Published : 30 Apr 2022, 08:46 PM
বেদে জনগোষ্ঠীর গায়ের রং কালো, মাথার আকৃতি বিস্তৃত, চুল প্রচুর কোঁকড়ানো এবং রুক্ষ, নাক মোটা, উচ্চতা মাঝারি, ঠোঁট মোটা বা ভারী। দেহ বলিষ্ঠ ও আকর্ষণীয়। বর্তমানে বাংলাদেশে এ রকম দেহ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন বেদে জনগোষ্ঠীর দেখা মেলে। এখন নৃতাত্ত্বিক সমীক্ষার মাধ্যমে দেখা যাক বেদে জাতটি আসলে কোন জাতিসত্তার প্রতিনিধিত্ব করছে। মাথার বিস্তৃতি দেখে মনে করা যেতে পারে যে এরা মঙ্গোলয়েড জাতের কোনো উপগোষ্ঠী। কেননা মঙ্গোলয়েডদের মাথা অপেক্ষাকৃত প্রশস্ত এবং এদের দেহের উচ্চতাও মাঝারি যা কিনা বেদে জনগোষ্ঠীর সাথে সাযুজ্যপূর্ণ। অথচ চুলের রং বাদামি এবং রুক্ষ হলেও কোঁকড়া নয়। অন্যদিকে কোঁকড়া এবং লালচে বা কালচে বাদামি চুল নিগ্রয়ড জাতের বৈশিষ্ট্য এবং তাদের গায়ের রংও কালো। ঠোঁট মোটা, মুখের গড়নও নিগ্রয়ডদের মতো মাঝারি। এ প্রসঙ্গে নিগ্রয়ডদের একটি উপজাত অস্ট্রালয়ডের একটি শাখা আদিম অস্ট্রেলীয়দের কথা বলা যায়। এদের সাথে প্রটো-অস্ট্রালয়ডদের দৈহিক মিল ছাড়াও রক্তের মিল রয়েছে। ভারতের আদি-অস্ট্রাল এবং অস্ট্রেলিয়ার এই আদিম অধিবাসীদের রক্তে 'এ' গ্লুটিনোজেনের শতকরা হার খুব বেশি।১১চাক ও ঠার ভাষা
বেদে ভাষা 'ঠার' প্রসঙ্গে বিজ্ঞজনরা বলেন, বেদেরা যে ভাষায় কথা বলে তা বাংলাদেশের চাক জাতির চাক ভাষার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ।৪ বাংলাদেশের চাকরা বান্দরবান জেলায় বাস করে। বার্মার রাখাইন রাজ্যেও তাদের বড় অংশের বসতি। সেখানে তারা সাক বা থেক নামে পরিচিত।
'চাক'দের দেহ বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে বেদেদের কোনো মিল নেই। চাকরা মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠীর লোক। গায়ের রং ফরসা, চুল কালো সোজা, শরীরে পশম কম, ঠোঁট পুরু যা বেদে দেহ বৈশিষ্ট্যের বিপরীত।
বেদেরা নৃতাত্ত্বিকভাবে প্রটো-অস্ট্রালয়ড বা আদি অস্ট্রাল হলেও এদের ভাষা চীনা-তিব্বতি ভাষা পরিবারের অন্তর্গত বলে জানান গবেষকরা। পরিসংখ্যানে জানা যায় বাংলাদেশে চীনা-তিব্বতি ভাষা পরিবারের সদস্যসংখ্যা ৫,৩১,০০০ জন। এরা মোট ১৫টি ভাষায় কথা বলে, যা এই ভাষা পরিবারভুক্ত। আর ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষার অবস্থানগত পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে ১৯৯১ সালের পরিসংখ্যান মতে ঠারভাষী বাংলাদেশি বেদের সংখ্যা ৪০ হাজার। জনসংখ্যার ভিত্তিতে এই পরিসংখ্যানের অর্থ হলো ঠারভাষীর অবস্থান এই পরিবারের ভাষা সদস্যদের মধ্যে চতুর্থ। এর আগে রয়েছে যথাক্রমে–মারমাভাষী, গারো আচিক/মান্দীভাষী এবং ত্রিপুরা–কক বোরকভাষী জনগোষ্ঠী।
বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষা প্রসঙ্গে ড. সৌরভ সিকদার বলেন, '১৬৩৮ সালে শরণার্থী আরাকানরাজ বল্লালরাজের সঙ্গে মনতং জাতির যে ক্ষুদ্র অংশ বাংলাদেশে প্রবেশ করে তাদের ভাষার নাম ঠার বা ঠেট বা থেক ভাষা।'৫
অথচ ঐতিহাসিক নৃতত্ত্বের ভিত্তিতে প্রমাণিত হয়েছে যে, বল্লালরাজের সঙ্গে যে জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে আসে তারা মনতং নামের কোনো স্বতন্ত্র ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী নয় বরং মঙতঙ নামধারী মারমা আদিবাসী এবং তাদের ভাষা ঠার নয় বর্মি। এটি তিব্বতি-বর্মিজ (লোল বর্মিজ) পরিবারের ভাষা।
