ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্রী অরিত্রী অধিকারীর আত্মহত্যার আগে স্কুল প্রাঙ্গণ আর বাসায় কী ঘটেছিল- তা নিয়ে শিক্ষক ও স্বজনদের পক্ষ থেকে পাল্টাপাল্টি নানা বক্তব্য এসেছে।
Published : 05 Dec 2018, 09:53 PM
তবে অরিত্রীর বাবা দিলীপ অধিকারী তিন শিক্ষকের বিরুদ্ধে ‘আত্মহত্যায় প্ররোচনার’ যে মামলা করেছেন, সেখানে উঠে এসেছে সেদিনের ঘটনাপ্রবাহের মর্মস্পর্শী বিবরণ।
সেখানে বলা হয়েছে, পরীক্ষার হলে মোবাইল ফোন নিয়ে যাওয়ায় অরিত্রীকে টিসি দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়েছিল। ১৪ বছর বয়সী মেয়েটি ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌসের পা ধরে ক্ষমা চেয়েছিল, কাঁদতে কাঁদতে করজোড়ে ক্ষমা চেয়েছিলেন তার বাবা-মাও। কিন্তু মন গলেনি শিক্ষিকার।
সোমবার বাবা-মায়ের সঙ্গে শান্তিনগরের বাসায় ফিরে নিজের ঘরে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করে অরিত্রী।
তার এই মৃত্যু ঢাকার নামী এই স্কুলের শিক্ষক ও পরিচালনা পর্ষদকে হঠাৎ করেই অনিয়ম, দুর্নীতি আর অনৈতিক আচরণের একরাশ অভিযোগের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
জাতীয় নির্বাচনের আগে স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার মধ্যে টানা দুদিন ধরে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সরকারও বাধ্য হয়েছে তড়িৎ পদক্ষেপ নিতে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, অরিত্রী তার বাবা-মায়ের অপমান এবং অসম্মানের বিষয়টি মেনে নিতে পারেনি বলেই তাকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হয়েছে।
অরিত্রী অধিকারীর আত্মহত্যার ঘটনায় বিক্ষোভে নামে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা। ফাইল ছবি
স্কুল কর্তৃপক্ষের দাবি, অরিত্রী পরীক্ষায় মোবাইল ফোনে নকল নিয়ে টেবিলে রেখে লিখছিল। তবে স্বজনরা বলছেন, নকলের অভিযোগ সঠিক নয়।
সোমবার অরিত্রীর বাবা দিলীপ অধিকারী ও মা বিউটি অধিকারীকে স্কুলে ডেকে নিয়ে অপমান করা হয় বলে স্বজনদের অভিযোগ। তাদের দাবি, ‘অপমান সইতে না পেরেই’ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় ওই কিশোরী। তবে অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌস অভিভাবকদের অপমান করার কথা অস্বীকার করেছেন।
অরিত্রীর আত্মহত্যার পরদিন মঙ্গলবার ‘আত্মহত্যার প্ররোচনার’ অভিযোগে পল্টনা থানায় অধ্যক্ষসহ ওই তিন শিক্ষকের বিরুদ্ধে মামলা করেন তার বাবা দিলীপ অধিকারী।
এজাহারে বলা হয়, বাসায় ব্যবহৃত একটি মোবাইল ফোন নিয়ে রোববার পরীক্ষা দিতে যায় বিজ্ঞান শাখার ছাত্রী অরিত্রী। পরীক্ষা চলাকালে আফসানা নামের এক শিক্ষক মোবাইল ফোনটি নিয়ে যায় এবং অভিভাবকদের পরদিন স্কুলে ডাকা হয়।
অরিত্রীর বাবা-মায়ের আহাজারি
“তিনি (জিনাত আখতার) আমাদের দেখেই উত্তেজিত হয়ে ওঠেন এবং আমাদের বলেন, আপনার মেয়েকে টিসি দিয়ে দেব। তিনি রাগান্বিত বুঝতে পেরে আমরা তার কাছে ক্ষমা চাই। কিন্তু তিনি বলেন, আমার করার কিছু নাই।”
এরপর ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌসের সঙ্গে দেখা করার জানিয়ে অরিত্রীর বাবা এজাহারে লিখেছেন, “আমার মেয়ে তার নিকট গিয়ে পা ধরে সাথে সাথে ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং সাথে আমরাও করজোরে ক্ষমা ভিক্ষা চাই মেয়ের ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার কথা চিন্তা করে।
