অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে ন্যায় বিচার প্রার্থনা করেছেন দিলীপ অধিকারী।
Published : 04 Dec 2024, 01:45 PM
রাজধানীর বেইলি রোডের ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী অরিত্রী অধিকারীকে আত্মহত্যায় প্ররোচণা দেওয়ার অভিযোগে করা মামলার রায় পেতে আর কত দিন অপেক্ষা করতে হবে তা সেই প্রশ্ন রেখেছে তার পরিবার।
বুধবার ঢাকার কোর্ট রিপোর্টার্স ইউনিটির কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এসে অরিত্রীর বাবা দিলীপ অধিকারী বলেছেন, সাক্ষ্য প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও মামলাটি রায়ের তারিখ বারবার পিছিয়ে যাওয়ায় তারা ‘হতাশ হয়ে পড়েছেন’।
এই পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে ন্যায় বিচার প্রার্থনা করেছেন দিলীপ অধিকারী।
তিনি বলেন, “মেয়ে হারানোর ব্যথা নিয়ে ছয়টি বছর কাটালাম। বিচার চাইতে গিয়ে নিজের সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য ন্যায় বিচার পেলাম না।
“বারবার রায়ের তারিখ পড়লেও অদৃশ্য কারণে তা ঘোষণা করা হল না। কিন্তু কেন রায় দিল না, এখন আমার মেয়ের আত্মহত্যার প্ররোচনায় মামলার বিচার পাব কী না তা নিয়ে সংশয়ে আছি। তবে যতদিন বেঁচে আছি, ততদিন আমি বিচার চাইতেই থাকব।“
অরিত্রী অধিকারীকে আত্মহত্যায় প্ররোচণা দেওয়ার অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে মামলার রায় পিছিয়েছে সাতবার। এর আগে গত ২৫ জুলাই ছয়বার রায়ের তারিখ পেছানোর পর পুনঃতদন্ত করতে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) মৌখিক নির্দেশ দেন দ্বাদশ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আব্দুল্লাহ আল মামুন।
বাদী ও আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে গত বছরের ২৭ নভেম্বর প্রথমবার মামলাটি রায়ের পর্যায়ে আসে। সেদিন রায় ঘোষণার না করে চলতি বছরের ২১ জানুয়ারি দিন ঠিক করেন বিচারক আব্দুল্লাহ আল মামুন।
কিন্তু ওই দিন রায় প্রস্তুত না হওয়ায় তা পিছিয়ে ৮ ফেব্রুয়ারি ঠিক করা হয়। কিন্তু ওই দিনও একই কারণে তা পিছিয়ে ৩ মার্চ ঠিক করা হয়।
পরের দফায় রায় পিছিয়ে তারিখ পড়ে ৯ এপ্রিল। তারপর ৩ জুন নতুন তারিখ রাখা হয়েছিল। এরপর সর্বশেষ তারিখ ২৫ জুলাইও রায় হয়নি।
মামলার দুই আসামি ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের তখনকার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌস এবং শাখা প্রধান জিনাত আক্তার জামিনে রয়েছেন। এদিন তারা আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
দোষী সাব্যস্ত হলে দণ্ডবিধির ৩০৬ ধারার এ মামলার তাদের সর্বোচ্চ দশ বছর কারাদণ্ড, সঙ্গে অর্থদণ্ড হতে পারে।
অরিত্রীর বাবা দিলীপ বলেন, “আমার আদরের সন্তান অরিত্রী ভিকারুননিসা নুন স্কুল এন্ড কলেজের নবম শ্রেণির একজন মেধাবী ছাত্রী ছিলেন। স্কুলের শ্রেণী শিক্ষক হাসনা হেনা, শাখা প্রধান জিনাত আক্তার, অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) নাজনীন ফেরদৌস আমাদের সামনে অরিত্রীর সাথে নির্মম ও নির্দয় আচরণ করেন এবং বারবার টি.সি. দেওয়ার হুমকি দেয়।
“এতে অরিত্রী মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পরে এবং ২০১৮ সালের ৩ ডিসেম্বর সে আত্মহত্যা করে। এ ঘটনায় করা মামলায় দুই শিক্ষককে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দেয় পুলিশ। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তদন্তেও তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ মিলেছে। “