'মান্তা সম্প্রদায়ের জীবিকার সংকট ও জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের পন্থা উদ্ভাবন' গ্রন্থে শংকরলাল দাশ মান্তাদের ভাষা সম্পর্কে বলেন, 'মান্তা সম্প্রদায়ের বহু মানুষ জানিয়েছে যে, তাদের ভাষার সঙ্গে বেদেদের ভাষার হুবহু মিল রয়েছে। তারা যখন বেদে সম্প্রদায়ের লোকদের সঙ্গে কথা বলে তখন নিজেদের ভাষা ব্যবহার করে। একই ভাষার ব্যবহার ছাড়াও উভয় সম্প্রদায়ের মানুষের পরস্পরের আকার-ইঙ্গিত একই রকম। ভাষার সাদৃশ্য উভয় সম্প্রদায়ের মানুষকে এক সূত্রে গেঁথে ফেলেছে।'৬৭ কেননা উভয় ভাষা একই ভাষা পরিবারের সদস্য। এ অবস্থায় এ দুটি ভাষার সাংগঠনিক কাঠামো ও শব্দভাণ্ডারের তুলনামূলক বিচার-বিশ্লেষণ জরুরি হয়ে পড়ে। কেননা একই উৎস থেকে আসা ভাষাগুলোতে শব্দ ও ভাষার সাংগঠনিক কাঠামোতে সাদৃশ্য থেকে যায়।
চাকরা পার্বত্য চট্টগ্রমের বান্দরবান জেলার বাইশারি, নাইক্ষ্যংছড়ি, আলিখ্যং, কোয়াংঝিরি, কামিছড়া, ক্রোক্ষ্রং প্রভৃতি মৌজায় বাস করে। মিয়ানমারে তাদের বড় অংশের বাস রয়েছে। সেখানে তাদের সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার এবং সেখানে তাদের আরেক নাম সাক বা থাক। এদের ভাষা চীনা-তিব্বতি পরিবারের সাক-লুইশ শাখার অন্তর্গত। বেদেদের ঠার ভাষার মতো চাক ভাষার কোনো বর্ণমালা নেই। নৃতত্ত্বের বিচারে বেদেরা অস্ট্রাল আর চাকরা মঙ্গোলীয়। এ ছাড়া ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে চাকদের সঙ্গে বেদেদের তেমন কোনো সাদৃশ্য নজরে আসে না। কোনো জাতির ভাষায় তার ভৌগোলিক ও সাংস্কৃকি প্রভাব অনিবার্য। সে বিচারে বেদেদের সঙ্গে চাকদের ভাষার কোনো সাদৃশ্যও নজরে আসে না। ঠার ভাষার মতো চাক ভাষার কোনো বর্ণমালা নেই। নিচে বেদেদের ঠার ভাষা ও চাক ভাষার তুলনামূলক চিত্র দেওয়া হলো :
চাক ভাষা চিনা-তিব্বতি ভাষা পরিবারের সাক-লুইশ গোত্রের একটি ভাষা। এর স্বরধ্বনিগুলো হলো– ই, এ, অ্যা, আ, অ, উ। অন্যদিকে ঠার ভাষায় স্বরধ্বনি পাওয়া যায় সাতটি। ই, এ, অ্যা, আ, অ, ও, উ। চাক ভাষায় যে স্বর টোনাল বৈচিত্র এর উচ্চারণকে কঠিন করে।৮ ঠার ভাষায় তার দেখা মেলে না। আবার চাক ও ঠার ভাষার বাক্য গঠনরীতি বাংলার মতোই কর্তা+কর্ম+ক্রিয়া ক্রমধারা অনুসরণ করে। তবে আশ্চর্যের বিষয় এই যে, চাক ভাষার শব্দের সঙ্গে ঠার ভাষার ন্যূনতম ঋণ শব্দের দেখা পাওয়া যায় না। সারণিতে দেখা যায় ১৪টি শব্দের মধ্যে একটি (আমি-আং-ঙা) মাত্র শব্দের সাদৃশ্য রয়েছে। বাংলাদেশে বসবাসরত বেদেদের সঙ্গে বান্দারবানের চাক জাতির তেমন কোনো সম্পর্ক গড়ে না ওঠার কারণে ঠার ভাষায় চাক ভাষার প্রভাব প্রকটভাবে লক্ষ করা যায় না। এ ছাড়া বাংলাদেশের বেদেদের বসবাসের বা বিচরণের ক্ষেত্রও সম্পূর্ণভাবে আলাদা। তারা বাংলাদেশের নদীবিধৌত সমভূমি অঞ্চলকেই বসবাসের জন্য নির্ধারণ করে থাকে এবং এই বাসস্থান স্থায়ী হয় না। নির্দিষ্ট সময় পর তারা আবার পাট চুকিয়ে চলে যায় অন্যত্র যেখানে জীবিকার সম্ভাবনা আছে। অতএব দেখা যাচ্ছে যে বাংলাদেশের বেদেদের জন্য চাক ভাষা আধিপত্যবাদী ভাষা নয় বরং বাংলা ভাষাই তাদের কাছে আধিপত্যবাদী ভাষা হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশের বেদেদের সবচেয়ে বড় বাসস্থল– ঢাকা, সাভার, চাঁদপুর, মতলব; মানিকগঞ্জ, সাটুরিয়া, সুনামগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ প্রভৃতি অঞ্চল। এসব অঞ্চলে ঠার ভাষায় চাক ভাষার শব্দ বা ধ্বনিঋণের সুযোগ কম।
ড. সিকদার সাক-লুইশ শাখার যে গোত্রটিকে বেদেদের ঠার ভাষা বলে উল্লেখ করেছেন তা আসলে ঠার নয়, তা উত্তর বার্মার থেক বা ঠেক ভাষা। এটি সাক বা আসাক ভাষার সমগোত্রীয়। তিনি থেক শব্দের বিবর্তন অর্থাৎ অপভ্রংশ (থেক/ঠেক/ঠের/ঠার) হিসেবে ঠার ভাষাকে বেদেদের ভাষা বলে উল্লেখ করেছেন। ফলে ঠার ভাষা আদৌ সাক-লুইাশ শাখার ভাষা কিনা সে বিষয়েও প্রশ্ন থেকেই যায়!
