Published : 28 Mar 2016, 11:12 PM
জাগতিক নিয়মে সকাল হয়। এরপর সুর্য পূব থেকে পশ্চিমে চলে যায়, গ্রীষ্মে রাস্তার পীচ গলে আঠালো হয়, কালবৈশাখী হয়; বর্ষায় মেঘলা আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামে, শরতে পেঁজা তুলো স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়ায়- কিছুই দেখা হয় না এ যান্ত্রিক শহরে। কিন্তু আপনি চান বা না চান, অসংখ্য মানুষ আপনি দেখেন। আমরা কখনো কি তাকিয়ে দেখার ফুরসত পাই এই মানুষের দিকে?
মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।
মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপা রে তুই মূল হারাবি।।
প্রকৃতি দেখার জন্য এই ঢাকা শহরের গণ্ডিটা পার হয়ে যেতে হয়। তবে মানুষ দেখার জন্য এই পৃথিবীর দু'একটা শ্বাপদসংকুল স্থান ছাড়া যেখানেই যাওয়া হোক না কেন যে কেউ চাইলেই এর বৈচিত্র্য অনুভব করতে পারবে। সাধারণ মানুষের বাইরে কিছু মানুষ দেখা হলো, কুষ্টিয়ায়। বলছিলাম মরমী সাধক লালন ফকির ও তাঁর অনুসারীদের কথা। মানুষকে চেনাই যাদের মূল লক্ষ্য ছিল। যখন মানুষেরা জাতপাত আর ছোঁয়াছুঁয়ি নিয়ে কোন্দল করছে তখন এই মানুষ উচ্চারণ করলেন অদ্ভুত এক কথা-
কেউ মালা কেউ তসবি গলে
তাইতে কি জাত ভিন্ন বলে
আসা কিংবা যাওয়ার কালে
জাতির চিহ্ন রয় কি রে।।
দোল পূর্ণিমার সময় ছেঁউড়িয়ায় সাঁইজির আখড়া বাড়ীতে বসেছে সাধূর হাট। তিনদিনব্যাপী লালন স্মরণোৎসবে জমায়েত হয়েছে দেশ-বিদেশের হাজার হাজার সাধুগুরু ও ভক্তকূল। সন্ধ্যার আগে আগেই গেলাম লালন একাডেমী। এসময় কুষ্টিয়া শহরে জ্যামে চলাফেরা করা দুষ্কর। লালনের ভক্ত, লালনপ্রেমী, সাংবাদিকদের ভিড়ে ধূলিময় হয়ে ওঠে শহর। তাই গন্তব্যস্থলের অনেক আগেই মিলপাড়ায় রিকশা ছেড়ে দিতে হলো। যেকোন তীর্থে নাকি পদব্রজই উত্তম, তাই আমিও কুষ্টিয়ার ধূলি পায়ে লাগিয়ে হাঁটা শুরু করলাম।
রাস্তার দুপাশে প্রচুর খাবারের দোকান, এতো দোকান দেখেই বুঝতে পাড়া যায় যে কত মানুষ এখানে আসে! খিচুড়ি-তরকারী সাজানো, নানরুটি আর রুমালী রুটি ভাজা হচ্ছে অবিরাম। দোকানে উচ্চস্বরে গান বাজছে, পথের ধারেই রঙবেরঙের গামছার দোকান, একতারা-দোতারার দোকান। ভক্তরা আখড়ায় ঢুকবার আগে মাথায় বেঁধে নিচ্ছে রঙ্গিন গামছা। ভিড় বাঁচিয়ে যখন লালনের মাজারে গিয়ে পৌঁছুলাম ততক্ষণে বিচিত্র সাজের আর পোষাকের মানুষ দেখে আমার চক্ষু চড়কগাছ।
