভর্তি হলেন সন্জীদা। রাষ্ট্রভাষা বাংলা হবে না–এ রকমই মনে হতে তখন। তাই বাংলা ক্লাসে শিক্ষার্থীর সংখ্যা সাকুল্যে পাঁচজন। এর মধ্যে মেয়ে একমাত্র সন্জীদা।
মুকুল ফৌজ থেকে পদত্যাগ করে যেদিন বাড়ি ফিরলেন, তখন শুনলেন রাষ্ট্রভাষার দাবিতে ১৪৪ ধারা অমান্য করে মিছিল করতে গিয়ে গুলি খেয়ে মারা গেছে অনেক ছাত্র।
পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি মাকে সঙ্গে নিয়ে টিকাটুলিতে কামরুন্নেসা স্কুলের গলিতে একটি প্রতিবাদ সমাবেশে যোগ দেন সন্জীদা খাতুন। এক স্মৃতিকথা তিনি বলেছেন, সে সভায় অনেক নারীনেত্রী ছিলেন, কিন্তু রক্তপাতের আশঙ্কায় কেউই সভাপতি হতে রাজি হননি। শেষপর্যন্ত সে সভায় সভাপতিত্ব করেন সন্জীদার মা।
ভাষা আন্দোলনের সময় সন্জীদার ভূমিকার কথা ‘বড়ো বিস্ময় লাগে হেরি তোমারে’ শীর্ষক সন্জীদা খাতুন সম্মাননা-স্মারক গ্রন্থে লিখেছেন প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক, ভাষাসংগ্রামী রফিকুল ইসলাম।
সন্জীদা খাতুনের ৮৭তম জন্মদিনের ওই স্মারকে ‘আমাদের মিনু আপা’ নামের ওই স্মৃতিকথায় তিনি লিখেছেন, “১৯৫১ সাল থেকে মিনু আপা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্রী এবং ঢাকা বেতারে রবীন্দ্রসংগীত ও নাটকের শিল্পী হয়েছে। ১৯৫২ সালে বাইশে ফেব্রুয়ারি সকালে একুশে ফেব্রুয়ারির শহীদানের স্মরণে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে গায়েবি জানাযা শেষে আমরা যখন বিশাল এক শোভাযাত্রার সঙ্গে কার্জন হলের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন আবার গুলি চলে।
“প্রাণ নিয়ে বাসায় ফিরে দেখি মিনু আপা আমাদের বাড়িতে বসে আছেন ভাষা আন্দোলনের খবর জানবার জন্য। এ সময় মিনু আপা ‘ছাত্রী সংসদ’-এর কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন।”
‘গানই জীবন’
নজরুলভক্ত বাবা কাজী মোতাহার হোসেনের মেয়ে সন্জীদা খাতুন গেলেন রবীন্দ্রসংগীতের দিকে। বাবার বন্ধু নজরুলের কোলে বসে গান শিখেছিলেন সন্জীদা খাতুনের বড় বোন যোবায়দা মির্যা।
নজরুলভক্ত বাবার মেয়ে কীভাবে রবীন্দ্রসংগীতের দিকে ঝুঁকলেন, সন্জীদা খাতুনের জবানিতেই সেই ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায় ‘গুণীজন’ ওয়েবসাইটে তার জীবনীতে।
সন্জীদা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় ভর্তি হলেন। ক্লাসে সৈয়দ আলী আহ্সান রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়াতেন। সেই কবিতা পড়ে তার মন এমন হয়ে গেল, তিনি তখন রবীন্দ্রনাথের গান শিখতে চাইলেন।
কিন্তু কোথায় শিখবেন? বাড়িতে শিক্ষক ছিলেন—সোহরাব হোসেন। তার কাছে সন্জীদা খাতুন অসংখ্য নজরুলগীতি, আধুনিক, পল্লীগীতি শিখেছেন। রবীন্দ্রসংগীত শিখতে তাই তিনি সেগুনবাগান থেকে প্রেসক্লাবের মোড়ে এসে বাসে চড়ে আজিমপুরে হুসনা বানু খানমের কাছে যেতেন।
তিনি যে স্বরলিপি থেকে গান শেখাতেন, তাকিয়ে তাকিয়ে তা দেখতেন সন্জীদা। খুব দ্রুত গান তুলে নিতে পারতেন। বাড়িতে ফিরেও গানগুলো গাইতেন। মাঝে মাঝে সুর ভুলে যেতেন, কিন্তু কীভাবে কে জানে, মাঝরাতে সুরগুলো আবার ফিরে আসত।