“তারপর আমরা একত্রে কেঁদে ফেলি। আমাদের ও অরিত্রীর ক্ষমা প্রার্থনা কোনটাই ১ নং আসামির (অধ্যক্ষ) হৃদয় গলাতে পারেনি। এর মধ্যে আমাদের একটু পরে খেয়াল হল অরিত্রী রুমে নেই।”
অধ্যক্ষের কক্ষ থেকে বেরিয়ে খোঁজাখুজি করে মেয়েকে না পেয়ে বাসায় ফিরে যান দিলীপ ও তার স্ত্রী। বাসায় গিয়ে দেখেন মেয়ে তার ঘরে আছে। কিছুক্ষণ পর নিজের কাজে বাইরে চলে যান দিলীপ। এক সময় স্ত্রী তাকে ফোন করে জানান, অরিত্রীর ঘর বন্ধ। অনেক্ষণ নক করেও কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।
পরে বাসার কেয়ারটেকার সুখদেব বাথরুমের ভেন্টিলেটার দিয়ে ঘরে ঢুকে অরিত্রীকে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে গলায় ওড়না প্যাঁচানো অবস্থায় ঝুলন্ত অবস্থায় দেখতে পান বলে জানানো হয় মামলার এজাহারে।
আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের উপস্থিতিতে সেদিন বিকাল ৩টার দিকে অরিত্রীকে ঝুলন্ত অবস্থা থেকে নামিয়ে প্রথমে কাকরাইল ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে এবং পরে সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে পরীক্ষা নিরীক্ষার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
অরিত্রী বের হওয়ার পরও তার বাবা-মাকে দ্বিতীয়বারের মতো ফিরে এসে অধ্যক্ষের সঙ্গে কথা বলতে দেখা যায়। ওই কক্ষে আরও অনেকে তখন দাপ্তরিক কাজের ব্যস্ততার মধ্যে ছিলেন। দুই অভিভাবক কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে কিছু কথা বলে বিফল হয়ে বেরিয়ে যান।
স্কুলের সামনে গত দুদিন ধরে আন্দোলনে থাকা শিক্ষার্থীদের অনেকেই বলেছে, সহকারী প্রধান শিক্ষক জিনাত আখতারের কক্ষেই সেদিন অরিত্রীর বাবা-মাকেই ‘বেশি অপমানের’ শিকার হতে হয়।
এক শিক্ষার্থী সাংবাদিকদের বলে, “অধ্যক্ষ ম্যাডামের রুমের ফুটেজ তারা দেখাচ্ছে। কিন্তু জিনাত ম্যাডামের অপরাধের প্রমাণতো তারা দেখাচ্ছে না।”
অরিত্রীর এক সহপাঠীর বাবা আসাদুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অরিত্রী অনেক মেধাবী মেয়ে ছিল। আমিও তাকে চিনতাম। সে মোবাইল হয়ত সঙ্গে রেখেছে। সে নকল করতে পারে বলে আমার বিশ্বাস হয় না।”
আর অরিত্রী যদি নকল করেও থাকে, ‘নকলের শাস্তি টিসি হতে পারে না’ বলে বুধবার স্কুলের সামনে ব্যানার টানিয়ে দেয় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা।
এই স্কুলছাত্রীর মৃত্যু নিয়ে দেশজুড়ে আলোচনার প্রেক্ষাপটে মঙ্গলবার একটি তদন্ত কমিটি করেছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তিন দিনে তাদের প্রতিবেদন দেওয়ার কথা থাকলেও শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বুধবারই এক সংবাদ সম্মেলনে এসে প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার কথা জানান।
তিনি বলেন, “এখানে (তদন্ত প্রতিবেদনে) বলা হয়েছে- এই তিনজন (তিন শিক্ষক) অরিত্রীর বাবা-মা যখন আবেদন নিয়ে আসলেন, তারা খুবই অসুস্থ, তাদেরকে ভয়ভীতি দেখান, অরিত্রীর পিতা-মাতার সাথে অধ্যক্ষ, শিফট ইনচার্জের নির্মম ও নির্দয় আচারণ অরিত্রীকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে এবং তাকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করে।
“অরিত্রী পিতা-মাতার প্রতি অপমান এবং অসম্মানের বিষয়টি মেনে নিতে পারেনি বলেই তাকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হয়েছে বলে তদন্ত কমিটির কাছে প্রতীয়মান হয়। যার দায় কোনভাবেই প্রতিষ্ঠানের প্রধান, শিফট ইনচার্জ এবং শ্রেণি শিক্ষিকা এড়াতে পারেন না।”