প্রবেশ তোড়ন পেরিয়ে হাঁটার রাস্তা, দুপাশে তিল ঠাঁই যেন নাহিরে। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত সাধুগণ সাধারণত দল বেঁধে আসেন। একেকটা দল উপরে ত্রিপল টানানো আর নিচে পাটি বিছিয়ে নিজেদের জায়গা দখল করেছে। চার/ পাঁচজনের একেকটি দলে নারী পুরুষ উভয়েই রয়েছে। মাঝে আগরবাতি, মোমবাতি জ্বালিয়ে, বিভিন্ন ফল ফলাদি সাজিয়ে বসে আছে সবাই তন্ময় হয়ে। সন্ধ্যার কিছুটা বাকী তখনো, তাই শিষ্য প্রশিষ্যদের আধ্যাত্মিক সাধনার শ্রেষ্ঠতম অনুপান গঞ্জিকা(গাঁজা) সেবন তখনো শুরু হয়নি তবে চলেছে সাঁইজির আধ্যাত্মিক মর্মবাণী ও ভেদ তথ্যের গান পরিবেশন। মাজার পর্যন্ত পৌঁছাতেই বেশ সময় লেগে গেল। লালনের পুরুষ শিষ্যরা মূলত সাদা আলখেল্লা ও সাদা লুঙ্গী আর নারীরা সাদা শাড়ি পরিধান করে, যাকে তাঁরা বলে খিলবা। খিলবা হলো কাফনসদৃশ পোষাক, তাঁদের ভাষায় জিন্দা দেহে মুর্দার পোষাক। তবে মাজারে এদের পাশাপাশি অনেক লোকজন দেখা গেল, বিভিন্ন বয়সের, পেশার নারী-পুরুষ সেখানে জমায়েত হয়েছে।
লালনের সমাধির মূল অংশের বাইরে অনেকখানি জায়গাজুড়ে চত্বর, সেখানে তাঁর কিছু ভক্ত ও সেবাদাসীর সমাধি রয়েছে। সাদা মূল সমাধিক্ষেত্রের উপরে সুদৃশ্য গম্বুজ। লাইনে দাঁড়িয়ে মূলঅংশে পৌঁছাতে হয়। শুধু লালন সাধকেরাই নয়, সাধারণ লোকজনও বিভিন্ন মানত-শির্নী নিয়ে আসে সেখানে। কিছু ভক্তকে দেখা গেল তন্ময় হয়ে ধ্যানে বসে আছে, যেন তাঁরা আর এই জগতে নেই।
যেকোন গণজমায়েতের স্থানে বিচিত্র ভিক্ষুক এসে জমায়েত হয়, এখানেও তার ব্যতিক্রম নয়। বিভিন্ন ফেরিওয়ালা, কিম্ভূত কিছু ঔষধি গাছের ফল,ডাল, রুদ্রাক্ষের মালা, পাথর কি নেই সেখানে! তাই সর্বদা নিজের মুঠোফোন আর ব্যাগ আঁকড়ে রাখতে হলো। পায়েচলার পথের পাশেই বসে আছে হাত দেখে ভবিষ্যৎ বলে দেবার মতো ধন্যন্ত্বরী জ্যোতিষী, ১০ টাকার বিনিময়ে দর্শনার্থীদের ভূত- ভবিষ্যৎ গড়গড় করে বলে দেন তিনি। লালন সদা সত্যসন্ধানী ছিলেন অথচ তাঁর সমাধিক্ষেত্রেই যতসব মিথ্যা আর ভণ্ডামির আশ্রয়।
কোন দেশে যাবি মন চল দেখি যাই
কোথা পির হও তুমি রে
তীর্থে যাবি সেখানে কি পাপী নাই রে।
লালনের জন্মতারিখ বা শন সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না, তবে শোনা যায় দোল পূর্ণিমার তিথিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বলে লালন জীবদ্দশায় এই খোলামাঠে তাঁর শিষ্যদের নিয়ে সারারাত গান করতেন। হাজার হাজার মানুষ সবাই জমায়েত হয়েছে এক জায়গায়, চোখে তাঁদের ঘোর। কিসের ঘোর? গুরুকে জানার ঘোর, মানুষকে বুঝবার ঘোর!
ভজো মানুষের চরণ দুটি
নিত্যবস্তু হবে খাঁটি
মরিলে সব হবে মাটি
ত্বরা এই ভেদ লও জেনে
সহজ মানুষ…..