ছোটবেলা থেকে সংগীতচর্চার সেই ধারাবাহিকতায় গানই যে সন্জীদা খাতুনের জীবনের অংশ হয়ে উঠেছিল তার একটি বর্ণনা সন্জীদা খাতুন সম্মাননা-স্মারক গ্রন্থে দিয়েছেন কবি শঙ্খ ঘোষ।
তিনি লিখেছেন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে কোনো এক সময়ে কলকাতায় ‘কিছু দূর থেকে’ যে সন্জীদা খাতুনকে জেনেছিলেন কবি শঙ্খ ঘোষ; পরের পরিচয় আর যোগাযোগে তাদের সান্নিধ্য কেটেছে বেশ।
সন্জীদা খাতুনের সম্মাননা স্মারকে তার গানের বিশিষ্টতা ও স্বতঃস্ফূর্ততা নিয়ে লিখেছেন শঙ্খঘোষ। তার ভাষায়, “সন্জীদার আবির্ভাব মানেই স্বতঃস্ফূর্ত গানের আবির্ভাব। এইখানেই তার গানের আর তার ব্যক্তিত্বের বিশিষ্টতা: এই স্বতঃস্ফূর্ততায়, এই সাবলীলতা, এই স্বচ্ছতায়।”
‘গানই তাঁর জীবন’ শিরোনামের স্মৃতিচারণায় তিনি লিখেছেন, “(ব্যক্তি) সন্জীদা খাতুন আরেকরকম মানুষ। গান গাইতেই তার আনন্দ, গান শোনানোতেই তার আনন্দ। কেননা গান তার কাছে কোনো আনুষ্ঠানিকতা নয়, গান তার জীবিকা নয়, গান তার জীবন, চারপাশের মানুষজনের সঙ্গে মিশে যাওয়া জীবন।
“ধর্মতলা স্ট্রিটের প্রথম পরিচয়ে জেনেছিলাম যে দেশে আত্মপরিচয় খুঁজছেন তিনি রবীন্দ্রনাথের গানে, আর আজ জানি যে সে-গানে তিনি খুঁজে বেড়াচ্ছেন নিজেরই আত্মপরিচয়। খুব কম সংগীতশিল্পীই তা পারেন।”
শান্তিনিকেতনে জ্ঞানের অন্বেষা
১৯৫৪ সারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের তিন বছর অনার্সের পাঠ চুকানোর আগেই নিজের ‘স্বপ্নের দেশ’ শান্তিনিকেতনে সরাসরি স্নাতকোত্তরে ভর্তির সুযোগ পান সন্জীদা খাতুন। জ্ঞানের অন্বেষায় বিশ্বভারতীর সঙ্গে পথচলার সেই গল্প তিনি তুলে এনেছেন ‘শান্তিনিকেতনের দিনগুলি’ নামে আত্মজৈবনিক গ্রন্থে।
ওই বইয়ের এক পর্যালোচনায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক সনৎকুমার সাহা লিখেছেন, “অনেকের ধারণা, তিনি সেখানে গানের তালিম নিতে যান। কিন্তু তা ভুল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে বাংলায় অনার্স পাঠ সাঙ্গ করে তারই স্বীকৃতিতে ওখানে এক বছরে তিনি এমএ করতে পারেন।
“তাতেও থাকে ব্যতিক্রমী মেধার পরিচয়। শান্তিনিকেতনের শিক্ষাক্রমে একটা পূর্ণাঙ্গতা আছে। এই বই থেকেই জানতে পারি।”
তিনি লেখেন, “তার গানে দীক্ষা আগেই হয়েছে ঢাকায়। মাধ্যমিক পাশ করে টানা তিন বছর সোহরাব হোসেনের শিষ্য হয়ে তার কাছ থেকে সবটুকু নিয়ে নিজের ভিত মজবুত করেছেন। আত্মবিশ্বাস সেইসঙ্গে তৈরি। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল, দুজনের গানেই ছিল সমান আগ্রহ।
“শান্তিনিকেতনের পরিমণ্ডলে এসে তা রবীন্দ্রনাথে থিতু হয়। পরে আমাদের রাজনৈতিক বাস্তবতায় এইটিই হয়ে দাঁড়ায় আমাদের সঠিক জাতীয় পরিচয়ের অভিমুখ খুঁজে নেবার লড়াইতে নেতৃত্ব দেবার এক বড় অবলম্বন।”
স্নাতকোত্তরে সত্যেন দত্তের কাব্য নিয়ে গবেষণা করা সন্জীদা খাতুন পিএইচডি গবেষণার বিষয় হিসাবে বেছে নেন ‘রবীন্দ্রসংগীতের ভাবসম্পদ’। বিপুল প্রশংসা পাওয়া সেই গবেষণা বই হয়ে বেরোলে সেটার মৌলিকত্ব সবার নজর কাড়ার কথা ওই বিশ্লেষণে লিখেছেন সনৎকুমার সাহা।
শান্তিনিকেতনে পোস্ট-ডক্টরাল কাজও সারেন সন্জীদা খাতুন। ধ্বনিবিজ্ঞানের তত্ত্বভূমির ওপর দাঁড় করিয়ে পাঁচ কবির পাঁচটি কবিতার ভাবরূপের বিকাশকে তিনি বোঝার ও বোঝাবার চেষ্টা করেন।
বিশ্বভারতীর সর্বোচ্চ সম্মাননা দেশিকোত্তম পেয়েছেন সঙ্গীতসাধনায় আজীবন পার করা সন্জীদা খাতুন। ২০২১ সালে ভারত সরকারের চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক পদ্মশ্রী পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি।
আমৃত্যু ছায়ানটের নেতৃত্বে
বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি নিবেদিত প্রতিষ্ঠান ছায়ানটের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সন্জীদা খাতুন। তার তত্ত্বাবধানে ছায়ানট এখন বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান, যা শাস্ত্রীয় সংগীত ও নৃত্যের প্রসারে কাজ করছে।
ছায়ানটের পাশাপাশি জাতীয় রবীন্দ্র সংগীত সম্মিলন পরিষদেরও প্রতিষ্ঠাতা সদস্য তিনি। প্রচলিত ধারার বাইরে ভিন্নধর্মী শিশুশিক্ষা প্রতিষ্ঠান নালন্দার সভাপতির দায়িত্বও পালন করেছেন। এশিয়াটিক সোসাইটির সাম্মানিক ফেলোও ছিলেন তিনি।
১৩৬৮ বঙ্গাব্দে, অর্থাৎ ১৯৬১ খ্রীস্টাব্দে সারাবিশ্বে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকীর আয়োজন বাংলার এই প্রান্তের সংস্কৃতিসচেতন মানুষের মনেও চাঞ্চল্য জাগায়। উদযাপনের ঐকান্তিক ইচ্ছায় পাকিস্তানি শাসনের থমথমে পরিবেশেও কিছু বাঙালি একত্র হন আপন সংস্কৃতির মধ্যমণি রবীন্দ্রনাথের জন্ম শতবর্ষপূর্তির উৎসব করার জন্যে।
উদ্যোগী হন বিচারপতি মাহবুব মুর্শেদ, ডক্টর গোবিন্দচন্দ্র দেব, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী প্রমুখ বুদ্ধিজীবী, তেমনি ঢাকার কিছু সংস্কৃতিকর্মীও আগুয়ান হন শতবর্ষ উদযাপনের উদ্দেশ্যে। শাসকের অনতিউচ্চারিত নিষেধ তারা অগ্রাহ্য করেন।
সংস্কৃতি-প্রাণ মানুষের মনে আত্মবিশ্বাস এনে দেয় রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকীর সফল উদ্যোগ। শতবার্ষিকী উদযাপন করার পর জয়দেবপুরে এক বনভোজনে গিয়ে সুফিয়া কামাল, মোখলেসুর রহমান, সায়েরা আহমদ, শামসুন্নাহার রহমান, আহমেদুর রহমান, ওয়াহিদুল হক, সাইদুল হাসান, ফরিদা হাসান, সন্জীদা খাতুন, মীজানুর রহমান (ছানা), সাইফউদ্দীন আহমেদ মানিকসহ বহু অনুপ্রাণিত কর্মী সাংস্কৃতিক আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্যে সমিতি গঠন করার সিদ্ধান্ত নেন।
সেই পথ ধরে জন্ম হয় ছায়ানটের। কঠোর সামরিক শাসনে পদানত দেশে রবীন্দ্রসংগীত ও রবীন্দ্রভাবনা অবলম্বন করে ছায়ানট যাত্রা শুরু করে।
এরপর চিন্তাবিদ, সাহিত্যিক, চিত্রশিল্পী, নাট্যশিল্পী, চলচ্চিত্র সংসদকর্মী, বিজ্ঞানী, সমাজব্রতী নানা ক্ষেত্রের মানুষের সৃজনচর্চার মিলনমঞ্চ হয়ে ওঠে ছায়ানট। স্বাধীনতা সংগ্রামের সাংস্কৃতিক অভিযাত্রায় ব্যাপ্তি ও গভীরতায় পালন করে বিশিষ্ট ভূমিকা।
ছায়ানট প্রতিষ্ঠার পরই বাঙালিকে তার গানের ঐতিহ্য স্মরণ করিয়ে দিতে ঘরোয়া পরিবেশে আয়োজন করে সুরুচিসম্মত সংগীত অনুষ্ঠান ‘শ্রোতার আসর’।
প্রতিষ্ঠাকালে ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার প্রস্তাব পেলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরির কারণে তাতে রাজি হননি সন্জীদা খাতুন। সভাপতি কবি সুফিয়া কামালের সঙ্গে সাধারণ সম্পাদক পদে আসেন ফরিদা হাসান।
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে সাংস্কৃতিক সংগ্রামে ছায়ানটকে কেন্দ্র করে সন্জীদা খাতুনের যে অনমনীয় নেতৃত্ব, তা বহুমাত্রিক কর্মকাণ্ডে সচল ছিল মৃত্যু পর্যন্ত।
বাংলা নবববর্ষ উদযাপনের সমার্থক হয়ে ওঠা রমনা বটমূলের অনুষ্ঠান; সুরের মূর্চ্ছনা আর কথামালার সেই আয়োজনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন সন্জীদা খাতুন।
বৈশাখের প্রথম প্রভাতে বাংলা নতুন বছরকে আবাহনের এ আয়োজনের সূচনা হয়েছিল ১৩৭৪ বঙ্গাব্দ, ১৯৬৭ সালের মধ্য এপ্রিলে; ছায়ানটের গণ্ডি ছাড়িয়ে এটি এখন জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে।
১৯৭১ সালে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের বছর এবং মহামারীর কারণে ২০২০ ও ২০২১ সালে বিরতি পড়েছিল কেবল; তাছাড়া প্রতিটি পহেলা বৈশাখেই ছায়ানট নতুন বছরকে স্বাগত জানিয়েছে সুরের মূর্চ্ছনা আর কথামালায়।
‘কীর্তিময়ীর মুখচ্ছবি’
সন্জীদা খাতুনের ৮৭তম জন্মদিনের সম্মাননা-স্মারকে কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক লিখেছেন, “রবীন্দ্রসংগীতই নয়, গান সম্পর্কে তার জ্ঞান গভীর। তার অনেক আলোচনা পড়ে আমরা ঋদ্ধ হয়েছি। গান সম্পর্কে জেনেছি। রবীন্দ্রসংগীত সম্পর্কে জেনেছি।
“এতটা গভীরভাবে, এতটা মন দিয়ে রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে কাজ করছেন, এপার বাংলা বা ওপার বাংলায় বিকল্প কাউকে আমি পাইনি। আমাদের দেশে রবীন্দ্রসংগীতের প্রচলন, বৃদ্ধি-সবকিছুর সঙ্গেই সন্জীদা খাতুন সাংঘাতিকভাবে জড়িয়ে আছে।”
হাসান আজিজুল হক আরও লেখেন, “আজ আমি যাকে নিয়ে লিখতে বসেছি, তাঁর মনটা আকাশের মতো উদার। একটা মানুষকে মনে রাখার জন্য একটি গুণই যথেষ্ট। সন্জীদা খাতুন বহু গুণে গুণান্বিতা। সংগীত, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির সব শাখাতেই তিনি আপন আলোয় আলোকিত করেছেন।
“ছায়ানটের মত একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে তার আপন মমতায়, পরম যত্নে। শিক্ষক হিসেবেও তিনি শত শত শিক্ষার্থীর হৃদয়ের আসনে ঠাঁই পেয়েছেন। শিল্পের জন্য এমন নিবেদিত প্রাণ শিল্পীর জন্ম বারবার হয় না।”
২০২৩ সালে ৯০তম জন্মবার্ষিকীর দিনে ‘নবতিপূর্ণা’ শিরোনামে এক অনুষ্ঠানে লিখিত বক্তব্য পড়ে শুনিয়েছিলেন সন্জীদা খাতুন।
সেদিন তিনি বলেছিলেন, “অল্পে তুষ্ট সহজ সরল জীবনের এই সার্থকতায় আমি ধন্য হয়েছি।”