ঠার ভাষায় রমানি ভাষার প্রভাব
অন্য এক দল গবেষক বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষায় এশিয়া ইউরোপের বিভিন্ন ভাষার প্রভাব লক্ষ্য করেছেন। গবেষকরা বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষাকে ইন্দো-ইরানিয় 'রমানি 'ভাষা বলে উল্লেখ করেন। ভাষা বিজ্ঞানীরা বেদেদের ভাষাকে ভারতীয় আর্য ভাষা বলেই চিহ্নিত করেছেন।৯ এদের মধ্যে আছেন ড. উলিখ, আর এল টার্নার, ড. কোচানোউস্কি, ড. ডব্লিউ আর রিশি প্রমুখ পণ্ডিত।১০ কিন্তু এই মন্তব্য বাংলাদেশের বেদেদের ক্ষেত্রে কিছুতেই প্রযোজ্য নয় । রমানি বাংলাদেশের বেদেদের ভাষা নয় বরং ভারতের বাদিয়াদের ভাষা যারা বাঞ্ছার, নাটরা, বাওরিস, বিলক ভাঙ্গি, বান্টু বা চুরাদের মতোই স্থলচারী যাযাবর। ভারতের এই বাদিয়াদের সঙ্গে বাংলাদেশের বেদেদের বিস্তর ফারাক। বাংলাদেশে সিরাজগঞ্জ অঞ্চলে যেসব বাদিয়া আছে তাদের সংস্কৃতির সঙ্গে বেদেদের সংস্কৃতিরও মিল নেই। বাংলাদেশে এরা সাদরি ভাষায় কথা বলে। এটি ইন্দো-আর্য পরিবারের ভাষা। ভারতে বাদিয়ারা আবার রমানি ভাষায় কথা বলে বলে একমত পোষণ করেন জিপসি গবেষকরা। নিচে রমানি ও বাংলাদেশের ঠার ভাষার নমুনা দেওয়া হলো, যা থেকে বোঝা সম্ভব হবে যে, ঠার ও রমানি একই ভাষা গোত্রের ভাষা নয় এবং বেদেদের ভাষাকে রমানি বলেও মেনে নেওয়া যায় না। এটি একটি স্বতন্ত্র ভাষা, যা বাংলাদেশের বেদেদের নিজস্ব ঐতিহ্য।
ঠার ভাষায় ঋষি ঠার-এর প্রভাব
এদিকে ঠার ভাষা নিয়ে আলোচনা আরো জটিল হয়েছে তখন, যখন জানা গেল ঠার কেবল বেদেদের ভাষার নাম নয়, ঋষিদের ভাষারও নাম। গবেষণায় দেখা গেছে বেদেদের মতো ঋষি বা মুচি নামক অন্ত্যজ শ্রেণির জনগোষ্ঠীও ঠার ভাষায় কথা বলে। আর উভয় গোত্রের ভাষার মধ্যেও বিস্তর পার্থক্যও রয়েছে। ফাদার যোসেফ রানা মণ্ডল তার 'রাঢ় সমতটে খ্রিষ্ট ধর্ম ' গ্রন্থে ঋষিদের ঠার ভাষা সম্পর্কে বলেন, 'ঋষিদের এই ঠার ভাষা আজ বিলীনের পথে। এদের মধ্য থেকে যারা আজ শিক্ষিত হয়েছে, তাদের অনেকেই এই ভাষা আজ ভুলে গেছেন অথবা নিজেদের ভাষা বলতে আজ অস্বীকার করেন।'১১ ফলে ঋষি ঠার ভাষার খুব বেশি নমুনা পাওয়া যায় না। নিচে যোসেফ রানা মণ্ডল কর্তৃক গৃহীত ঋষি ঠার ভাষার নমুনার সঙ্গে বেদে ঠার ভাষার নমুনা তুলে দেওয়া হলো :
সারণিতে দেখা যাচ্ছে যে ঋষি ঠার-এর সঙ্গে বেদে ঠার-এর পার্থক্য বিদ্যমান। এ অবস্থায় প্রশ্ন জাগে ঠার যদি চিনা-লুইশ গোত্রের ভাষা হয় বা রমানি গোত্রের ভাষাও হয় তবে সেটি কোন ঠার, বেদে-ঠার নাকি ঋষি-ঠার? ভাষাবিজ্ঞানীরা সাক-লুইশ গোত্রের যে ভাষাটিকে থেক বলেছেন ড. সিকদার সেটিকে ঠার বলে শনাক্ত করার চেষ্টা করেছেন কিন্তু যেহেতু বেদেদের ভাষার কোনো লিখিত রূপ নেই তাই ড. সিকদার এই ভাষার কোনো নমুনা দিতে পারেননি। তবে আমরা নানা আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে দিয়ে যদি এ কথা বলতে চাই যে, বেদেদের ভাষা বা ঋষিদের ভাষা কোনোটাই সাক-লুইশ গোত্রের ভাষা নয়, তাহলে তাদের ভাষাকে কী বলা যায়? এটা কি আদৌ কোনো ভাষা, নাকি উপভাষা, নাকি নিভাষা, নাকি তা অপার্থ বা সাংকেতিক ভাষা?