তাই সবাই সেখানে বসেছে। বিভিন্ন সাধুদের কাছে ভক্তরা এসে গড় করে প্রণাম করছে, আশির্বাদ নিচ্ছে। ঘুরতে ঘুরতে এক জায়গায় বেশি ভিড় দেখে থমকে দাঁড়ালাম। ৩০/৩৫ বছর বয়স্কা একজন গৌরবর্ণা নারী, চোখে মোটা কালো ফ্রেমের হাল-ফ্যাশনের চশমা, গায়ে একটি ধবধবে সাদা থান জড়ানো- জায়গাটুকু আলোকিত করে পদ্মের মতো বসে আছেন। সে মুখ দীঘির জলের মতোই নিস্তরঙ্গ, শান্ত। পাশে আরো কয়েকজন সাধু বসা অথচ সব ভিড় এ নারীকে ঘিরেই। ৬০/৭০ বছরের বৃদ্ধরা তাঁর আশির্বাদ নিতে লাইন দিয়েছে, যুবকেরাও বাদ যায়নি। একে একে সবাই তাঁর পায়ের কাছে গিয়ে প্রণাম করছে আর তিনি সবার মাথা দু'হাতে চেপে বিড়বিড় করে কিছু উচ্চারণ করছেন। কিসের জন্য এ নারী এরকম সন্ন্যাসব্রত নিয়েছেন? লোকজন কেনইবা তাঁর কাছে যাচ্ছেন? শুধুই কি রূপের মোহে? অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও সে মহিয়সীর ছবি তোলার মতো সুবিধাজনক জায়গা করতে পারলাম না। আফসোস নিয়ে সরে পড়লাম।
৫ টাকা মূল্যের টিকেটের বিনিময়ে লালন জাদুঘরে ঢুকলাম। ঢোকার মুখেই লালনের শিষ্যদের রান্না করার বিশাল একটি পাতিল সাজানো দেখলাম। পাতিলের ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখি খুচরো পয়সা আর দুই টাকা পাঁচ টাকার নোট। মানুষ এখানেও টাকা দিয়েছে! কিছু একতারা-দোতারা, লালনের ব্যবহার্য জিনিসপত্র কাঁচের দেয়ালে ঘেরা। লালনের ঘরের কপাট সংরক্ষিত রয়েছে সেখানে। এতদিন আগের, এরপরও অক্ষত।
আট কুঠুরি নয় দরজা আটা,
মধ্যে মধ্যে ছরকা কাঁটা।
তার উপরে শহর কোঠা,
আয়না মহলটায়…
জাদুঘর থেকে বেড়িয়ে দেখি লোকজনের ভিড় আরও বেড়েছে। মাইকে অনবরত কেউ বলছে "কেউ ডিম্বক রন্ধন করিবেন না, বা খাইবেন না। কেউ যদি করে বা আপনি করতে দেখেন তাঁকে ধরিয়ে দিন" । লালনের ভক্তকূল নিরামিষাশী। সেখানে যে কয়দিন অবস্থান করবেন অন্তত সে কয়দিন তাঁরা মাছ/মাংস/ডিম স্পর্শ করবে না। তাই এ সতর্কতামূলক বাণী। সামিয়ানা ঘেরা এক বিশাল জায়গাজুড়ে রান্না হচ্ছে, বড় বড় সসপ্যান ভর্তী খাবার চুলা থেকে নামছে, রান্নাঘরের মুখে নিরাপত্তাবাহিনীর পাহারার ব্যবস্থা। তার বাইরেই লালন ফকিরের এক আবক্ষ মূর্তির সামনে বেশকিছু ত্রিশুল পোঁতা রয়েছে, অনেকেই সেখানে এসে সুতা বেঁধে দিয়ে যাচ্ছে।
এক গুরুমা বসে আছেন, পাশে তাঁর ভক্তকূল, সামনে হারমোনিয়াম, কেউ একজন তালপাখা দিয়ে তাঁকে বাতাস করছেন। সেসময়ে আমার হঠাৎ হাত দেখানোর খায়েশ হলো, জ্যোতিষ মহাশয় বিভিন্ন কথা বলার পর জানালেন – আমার হাতে ভ্রমণ রেখা প্রকট। তবে একা নয়, ভ্রমণ হবে স্বামীর সাথে!