আক্ষেপ করে দিলীপ অধিকারী বলেন, “মামলাটির রায় পিছিয়ে অধিকতর তদন্তে পাঠানো হয়েছে। এতে আমরা প্রচণ্ডভাবে আশাহত হয়েছি। পিবিআইতে খোঁজ নিয়েছি, তবে চার মাসের বেশি সময় পার হলেও এই সংস্থা তদন্তের কোন আদেশ পায়নি। আজ পর্যন্ত কোন অগ্রগতি নেই। এভাবে যদি সময় চলে যায়, তাহলে কিভাবে আমি ন্যায় বিচার পাব? আমি বিচার নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভুগছি। আমি অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে ন্যায় বিচার চাচ্ছি। ”
তিনি অভিযোগ করে বলেন, “এ মামলার আসামি পক্ষের আইনজীবী ছিলেন মোশারফ হোসেন কাজল। যিনি ফ্যাসিস্ট সরকারের একজন পিপি এবং বিভিন্ন মিথ্যা মামলা লড়েছেন। আমার মেয়ের আত্মহত্যা প্ররোচনায় মামলার স্বাক্ষীদের তিনি বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি প্রদর্শন করেছেন। বিচার কাজে বাধা দেন। তার কারণে ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছি। এখন ন্যায়-বিচার প্রত্যাশা করছি। ”
কী ঘটেছিল
২০১৮ সালে ৩ ডিসেম্বর শান্তিনগরের বাসায় গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী অরিত্রী (১৫)। তার আগের দিন পরীক্ষায় নকল করার অভিযোগে তাকে পরীক্ষা হল থেকে বের করে দিয়েছিল স্কুল কর্তৃপক্ষ।
স্কুল কর্তৃপক্ষের দাবি, অরিত্রী পরীক্ষায় মোবাইল ফোনে নকল নিয়ে টেবিলে রেখে লিখছিল। অন্যদিকে স্বজনদের দাবি, নকল করেনি অরিত্রী।
এরপর অরিত্রীর বাবা-মাকে ডেকে নেওয়া হয় স্কুলে। তখন অরিত্রীর সামনে তার বাবা-মাকে অপমান করা হয়েছিল বলে অভিযোগ ওঠে। ওই দিনই আত্মহত্যা করেন অরিত্রী।
অরিত্রীর আত্মহত্যার পর তার সহপাঠীরা বিক্ষোভে নামে।
৪ ডিসেম্বর তার বাবা দিলীপ অধিকারী আত্মহননে প্ররোচনার অভিযোগ এনে মামলা করেন। ওই মামলায় অরিত্রীর শিক্ষকদের পুলিশ গ্রেপ্তারও করলেও পরে তারা জামিন পান।
মামলার এজাহারে অরিত্রীর বাবা লেখেন, স্কুল কর্তৃপক্ষ মেয়ের সামনে তাদের অপমান করে। ওই অপমান এবং পরীক্ষা দিতে না পারার মানসিক আঘাত সইতে না পেরে অরিত্রী আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।
তদন্ত শেষে ২০১৯ সালের ২৮ মার্চ নাজনীন ও জিনাতকে আসামি করে মামলার অভিযোগপত্র জমা দেন তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির পরিদর্শক কামরুল হাসান তালুকদার।
সেখানে বলা হয়, আসামিদের ‘নির্দয় ব্যবহার ও অশিক্ষকসুলভ আচরণ’ অরিত্রী অধিকারীকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করে।
মামলার এজাহারে অরিত্রীর শ্রেণি শিক্ষক হাসনা হেনাও আসামি ছিলেন। তবে অভিযোগপত্রে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
এরপর ২০১৯ সালের ১০ জুলাই অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে নাজনীন ফেরদৌস ও জিনাত আক্তারের বিচার শুরু করে আদালত।
মামলার ১৮ সাক্ষীর মধ্যে ১৫ জনের সাক্ষ্য নেন ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত।
অরিত্রীর বাবা, মামলার বাদী দিলীপ অধিকারী, মা বিউটি অধিকারী, অরিত্রীদের বাড়ির নৈশ প্রহরী শুকদেব, অরিত্রীর বাবার সহকর্মী সনজয় অধিকারী, প্রতিবেশী মেরিনা মণ্ডল সাক্ষ্য দিয়েছেন এ মামলায়।
পুরনো খবর
অরিত্রীর আত্মহত্যা: ফের পেছাল রায়
অরিত্রীর আত্মহত্যা: ৬ বার রায় পেছানোর পর পুনঃতদন্তের আদেশ
অরিত্রীর আত্মহত্যা: রায় পেছাল তৃতীয় দফা
অরিত্রীর আত্মহত্যা: পেছাল দুই শিক্ষকের রায়
অরিত্রীর আত্মহত্যা: ২ শিক্ষকের বিচারের রায় ফের পেছাল
অরিত্রীর আত্মহত্যা: পঞ্চমবার পেছাল রায়
অরিত্রীর আত্মহত্যা: পিছিয়ে গেল অভিযোগ গঠনের শুনানি
শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা প্রতিরোধে নীতিমালা করতে কমিটি
অরিত্রীর আত্মহত্যা: আত্মসমর্পণ করে জামিন পেলেন দুই শিক্ষক
অরিত্রীর শিক্ষক হাসনা হেনার জামিন
ভিকারুননিসায় নতুন অধ্যক্ষ, প্রভাতী শাখায় নতুন প্রধান
ভিকারুননিসার ৩ শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে র্যাব-পুলিশকে চিঠি