বেদে জনগোষ্ঠীর ঠার ভাষা কোনো উপভাষা নয়। উপভাষা হলো ছোট ছোট দলের বা কোনো অঞ্চলের বিশেষভাবে প্রচলিত ভাষাছাঁদ। এ বিচারে চট্টগ্রাম বা সিলেট অঞ্চলের বাংলাভাষীদের ভাষাছাঁদ আলাদা আলাদা উপভাষা কিন্তু বেদেদের ঠার ভাষা কোনো উপভাষা নয়। কেননা তাদের এই ভাষার মধ্যে আঞ্চলিক পার্থক্য যেমন আছে, তেমনি গোত্রে গোত্রে ঠার ভাষার শব্দবৈচিত্র্যও আছে। বেদেদের প্রধান দুটি গোত্রে ও একটি উপ-উপগোত্রের ব্যাপক শব্দবৈচিত্র্য রয়েছে; যা এ ভাষাকে জটিলতার মধ্যে ফেলে দিয়েছে।
তাহলে এটা কি সাংকেতিক ভাষা? বেদেদের ঠার ভাষা প্রসঙ্গে নাজমুন নাহার লাইজু বলেন, 'বেদে সমাজে নিজস্ব সাংকেতিক ভাষা প্রচলিত রয়েছে। বেদেরা এই ভাষাকে ঠার ভাষা বলে অভিহিত করে। ঠার-এর অর্থ হলো উল্টো ভাষা। বেদেরা নিজ সমাজে এই ভাষায় কথা বলে।'১২ এদিকে ড. অসিতবরণ পালও তার গবেষণায় বেদেদের ভাষাকে সাংকেতিক ভাষা বলেই শনাক্ত করেছেন। তবে আমরা বেদের ভাষাকে সাংকেতিক ভাষা হিসেবেই শনাক্ত করতে চাই না। কেননা সুকুমার সেন বলেন, 'গোপনীয় তথ্য সরবরাহের জন্য অথবা অসৎ উদ্দেশ্যে দলের লোকের কাছে প্রকাশ্যে অন্যের অবোধ্য অথচ প্রয়োজনীয় সংলাপ স্বাভাবিকভাবে চালাইবার জন্য বিশেষ বিশেষ (এক বা একাধিক ভাষা হতে গৃহীত) শব্দ বিশেষ বিশেষ অর্থে ব্যবহার করা হয়। এ রকম বাগ্্ব্যবহারকে অপার্থ-ভাষা অথবা সংকেত-ভাষা বলা হয়।'১৩ এ রকম ভাষার মধ্যে ঠগীদের রামসিয়ানা ভাষার উল্লেখ করেন ড. সেন। রামসিয়ানা শব্দের অর্থ হলো রাম-চালাকি অর্থাৎ বড় রকম ফাঁকি। বেদেদের ভাষা এই অর্থে সাংকেতিক নয়। আবার অপরাধ জগতের বা দুর্বৃত্তদের গোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত ভাষাই যে কেবল সাংকেতিক ভাষা হিসেবে সব সময় ব্যবহৃত হবে, তা নয়।
বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষা কি অপরাধ জগতের ভাষা?
গবেষকগণ প্রায়ই সাংকেতিক ভাষাকে অপরাধ জগতের ভাষা বলে শনাক্ত করতে চান। অপরাধ জগতের সব ভাষাই সাংকেতিক ভাষা হতে পারে কিন্তু সব সাংকেতিক ভাষাই যে অপরাধ জগতের ভাষা, এমনটা নয়। অপরাধ জগতের বা নিষিদ্ধ জগতের ভাষার মধ্যে কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা অন্য সাংকেতিক ভাষার সঙ্গে নাও মিলতে পারে। নিষিদ্ধ জগতের ভাষার অধিকাংশ শব্দই দেশি ভাষার শব্দ বা শব্দার্থ ও রূপালংকারের মাধ্যমে পরিবর্তিত হয় বা হয়ে থাকে। যেমনÑস্বর্ণালংকারকে পাশ্চাত্যের অপরাধ জগতের ভাষায় 'বরফ' বলা হয়। আবার হেরোইন কোকেনও 'বরফ'। বারবণিতার কাজ বোঝাতে অপরাধ জগতের ভাষায় 'লি-বিঝনেস' বলা হয়। ড.আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ তার 'আধুনিক ভাষাতত্ত্ব' বইয়ে জানান, 'অপরাধ জগতের ভাষার বৈশিষ্ট্য লক্ষ করলে দেখা যায়, তাদের শব্দভাণ্ডারে একটি আন্তর্জাতীয় প্রভাব বিদ্যমান।'১৪ যেমন আমেরিকার অপভাষা (উচ্চারণ বিকৃত বা শব্দ প্রয়োগ বিকৃত ত্রুটিপূর্ণ শব্দ বা ভাষা) অন্যান্য দেশের অপরাধ জগতের ভাষায় ব্যবহৃত হতে দেখা যায়।১৫
নিচে অপরাধ জগতে ব্যবহৃত কতগুলো শব্দের নমুনা দেওয়া হলো
এখন, বেদে জনগোষ্ঠীকে কি অপরাধপ্রবণ গোষ্ঠী হিসেবে শনাক্ত করা যায়? ব্রিটিশ শাসন আমলে কতিপয় ক্ষুদ্র যাযাবর গোষ্ঠীকে অপরাধপ্রবণ হিসেবে শনাক্ত করা হয়, যাদের মধ্যে বেদেরাও ছিল। অথচ বেদেরা উপমহাদেশের প্রাগৈতিহাসিক কালপর্ব থেকে যে এ দেশের ভূমিজ, তার প্রমাণ রয়েছে প্রাচীন সব সাহিত্যে। প্রাচীনকালে তারা রাজপুরুষের মর্যাদা পেতো বলে জানা যায়। তাদের মৌখিক সংস্কৃতিও বেশ ঋদ্ধ ছিল। বেদেদের রয়েছে নিজস্ব বস্তুগত ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি, নিজস্ব বিবাহ সংস্কার, গান, লোকসাহিত্য, চিকিৎসা পদ্ধতি আর ভাষা। বেদেদের গানের সুর থেকে সৃষ্টি হয়েছে সংগীতের বিশেষ রাগ, যার নাম মালকোষ। যাদের সংস্কৃতি এতটা ঋদ্ধ, তারা কেনো 'গোপন তথ্য সরবরাহ' বা 'অসৎ উদ্দেশ্যে' ঠার ভাষা ব্যবহার করবে, তা মেনে নেওয়া যায় না। তবে কেন তাদের ভাষাকে গোপন সাংকেতিক ভাষা বলা হয়?
অপরাধপ্রবণ জাতির তালিকায় ভাগ্যলিপি বাঁধা পড়ার পর থেকে তাদের ভাষার ওপর আরোপ করা হয় এই অপবাদ। অথচ গোপন সাংকেতিক ভাষা কেবল যে অপরাধ জগতের ভাষা, তা নয়; এটি গোয়েন্দা সংস্থার কর্মী, সাংবাদিক ও স্পাইরাও ব্যবহার করেন। ড. সেন জানান, চর্যাগীতিতেও এই রকম অপার্থ-শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, যাকে প্রচীন টিকাকারগণ সান্ধ্য ভাষা বলেছেন। বেদেদের ভাষায় কি সেই রকম অপার্থ শব্দ আছে, যে রকমটা অপরাধ জগতের মানুষেরা ব্যবহার করে? এর উত্তর : না। কেননা সাংকেতিক ভাষা ব্যবহার করে গোয়েন্দা সংস্থার কর্মী, সাংবাদিক ও স্পাইরাও। কিন্তু সেই সব কোড পুলিশ জেনে গেলে শব্দটি পাল্টে ফেলে অপরাধীরা। পুলিশ বা সাংবাদিকরাও তাই। কিন্তু বেদেদের ক্ষেত্রে তেমনটা দেখা যায় না।
গোত্রে গোত্রে তাদের ভাষার শব্দ ও শব্দার্থ আলাদা বলেই এ কথা বলার কোনো সুযোগও নেই যে, তারা অপরাধপ্রবণ জাতি বা তাদের ভাষা অপরাধ জগতের ভাষা। বরং বেদেদের ভাষার ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য লক্ষ করলে দেখা যায়, তাদের ভাষায় সমার্থক শব্দের আধিক্য এত বেশি, যা একটি পূর্ণাঙ্গ এবং সমৃদ্ধ ভাষার ইঙ্গিতবাহী। কোনো সাংকেতিক ভাষায় এরূপ সমার্থক শব্দের ব্যবহার নেই। এ কথা সত্যি যে, বেদেদের গোত্রে গোত্রে ঠার ভাষার পার্থক্য বাংলাদেশের বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষার ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য নির্ণয়ের ক্ষেত্রে নানা রকম জটিলতা তৈরি করেছে।
আঞ্চলিক ভাষায় 'ঠার' শব্দের অর্থ 'ইঙ্গিত' হলেও বেদেদের নিজের ভাষায় 'ঠার' মানে 'ভাষা বা কথা'। আর ভাষা বিজ্ঞানে এটি কেবল একটি ভাষার নামমাত্র। যেমন বাংলা একটি ভাষা, থেক, আসেক, সাঁওতাল বা মান্দি যেমন আলাদা আলাদা ভাষা, তেমনই ঠারও। 'ঠার' সাক-লুইশ শাখার (যদিও বিষয়টি চূড়ান্তভাবে নিশ্চিত নয়) একটি স্বতন্ত্র ভাষা ছাড়া কিছুই না। না এটা অপার্থ বা সংকেত ভাষা, না অপরাধ জগতের ভাষা।
মূল ভাষাকে বিশেষ রকম ভাষাছাঁদে উপস্থাপন করার কারণে নানা রকম উপভাষার উৎপত্তি হয়। সামাজিক উপভাষায় উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত ভাষাভাষীদের ভাষাগত পার্থক্য যেমন লক্ষ্যণীয়, তেমনি শিক্ষিত ও অশিক্ষিত সম্প্রদায়ের ভাষায় উচ্চারণগত বৈষম্য সহজে নজরে আসে। এ ছাড়া শহর-গ্রামের জনগোষ্ঠীর ধর্ম সম্প্রদায়ের রূপমূল ব্যবহারেও পার্থক্য দেখা যায়। কিন্তু তা মূল ভাষাকে আংশিকভাবে পাল্টাতে পারে। আঞ্চলিকতার ক্ষেত্রে উচ্চারণ পার্থক্য সবচেয়ে বেশি নজরে আসে। এ ছাড়া রূপমূলের ধ্বনিগত পরবর্তন বা উচ্চারণগত বৈষম্য, মানুষের দৈনন্দিন জীবনের পরিবেশগত দিক রূপমূলের মাধ্যমেই পাওয়া যায়। কিন্তু বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষার ক্ষেত্রে গোত্রে গোত্রে রূপমূলের ভিন্নতা এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য, তার ওপর আঞ্চলিকতার প্রভাব তো আছেই। নিচে বেদেদের গোত্রভিত্তিক কিছু শব্দ বৈচিত্র্য দেখানো হলো :
একই ভাষা সম্প্রদায়ের মধ্যে ধর্মনীতি, আচার-ব্যবহার, সমাজনৈতিক-রাজনৈতিক আচারণ ও ঐতিহ্যে যেমন সমতা নেই, তেমনি একই ভাষা সম্প্রদায়ের সবাই যে অবিকৃতভাবে সেই ভাষায় কথা বলে, তাও নয়। বেদে জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রেও একই চিত্র লক্ষ করা যায়। পাশাপাশি অঞ্চলে কথিত ভাষার ক্ষেত্রে সাধারণত এমন বৈষম্য স্পষ্ট হয় না, অথচ বেদেদের ভাষার ক্ষেত্রে দেখা যায়, একই অঞ্চলে বসবাসরত ভিন্ন গোত্রের বেদেদের ভাষায় রূপমূলগত পার্থক্য রয়েছে। আবার একই গোত্রের ভাষায় তার ভৌগোলিক অবস্থার কারণে যে পার্থক্য সূচিত হয়, তা কেবল ধ্বনিগত নয়, রূপমূলগতও। নিচে বেদে জনগোষ্ঠীর মাল গোত্রের ভাষার আঞ্চলিক পরিস্থিতি দেখানো হলো।
আঞ্চলিকতার ক্ষেত্রে ভাষার পরিবর্তন সূচিত হয় ধ্বনি পরির্বতনের মধ্য দিয়ে এবং এটাই স্বাভাবিক। সারণিতে ঠার ভাষার 'বতন' রূপমূল আঞ্চলিক ঠারে 'বইতন' বা 'বতুন'রূপে ব্যবহৃত হয়েছে, যা অত্যন্ত সাধারণ প্রক্রিয়া। কিন্তু এখানে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভিন্ন ভিন্ন রূপমূল ব্যবহৃত হয়েছে, যা ঠার ভাষার ক্ষেত্রে বিস্ময়!
ঠার ভাষায় বাংলাভাষার প্রভাব
হাজার বছর ধরে অনেক চড়াই উৎরাই আর ভাঙ্গা- গড়ার মধ্য দিয়ে বাংলাভাষা আজকের অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে। এখন বিশ্বে জনসংখ্যার ভিত্তিতে বাংলাভাষার অবস্থান পঞ্চম। বাংলাদেশ ও ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের বাংলা ভাষাভাষীর সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে অষ্ট্রিক ও দ্রাবিড় ভাষী মানুষের সঙ্গে। এসব মানুষের অনেকেই বাংরা ভাষাকে নিজের ভাষারূপে গ্রহণ করেছে। ফলে পরবর্তী প্রজন্মের মাতৃভাষা হিসেবে রূপান্তর ঘটে বাংলাভাষার। একই ভাবে ঠারভাষী বেদে জনগোষ্ঠীর সঙ্গেও বাঙালির পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা আজকের নয়। আমরা দেখেছি বেদে জনগোষ্ঠীও প্রায় কয়েক হাজার বছর ধরে বঙ্গের ভূমিপুত্র হিসেবেই বিচরণ করছে। অর্থাৎ জন্মলগ্ন থেকেই বাংলাদেশে বসবাসকারী অষ্ট্রিক নৃগোষ্ঠীর ঠারভাষী বেদেদের সঙ্গে বাংলাভাষার পরিচয় অস্বীকার করার সুযোগ নেই। ঠারভাষী এই বেদে জনগোষ্ঠী হাজার বছর আগে তাদের নিজ নিজ ভাষায় কথা বলত। দীর্ঘদিন দরে তারা যে তাদের ভাষা বজায় রাখতে পেড়েছিল তার প্রমান তাদের ভাষার সমার্থক শব্দের আধিক্য। ধীরে ধীরে বেদে জনগোষ্ঠী বাংলা ভাষী মানুষের সংস্পর্শে এসে সেই ভাষার প্রভাবে নিজেদের ভাষার পাশাপাশি বাংলা ভাষাকে গ্রহণ করেছে। ফলে ব্যাপক ভাবে ঠার ভাষায় বাংলা ভাষার প্রভাব পড়েছে।
বেদে জাতি ও সংস্কৃতিতে অন্যান্য জাতির সংস্পর্শ বা উপাদান এই সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে কিনা বা কোনো প্রভাব রাখতে সক্ষম হয়েছে কিনা তা চিহ্নিত করতে হলে আগে সুস্পষ্ট ভাবে চিহ্নিত করতে হবে কারা বেদে? কারা ঠারভাষী? সাধারণ বাবে ঠার ভাষায় কথা বললেই তারা বেদে বলে পরিচিত হলেও অনেক বেদে আছে যারা সাদরী ভাষায় কথা বলে। সিরাজগঞ্জে এমন বেদেবহরের সন্ধান পাওয়া গেছে। অবশ্য তারা নিজেদের বাদিয়া পরিচয় দেয়। বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গে সাঁওতাল ও ওরাওরা সাদরী ভাষায় কতা বলে। আবার ভারতের অনেকগুলো যাযাবর সম্প্রদায় রয়েছে যেমনÑ বাদিয়া, মিরাসী, বাওরিস, বিরক, ভাঙ্গি, শিকলিগর প্রভৃতি জাতির লোক আছে যারা ঠারভাষায় কথা বলে না। বাংলাদেশের বেশিরভাগ বেদে জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা ঠার হলেও তারা এখন বাংলাভাষাতেই কথা বলছে।আবার বেদে জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশের মাতৃভাষা বাংলা হরেও তারা বাঙালি নন। তাহরেও বেদে জনগোষ্ঠীর সঙ্গে বাঙালির একটি বিশেষ ঐক্য হচ্ছেÑ বর্তমানে এদের সবার ভাষাই বাংলা। বাঙালি সমাজ যেমন রাজনৈতিক ও ভৌগোরিক ভাবে দুটো বিশেষ ভাগে বিভক্ত তেমনি বেদেদের মধ্যেও ভাগ রয়েছে। ধর্মের দিক থেকে বাঙারিরা হিন্দু-মুসলমান- বৌদ্ধ- খ্রিষ্টান। এসব ধর্ম বিম্বাসীদের মধ্যেও অনেক বাগ রয়েছে। হিন্দুরা উচ্চবর্ণের ও নিম্নবর্গের হিন্দু, আদিবাসী হিন্দু যেমন তেমনি আবার মুসরমানদের মধ্রে শিয়া সুন্নি, আশরাফ, আতরাফও রয়েছে, রয়েছে আহমেদিয়া ও বাহাই মুসলমান। খ্রিষ্টানদের মধ্যে আছে বাঙালি খ্রিষ্টান ও আদিবাসী খ্রিষ্টান। বৌদ্ধদেরও তাই। অন্যদিকে বেদেদের মধ্যে মাল মান্তা বেদে, শান্দার মান্তা বেদে রয়েছে। অঞ্চল ভেদে তাদের ভাষাও আলাদা। তাহলে দেখা যাচ্ছে ভাষা সংস্কৃতির অবয়ব এক মাত্রিক নয়, বহুমাত্রিক। স্থানিক ভাবেও মানুষের সাংস্কৃতিক পার্থক্য লক্ষ করা যায়। যেমন উত্তর বঙ্গের ভাষা সংস্কৃতির সঙ্গে দক্ষিণবঙ্গের ভাষা সংস্কৃতির কিছুটা পার্থক্য লক্ষ করা যাবে। তা হলেও বংলাদেশের বাঙালি সংস্কৃতি বাংলাদেশের বাংলাভাষী জনসাধারণের সামগ্রিক সংস্কৃতিকে ধারণ করে এবং এই জনসাধরণের আঞ্চলিক সংস্কৃতিকে গবেষকগণ লোকসংস্কৃতি নামে অভিহিত করেছেন। এই সামগ্রিক সংস্কৃতির মধ্যে বাংলাভাষী বেদেজনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ অস্বীকার করা চলে না।
গবেষকদের ভাষ্য মতে প্রায় ৪০ হাজার বেদে ঠার ভাষায় কথা বললেও তাদের অনেকেরই মাতৃভাষা বা দ্বিতীয় ভাষা বাংলা। আমরা বেদেদের নৃতাত্বিক বৈমিষ্ট্য সনাক্ত করেছি তা অনেকাংশেই বাঙালির নৃতাত্বিক বৈশিষ্ট্যের অনুরূপ। দির্ঘদীন বাঙালির সঙ্গে ওঠাবসার কারণে তাদের ভাষায় –সংস্কৃতিতে বাংলা ভাসার প্রভাব রয়েছে। আমাদের মাঠ সমীক্ষায়ও বিষয়টি ধরা পড়ে। আমরা দেখেছি বেদেদের ঠার ভাষায় তারা অনেক বাংলা শব্দ বিকল্পনের মাধ্যমে নিজের করে নিয়েছে। আবার বাংলায় ও কিছু কিছু ঠার শব্দের সন্ধান মিরবে যেমন– ঠার শব্দ 'নোকো আঞ্চলিক বাংলায় নোক বা লোক। আবার খোমোর শব্দটি আঞ্চলিক বাংলায় একই অর্থে ব্যবহৃত হয় 'খোমা' অর্থ মুখ।
এছাড়া বেদেদের বর্তমান ঠার ভাষার যে বাক্য গঠন কাঠামো তা অনেকাংশেই বাংলার মতো।
বাক্যতত্ব
বাক্যের গঠনগত বিন্যাস বা শব্দ বিন্যাস কিংবা অর্থগত বিচারে ঠার ও বাংলা ভাষার মধ্যে মিল লক্ষ করা যায়। বাংলা ও ঠার ভাষায় সরল বাক্যের গঠন বা শব্দ বিন্যাসে কোনো বৈসাদৃম্য নেই। যেমন:
বাংলা: আমি ভাত খেয়েছিলাম।
ঠার: আং বতন টাগ ছেলান।
যৌগিক বাক্য গঠনের ক্ষেত্রেও বাক্যের গঠন কাঠামো ঠার ও বাংলা উভয় ভাষাতে একই রকম হয়। যেমন:
বাংলা: বেদেরা বানরের চরিত্র জানে তবুও বেদের পয়সা বানরেই খায়।
ঠার : যোদরের চরিত্র সারি করপাই মান্তা টো মাঙায় চুবি যোদরে টাগে।
জটিল বাক্য গঠনের ক্ষেত্রেও বাক্যের গঠন কাঠামো ঠার ও বাংরা উভয় ভাষাতে একই রকম। যেমন:
বাংলা : যে কাল জুতো মেরেছিল সে ফালতু মানুষ।
ঠার: যেন খুড়কাই ঢিপালেন তান বোজনা খাইকে মরগেল।
এরকম জিজ্ঞাসাসূচক ও আবেগ প্রকাশক বাক্রের গঠন প্রক্রিয়া উভয় ভাষাতেই একই রকম।
ঠার ভাষায় না বাচক বাক্য গঠনের ক্ষেত্রে না- বোধক শব্দটিও বাংলার মতই ক্রেয়ার শেষে বসে। যেমন:
বাংলা: আমি ভালো নেই।
ঠার: আং সাড্ডি নিঠু।
শুধু বাক্য গঠন কাঠামোই নয় বাক্যের রূপতত্ত্বে বচন, বিভক্তি ও ধ্বনিতাত্বিক প্রভাব ইত্যাদি একেবারেই বাংলা ভাষারই মতো। ড. সৌরভ সিকদার ঠার ভাষাকে চিনা-তিব্বতী ভাষার একটি শাখা বলে মনে করেন। কিন্তু চিনা তিব্বতী ভাষায় যে অং' ধ্বনির যোগসূত্র লক্ষ করা যায় তার প্রভাব ঠার ভাষায় নেই বললেই চলে। তাহলেও বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষা নিয়ে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো গবেসণা নজরে আসে নি। তাছাড়া বেদে জনগোষ্ঠীর ঠার ভাষার কোনো লিখিত রূপ না থাকায় এ বিসয়ে গবেসণা বেম জটিল। কেউ কেউ ঠার ভাসার বাক্র গঠন বাংলাভাষার অনুরূপ বলে একে ইন্দো ইউরোপীয় পরিবারে সদস্য বলতে চান। কিন্তু বাক্য গঠনই মেষ কথা নয়। যদি তা ই হতো তা হলে চিনা তিব্বতী পরিবারের মারমা ভাষার বাক্য গঠন প্রক্রিয়াও তো বাংলার মতো! তাছাড়া ত্রিপুরা( ককবোরাক), গারো, প্রভৃতি ভাষার বাক্য গঠনরীতি বাংলার মতো , তাই বলে এদেরকে ইন্দো-ইউরোপীয় বলা যায় না। তবে এটা সত্যিই আশ্চর্যের ব্যাপার যে, একটি অস্ট্রিক নৃগোত্রের মানুষের মুখের ভাষা কি করে চিনা-তিব্বতী ভাসা পরিবারে সদস্য হয়! সেই দিন নিশ্চয়ই খুব বেশি দূরে নয় যখন আমরা এই প্রশ্নের যথাযথ উত্তর জানতে পারব।
তথ্যসূচি
১. সৌরভ সিকদার, বাংলাদেশের আদিবাসী ভাষা, বাংলা একাডেমি, ঢাকা,
প্রথম প্রকাশ-২০১১, পৃ. ২৩
২. শুদ্ধসত্ত্ব বসু, বাংলা ভাষার ভূমিকা, কলকাতা, পৃ. ৯১
৩. সৌরভ সিকদার, প্রাগুক্ত, পৃ. ১২
৪. প্রাগুক্ত, পৃ. ২৩
৫. প্রাগুক্ত, পৃ. ২৩
৬. শঙ্করলাল দাস, মান্তা সম্প্রদায়ের জীবিকার সংকট ও জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের
পন্থা উদ্ভাবন, রিসার্চ ইনিশিয়েটিভস্ বাংলাদেশ, বনানী, টাকা-২০০৮, পৃ. ৩৪
৭. সৌরভ সিকদার, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৩
৮. প্রাগুক্ত, পৃ. ২২
৯. মিথশিলাক মুরমু-আদিবাসী অন্বেষণ, নওরোজ কিতাবিস্তান, বাংলাবাজার, পৃ. ১৯০
১০. শ্রীপান্থ, জিপসির পায়ে পায়ে, দে'জ পাবলিশিং, দ্বিতীয় সংস্করণ-২০১০, পৃ. ৫৬
১১. ফাদার যোসেফ রানা মণ্ডল, রাঢ় সমতটে খ্রিষ্ট ধর্ম, সোনাডাঙ্গা বিশপ হাউস,
খুলনা-২০১১, পৃ. ৪৩
১২. নাজমুননাহার লাইজু, বাংলাদেশের বেদে সম্প্রদায়, শোভা প্রকাশ, ঢাকা-২০১১,
পৃ. ৭৬
১৩. সুকুমার সেন, ভাষার ইতিবৃত্ত, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা-চতুর্থ মুদ্রণ-২০১৩,
পৃ. ২৩
১৪. আবুল কালাম মনজুর মোর্শেদ, আধুনিক ভাষাতত্ত্ব, মাওলা ব্রাদার্স,
বাংলাবাজার, প্রথম প্রকাশ-১৯৮৫, পৃ. ১৬৬
১৫. প্রাগুক্ত, পৃ. ১৬৬