বের হবার মুখেই দেখি সাধুবাবা দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁর মুখের কুচকুচে কালো দাঁড়ি পৌঁছে গেছে হাটু পর্যন্ত। বেশ যত্নে রাখেন তা দাড়ির চেকনাই দেখেই বুঝা যাচ্ছিল।
রাস্তার অপরপাড়ে তখন আরেক মহাযজ্ঞের প্রস্তুতি চলছে। মেলা বসেছে, আর দশটা গ্রামীণ মেলার মতো ওখানে চুড়ি-মনোহারী, বাঁশের বাঁশি, খেলনা, মিষ্টি-বাতাসা, খই-চিড়া সবই মেলে, ফাও হিসেবে রয়েছে অনেক ডিম আর চিংড়ি চপের দোকান। বলা হয় নিষিদ্ধে আকর্ষণ বেশী আর তাই ডিম চপের দোকানে ভিড়ও সবচেয়ে বেশি। একজন হাতে করে ধূপ-ধুনো নিয়ে প্রতি দোকানে দুই টাকার বিনিময়ে ধোঁয়া দিয়ে যাচ্ছে। খোলা মাঠে টানানো শামিয়ানার নিচে অন্ধকারের জমছে আর বাতাস মিশে যাচ্ছে গাঁজার ধোঁয়া। এই মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষায় সারাদিনমান বসে ছিল সাধককুল। তবে তাঁদের মধ্যে সাধু কতজন তা নিয়ে ভ্রম থেকেই যায়। জিন্স পড়ুয়া শহুরে ছাপমারা ভক্তেরও কমতি নেই। কতজন গানের সাধক আর কতজন গঞ্জিকার সাধক সে তীর্থের যাত্রী তা অপরিমেয়।
আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি, বিশাল গোলাকার চাঁদ। পূর্ণচন্দ্র আলো ছড়াচ্ছে, আলোয় ভেসে যাচ্ছে পৃথিবী। আমরা ডাবের পানি পান করলাম। ফেরার মুখে হাতের বামে রয়েছে নবপ্রাণ আখড়াবাড়ি, ঢোকার মুখেই লেখা "ধূমপান মুক্ত এলাকা', এ যেন মরুভূমিতে একটুকরা মরূদ্যান। সেখানে প্রদীপ জ্বালানো হয়েছে বাড়িময়, যেন কোন দীপাবলির রাত্রে এসে পড়েছি। মোমবাতি জ্বালিয়ে লালনের গানের আসর বসানো হয়েছে। স্নিগ্ধ আলোয় সবাই তন্ময় হয়ে গান শুনছে, বাজছে একতারা, খোল-করতাল, হারমোনিয়াম। লালনের সুর ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে। একঝাঁক গেরুয়াপড়া কিশোর-কিশোরীদের সাথে দেখা হয়ে গেল। ওঁরা এসেছে দৌলতপু্রের "বাউল অবিরাম লালন একাডেমী" থেকে। ছবি তুলতে চাইলে সানন্দে রাজি হলো।
লালনের গানে মানুষ ও তার সমাজই ছিল মুখ্য। লালন বিশ্বাস করতেন সকল মানুষের মাঝে বাস করে এক মনের মানুষ। তিনি সবকিছুর উর্ধ্বে মানবতাবাদকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছিলেন। তার বহু গানে এই মনের মানুষের প্রসঙ্গ উল্লেখিত হয়েছে। তিনি বিশ্বাস করতেন মনের মানুষের কোন ধর্ম, জাত, বর্ণ, কূল নেই। মানুষ দুধরণের- নারী ও পুরুষ। দ্বিদলের মৃণাল অর্থাৎ দুই পাপড়ির এক পদ্মে একটি নারী অপরটি পুরুষ।
দ্বিদলে মৃণালে
সোনার মানুষ উজলে।
মানুষ গুরুর কৃপা হলে
জানতে পাবি।।
মানুষের দৃশ্যমান শরীর এবং অদৃশ্য মনের মানুষ পরস্পর অবিচ্ছিন্ন। সকল মানুষের মনে ঈশ্বর বাস করেন। লালনের এই দর্শনকে কোন ধর্মীয় আদর্শের অন্তর্গত করা যায় না। লালন, মানব আত্মাকে বিবেচনা করেছেন রহস্যময়, অজানা এক সত্তা রূপে। তিনি ছিলেন জন্মান্তরবাদী। তাই তাঁর মতাদর্শে সন্তান উৎপাদন নিষিদ্ধ। কারণ আত্মা থেকে যেহেতু সন্তান উৎপন্ন হয় এতে আত্মা খন্ডিত হয়।
পিতার বীজে পুত্র সৃজন
তাইতো পিতার পুনর্জনম
১৮৯০ সালের ১৭ই অক্টোবর লালন ১১৬ বছর বয়সে কুষ্টিয়ার কুমারখালির ছেউড়িয়াতে নিজ আখড়ায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর দিন ভোর ৫টা পর্যন্ত তিনি গানবাজনা করেন এবং এক সময় তার শিষ্যদেরকে বলেন: "আমি চলিলাম'' এবং এর কিছু সময় পরই তার মৃত্যু হয়।
পার কর হে দয়াল চাঁদ আমার
ক্ষমহে অপরাধ আমার
এই ভব কারাগার
আমরা এই আধুনিক যুগে এসেও জাতপাতের ব্যবধান ঘোচাতে পারিনি। লালনের মতাদর্শে সবার পরিচয় শুধুই মানুষ। আর তাই তিনি বলেছেন- মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।
আর্টস বিভাগে প্রকাশিত জাকিয়া সুলতানার আরও লেখা: